ডলারের দাম বাড়ে, আয় বাড়ে সরকারের, চাপে পড়ে মানুষ

দেশে মার্কিন ডলারের দাম বাড়লে আয় বাড়ে সরকারের। কিন্তু তাতে পণ্যের আমদানি ব্যয় বেড়ে যায়, দাম বাড়ে। চাপে পড়ে সাধারণ মানুষ।

সরকারের আয় বাড়ে ডলারের বাড়তি দাম ধরে আমদানি করা পণ্যের ওপর শুল্ক আরোপের কারণে। কাস্টমস কর্তৃপক্ষ চলতি জুন মাসের জন্য শুল্ক আরোপের ক্ষেত্রে ডলারের দাম নির্ধারণ করেছে ১১৩ টাকা ৮০ পয়সা। গত মাসের শুরুতে তা ছিল ১১০ টাকা।

এতে শুধু চিনি থেকে সরকারের বাড়তি আয় হবে প্রতি কেজি দেড় টাকা। আর দুই বছরে ডলারের দাম ৮৬ থেকে ১১৪ টাকা হওয়ায় এক কেজি চিনি (বর্তমান মূল্য ধরে হিসাব করে) থেকে বাড়তি রাজস্ব আয় দাঁড়ায় ১০ টাকার মতো।

শুধু চিনি নয়, জ্বালানি তেল, তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাস (এলপিজি), ভোজ্যতেল, নিত্যব্যবহার্য পণ্যের কাঁচামাল, গুঁড়া দুধ, মসলা, ফলসহ সব আমদানি পণ্যের (যেগুলোর ওপর শুল্ককর রয়েছে) খরচ বেড়ে যায় ডলারের দাম বাড়লে। এর পুরো চাপ নিতে হয় সাধারণ মানুষকে, যাঁরা দেড় বছর ধরে উচ্চ মূল্যস্ফীতিতে ভুগছেন।

অপরিশোধিত চিনি আমদানিতে এখন মোট করভার ৫৯ শতাংশ। এর ওপর কেজিতে ৩ টাকা সুনির্দিষ্ট শুল্ক রয়েছে। বিশ্ববাজার থেকে এখন অপরিশোধিত চিনি আমদানি হচ্ছে টনপ্রতি ৬০০ ডলারের কিছু বেশি দামে। এতে প্রতি কেজি চিনিতে শুল্ককর দাঁড়ায় ৪০ টাকার মতো। বছরে পণ্যটি থেকে সরকার শুল্ককর আদায় করে ৫ হাজার কোটি টাকার বেশি।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয় চিনির ওপর শুল্ককর কমানোর অনুরোধ জানিয়ে বিভিন্ন সময় চিঠি দিয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর)। রাজস্ব বোর্ড তেমন কোনো ছাড় দেয়নি।

শুধু চিনি নয়, জ্বালানি তেল, তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাস (এলপিজি), ভোজ্যতেল, নিত্যব্যবহার্য পণ্যের কাঁচামাল, গুঁড়া দুধ, মসলা, ফলসহ সব আমদানি পণ্যের (যেগুলোর ওপর শুল্ককর রয়েছে) খরচ বেড়ে যায় ডলারের দাম বাড়লে। এর পুরো চাপ নিতে হয় সাধারণ মানুষকে, যাঁরা দেড় বছর ধরে উচ্চ মূল্যস্ফীতিতে ভুগছেন।

দেশীয় শিল্পের সুরক্ষার প্রয়োজন আছে। তবে তা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য যৌক্তিক হারে হতে হয়। সুরক্ষার নামে বেশি শুল্ককর আরোপ করা হলে মাশুল দিতে হয় ভোক্তাদের।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান

মূল্যস্ফীতির কথা মাথায় রেখে অর্থনীতিবিদদের কেউ কেউ শুল্ক কমানোর তাগিদ দিয়েছিলেন। সরকারের পক্ষ থেকে সাড়া পাওয়া যায়নি। গত রোজায় কিছু সময়ের জন্য ভোজ্যতেলে উল্লেখযোগ্য হারে করছাড় দেওয়া হয়েছিল। পরে তা তুলে নেওয়া হয়। পরে বেড়ে যায় তেলের দাম।

বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) মহাপরিচালক বিনায়ক সেন প্রথম আলোকে বলেন, নীতিগতভাবে তিনি মনে করেন, যেসব নিত্যপণ্যে শুল্ককর রয়েছে, তা অন্তত এক বছরের জন্য শূন্যের কাছাকাছিতে নামিয়ে আনা দরকার। শুধু কিছু অগ্রিম আয়কর থাকতে পারে। তিনি বলেন, সরকার মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য শুল্কনীতি সক্রিয়ভাবে বিবেচনা করতে পারে।

আরও পড়ুন

আমদানিনির্ভর নিত্যপণ্যের মধ্যে এখন গম, ডালজাতীয় পণ্যে তেমন কোনো শুল্ককর নেই। তবে অনেক ক্ষেত্রেই করভার অনেক বেশি। এবারের পবিত্র ঈদুল আজহায় যে গরমমসলা (জিরা, এলাচি, দারুচিনি) কিনবেন, তাতে করভার মোট ৫৯ শতাংশ। অর্থাৎ, ১০০ টাকার পণ্যে সরকার শুল্ককর পায় ৫৯ টাকা।

কাস্টমসে ডলারের দাম আরও বাড়ার আশঙ্কা আছে। কারণ, বাংলাদেশ ব্যাংকের ক্রলিং পেগ পদ্ধতিতে ডলারের দাম নির্ধারণ করা হয়েছে ১১৭ টাকা। সোনালী ব্যাংকেও আগামী দিনগুলোয় ডলারের দাম বাড়তে পারে। এতে শুল্কায়নে ডলারের দাম বাড়বে। তখন পণ্যের আরও দাম বাড়ার আশঙ্কা তৈরি হবে।

এবারের পবিত্র ঈদুল আজহায় যে গরমমসলা (জিরা, এলাচি, দারুচিনি) কিনবেন, তাতে করভার মোট ৫৯ শতাংশ। অর্থাৎ, ১০০ টাকার পণ্যে সরকার শুল্ককর পায় ৫৯ টাকা।

বিশ্ববাজারে কমেছে, দেশে ততটা নয়

২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া ইউক্রেনে হামলা চালানোর পর বিশ্ববাজারে পণ্যের দাম ব্যাপকভাবে বেড়ে গিয়েছিল। ওই বছর মে মাস থেকে দেশে ডলারের দাম বাড়তে থাকে। তখন প্রতি ডলারের দাম ছিল ৮৬ টাকা।

বিশ্ববাজারে অনেক পণ্যের দামই এখন রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর আগের পর্যায়ে নেমে এসেছে। কিন্তু দেশে দাম ততটা কমেনি। বিশ্বব্যাংকের হিসাব বলছে, ২০২২ সালের জানুয়ারি মাসে অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের ব্যারেলপ্রতি গড় দর ছিল ৮৫ ডলার। গত মাসে গড় দাম নামে ৮২ ডলারে। যুদ্ধ শুরুর পর তেলের দাম ১২০ ডলার ছাড়িয়েছিল।

দেশে ২০২১ সালের ৪ নভেম্বর সরকার ডিজেলের দাম ১৫ টাকা বাড়িয়ে লিটারপ্রতি ৮০ টাকা করে। তখনো ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ শুরু হয়নি। যুদ্ধ শুরুর পর ২০২২ সালের আগস্টে ডিজেলের দাম বাড়িয়ে একলাফে লিটারপ্রতি ৩৪ টাকা বাড়িয়ে ১১৪ টাকা করা হয়। এরপর কিছুটা কমে, আবার বাড়ে। এখন মাসে মাসে সমন্বয় করা হয়। জুনে দাম দাঁড়িয়েছে প্রায় ১০৮ টাকা।

আরও পড়ুন

ডিজেলের দাম ততটা না কমার কারণ ডলারের মূল্যবৃদ্ধি, শুল্ককর ও মুনাফার প্রবণতা। জ্বালানি তেলে এখন শুল্ক ও অগ্রিম আয়কর মিলিয়ে আমদানি পর্যায়ে করভার প্রায় ১৬ শতাংশ। এর বাইরে স্থানীয় পর্যায়ে বিভিন্ন হারে ভ্যাট রয়েছে। বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি) ২০২২-২৩ অর্থবছরে আমদানি শুল্ক, ভ্যাট ও আয়কর বাবদ সরকারকে ১৪ হাজার ৮০০ কোটি টাকা দিয়েছে। চলতি অর্থবছরে (২০২৩-২৪) গত এপ্রিল পর্যন্ত প্রায় ৪ হাজার ৯০০ কোটি টাকা মুনাফা করেছে প্রতিষ্ঠানটি।

বিশ্বব্যাংকের হিসাব বলছে, ২০২২ সালের জানুয়ারি মাসে অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের ব্যারেলপ্রতি গড় দর ছিল ৮৫ ডলার। গত মাসে গড় দাম নামে ৮২ ডলারে। যুদ্ধ শুরুর পর তেলের দাম ১২০ ডলার ছাড়িয়েছিল।

‘মাশুল দিতে হয় ভোক্তাদের’

পণ্যের আমদানি পর্যায়ে শুল্ককর আরোপ করার একটি উদ্দেশ্য হলো দেশীয় শিল্পকে সুরক্ষা দেওয়া, যাতে কম দামের বিদেশি পণ্য এসে বাজার সয়লাব না হয়ে যায়। তবে বাংলাদেশে অনেক ক্ষেত্রেই সুরক্ষার চেয়ে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যে শুল্ককর আরোপ করার প্রবণতা রয়েছে। অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, বাংলাদেশে গড় শুল্কহার উন্নয়নশীল অনেক দেশের চেয়ে বেশি।

আরও পড়ুন

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, দেশীয় শিল্পের সুরক্ষার প্রয়োজন আছে। তবে তা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য যৌক্তিক হারে হতে হয়। সুরক্ষার নামে বেশি শুল্ককর আরোপ করা হলে মাশুল দিতে হয় ভোক্তাদের। তিনি বলেন, শিগগিরই বাংলাদেশের স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে উত্তরণ ঘটবে। তখন বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) নিয়ম মানতে হবে। ইচ্ছেমতো শুল্ককর আরোপ করা যাবে না। বাংলাদেশকে প্রত্যক্ষ কর অর্থাৎ আয়কর বাড়াতে নজর দিতে হবে।