প্রবৃদ্ধি কম, দুশ্চিন্তা কাটছে না

চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথমার্ধে রপ্তানি খাত খুব বেশি আশা জাগাতে পারেনি। অর্থবছরের প্রথম ছয় মাস শেষে সার্বিকভাবে রপ্তানিতে ১ শতাংশের মতো প্রবৃদ্ধি থাকলেও পোশাকের বাইরে বড় বড় প্রায় সব খাতেই রপ্তানি কমেছে। পোশাকেও রপ্তানি প্রবৃদ্ধি পৌনে ২ শতাংশের মতো। ফলে ডলার-সংকটের এ সময়ে রপ্তানি আয় নিয়ে দুশ্চিন্তা রয়েই গেছে।

পোশাক খাতের রপ্তানিতে এখন ওভেন খাত দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দেখা দিয়েছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে ওভেন পোশাক রপ্তানি আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ৪ শতাংশ কমে গেছে। ওভেন পোশাকের রপ্তানি বেশ কয়েক মাস ধরেই নেতিবাচক ধারায় রয়েছে। ওভেনের এ ঘাটতি কিছুটা পুষিয়ে দিয়েছে নিটওয়্যার পোশাকের রপ্তানি। এ খাতে গত জুলাই-ডিসেম্বরে রপ্তানি প্রবৃদ্ধি হয়েছে প্রায় সাড়ে ৬ শতাংশ। ফলে ওভেন ও নিট মিলিয়ে ৬ মাস শেষে পোশাক রপ্তানি এখনো ইতিবাচক ধারায় রয়েছে।

রপ্তানি প্রবৃদ্ধি ১ শতাংশের মধ্যে থাকলেও প্রবাসী আয়ে গত ৬ মাসে (জুলাই-ডিসেম্বর) প্রায় ৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে। ডলার-সংকটের এ সময়ে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের প্রধান দুই খাতে যে প্রবৃদ্ধি, তা দিয়ে চলমান সংকট কতটা দূর করা যাবে, এ নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে অর্থনীতিবিদদের মধ্যে।

তাঁরা বলছেন, রপ্তানি ও প্রবাসী আয়ে যে প্রবৃদ্ধি, তা দিয়ে সংকট দূর হবে না। আবার পোশাক খাতের রপ্তানি যে প্রবৃদ্ধি, সেটিও আশানুরূপ নয়। এমন পরিস্থিতিতে রপ্তানি ও প্রবাসী আয় বাড়াতে হলে বড় ধরনের উদ্যোগ নিতে হবে। দীর্ঘদিন ধরে অর্থনীতিবিদেরা রপ্তানি আয় বাড়াতে নতুনবাজারে জোর দেওয়ার পরামর্শ দিয়ে এলেও এ ব্যাপারে দৃশ্যমান বড় কোনো উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না।

জানতে চাইলে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম প্রথম আলোকে বলেন, অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে রপ্তানি ও প্রবাসী আয়ের যে প্রবৃদ্ধি, তা আশাবাদী করার চেয়ে দুশ্চিন্তাই বাড়াচ্ছে। বর্তমানে বৈদেশিক লেনদেন ও রিজার্ভ চাপে রয়েছে। আয়ের উৎস যখন দুর্বল থাকবে, তখন ঋণনির্ভরতা বাড়বে। আর বৈদেশিক মুদ্রার লেনদেন ঋণনির্ভর হলে তাতে পরিস্থিতি আরও নাজুক হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

রপ্তানি কত

রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো বা ইপিবির গতকাল মঙ্গলবার পণ্য রপ্তানির সর্বশেষ যে তথ্য প্রকাশ করেছে, তাতে গত জুলাই-ডিসেম্বরে পণ্য রপ্তানি দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৭৫৪ কোটি মার্কিন ডলারে। আগের অর্থবছর; অর্থাৎ ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম ৬ মাসে তার পরিমাণ ছিল ২ হাজার ৭৩১ কোটি ডলারের। সেই হিসাবে পণ্য রপ্তানিতে প্রবৃদ্ধি দাঁড়ায় শূন্য দশমিক ৮৪ শতাংশে।

একক মাস হিসেবে ডিসেম্বরের পণ্য রপ্তানি বিবেচনা করলে ২০২২ সালের ডিসেম্বরের তুলনায় গত ডিসেম্বরে পণ্য রপ্তানি ১ শতাংশের বেশি কমেছে। ২০২২ সালের ডিসেম্বরে প্রায় ৫৩৭ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়, গত ডিসেম্বরে যা কমে ৫৩১ ডলারে দাঁড়িয়েছে।

রপ্তানির ৮৫ শতাংশই পোশাক খাতের

গত ৬ মাসে মোট পণ্য রপ্তানির ৮৫ শতাংশই ছিল পোশাক খাতের। গত জুলাই-ডিসেম্বরে ২ হাজার ৩৩৯ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়। আগের অর্থবছরের একই সময়ে যার পরিমাণ ছিল ২ হাজার ৩০০ কোটি ডলার, তাতে এ খাতে প্রবৃদ্ধি ছিল ১ দশমিক ৭২ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে পোশাক খাতে পণ্য রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২ হাজার ৫৩৯ কোটি ডলারের। এ লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় রপ্তানি ছিল প্রায় ৮ শতাংশ কম।

ইপিবি গতকাল পণ্য রপ্তানির হালনাগাদ পরিসংখ্যান প্রকাশ করে তাতে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের প্রথম ৬ মাসে তৈরি পোশাক ছাড়া অধিকাংশ পণ্যের রপ্তানি কমে গেছে। এর মধ্যে রয়েছে হিমায়িত খাদ্য, পাট ও পাটজাত পণ্য, হোম টেক্সটাইল, প্রকৌশল পণ্য ইত্যাদি।

তৈরি পোশাকশিল্পের মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ জানিয়েছে, শুধু গত ডিসেম্বরে প্রায় ৪৫৬ কোটি ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি হয়। এই রপ্তানি গত বছরের নভেম্বরের তুলনায় ২ দশমিক ৩৫ শতাংশ কম। ২০২২ সালের ডিসেম্বরে ৪৬৬ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি হয়েছিল।

গত ৬ মাসে তৈরি পোশাকের পর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৫২ কোটি ৩০ লাখ ডলারের চামড়া ও চামড়াপণ্য রপ্তানি হয়েছে। এই রপ্তানি আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় প্রায় ১৮ শতাংশ কম। তৃতীয় সর্বোচ্চ ৫১ কোটি ডলারের কৃষিপণ্য রপ্তানি হয়েছে। এই রপ্তানি আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ২ দশমিক ২৮ শতাংশ বেশি।

অন্যদিকে পাট ও পাটজাত পণ্যের রপ্তানি কমেছে প্রায় সোয়া ১০ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের প্রথম ৬ মাসে ৪৪ কোটি ডলারের পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানি হয়েছে। গত অর্থবছরের একই সময়ে এ খাতের রপ্তানির পরিমাণ ছিল প্রায় ৪৯ কোটি ডলার।

মোটাদাগে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার উৎস তিনটি—রপ্তানি খাত, প্রবাসী আয় এবং বৈদেশিক ঋণ, বিনিয়োগ ও অনুদান। প্রবাসী আয় ও রপ্তানি বাড়লে বৈদেশিক মুদ্রার মজুত বাড়ে, যা দেশের সক্ষমতা বাড়ায়।

 সিপিডির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, আমরা দেখছি, রপ্তানি আয়ও সময়মতো দেশে আসছে না। তথ্যেও গরমিল রয়েছে। যেটুকু রপ্তানি হচ্ছে, সেটুকু আয়ও যদি সময়মতো আসত, তাহলেও এ সময়ে বৈদেশিক মুদ্রার লেনদেনের ক্ষেত্রে কিছুটা স্বস্তি মিলত।