খাদ্য মূল্যস্ফীতি সাড়ে ১১ বছরে সর্বোচ্চ, মানুষের কষ্ট আরও বাড়ল  

সরকার আশা করেছিল মূল্যস্ফীতি কমবে, উল্টো বেড়ে গেছে।

ঢাকার দিয়াবাড়ি এলাকার একটি পোশাক তৈরির কারখানায় ব্যবস্থাপক হিসেবে কাজ করেন আবদুল্লাহ আল মামুন। এ বছরের জানুয়ারি মাসে তাঁর চার হাজার টাকা বেতন বেড়েছে। এখন মাসে মোট বেতন ৪০ হাজার টাকার মতো। থাকেন কাওলা এলাকায়। দুই ছেলে-মেয়ে, স্ত্রীসহ চারজনের সংসার।

বাজারে নিত্যপণ্যের দামের উত্তাপে মাসের আয় দিয়ে চলা আবদুল্লাহ আল মামুনের জন্য কঠিন। প্রায় প্রতি মাসেই আত্মীয়স্বজন-বন্ধুবান্ধবের কাছ থেকে ধারদেনা করে সংসার চালাতে হচ্ছে তাঁকে। 

আবদুল্লাহ আল মামুন প্রথম আলোকে বলেন, ‘যেদিন বেতন হয়, সেদিনই টাকা প্রায় ফুরিয়ে যায়। দোকানের বাকি টাকা, বাসাভাড়া পরিশোধ করতে হয়।’ তিনি জানান, গত এক বছরে তাঁর বাজার খরচ বেড়েছে প্রায় ৩০ শতাংশ, মাসে খরচ ২৪-২৫ হাজার টাকা। মাছ-মাংস খাওয়া প্রায় বন্ধই বলা চলে। এরপর বাসাভাড়া, সন্তানের স্কুলের বেতন দেওয়ার পর হাতে তেমন কিছু থাকে না। ধার করতে হয় অন্য সব খরচ চালাতে। 

যেদিন বেতন হয়, সেদিনই টাকা প্রায় ফুরিয়ে যায়। দোকানের বাকি টাকা, বাসাভাড়া পরিশোধ করতে হয়।
আবদুল্লাহ আল মামুন, একটি পোশাক তৈরির কারখানায় ব্যবস্থাপক

আবদুল্লাহ আল মামুনের মতো অবস্থা হয়তো প্রায় সব সীমিত আয় ও নিম্নমধ্যবিত্ত, মধ্যবিত্ত পরিবারের মানুষের। লম্বা সময় ধরে দেশে উচ্চ মূল্যস্ফীতি বিরাজ করছে। তবে সাম্প্রতিক সময়ে যে পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে, তা দেখা যাচ্ছে সরকারের পরিসংখ্যানেই।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) মূল্যস্ফীতির হালনাগাদ যে তথ্য গতকাল রোববার প্রকাশ করেছে, তাতে দেখা যাচ্ছে, খাদ্য মূল্যস্ফীতি সাড়ে ১২ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে। বিবিএসের হিসাবে, গত আগস্ট মাসে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ছিল ১২ দশমিক ৫৪ শতাংশ, যা গত ১১ বছর ৭ মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ। এর আগে ২০১২ সালের জানুয়ারি মাসে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১২ দশমিক ৭৩ শতাংশে উঠেছিল। এক দশকের মধ্যে গত আগস্ট মাসে হঠাৎ খাদ্য মূল্যস্ফীতি প্রথমবারের মতো দুই অঙ্কের ঘরে উঠে যায়। বিবিএস ও বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে। 

বিবিএসের হিসাব অনুযায়ী, দুই মাস কিছুটা কমার পর গত আগস্ট মাসে সার্বিক মূল্যস্ফীতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ৯২ শতাংশ। অর্থাৎ মূল্যস্ফীতির হার এখন প্রায় ১০ শতাংশ ছুঁই ছুঁই করছে। জুলাই মাসে যেখানে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ৭৬ শতাংশ, আগস্টে তা বেড়ে হয়েছে ১২ দশমিক ৫৪ শতাংশ। সেই তুলনায় খাদ্যবহির্ভূত খাতে মূল্যআগস্টে মূল্যস্ফীতি ৯ দশমিক ৯২ শতাংশ হওয়ার মানে হলো, ২০২২ সালে আগস্টে একজন মানুষ যে পণ্য ও সেবা ১০০ টাকায় কিনতেন, চলতি বছরের আগস্টে একই পণ্য কিনতে তাঁর খরচ হয়েছে ১০৯ টাকা ৯২ পয়সা।স্ফীতি হয়েছে ৭ দশমিক ৯৫ শতাংশ। 

আরও পড়ুন
আগস্টে মূল্যস্ফীতি ৯ দশমিক ৯২ শতাংশ হওয়ার মানে হলো, ২০২২ সালে আগস্টে একজন মানুষ যে পণ্য ও সেবা ১০০ টাকায় কিনতেন, চলতি বছরের আগস্টে একই পণ্য কিনতে তাঁর খরচ হয়েছে ১০৯ টাকা ৯২ পয়সা।

মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণকে সরকার সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য দিচ্ছে—একাধিকবার গণমাধ্যমকে বলেছিলেন পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান। সরকারের প্রত্যাশাও ছিল আগস্টে মূল্যস্ফীতি কমবে। 

তবে আগস্টে মূল্যস্ফীতি উল্টো বেড়ে যাওয়ার পর গতকাল এম এ মান্নান মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের কাজটি ‘সাপের খেলা’ জানার সঙ্গে তুলনা করেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, সাপের খেলা যে জানে, সে ঠিকই মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে। মূল্যস্ফীতি ওঠানামা করবে। বাজারের স্বাধীনতা আছে। যখন মূল্যস্ফীতি বাড়ে, তখন মানুষ একটু চাপে থাকে। তখন অপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কেনাকাটা কমিয়ে দেয়।

পরিকল্পনামন্ত্রী আরও বলেন, গত আগস্ট মাসে ডিম, মুরগিসহ বেশ কিছু পণ্যের দাম বেড়েছে, যা খাদ্য মূল্যস্ফীতি বাড়িয়েছে। এসব পণ্য মানুষকে যন্ত্রণা দিয়েছে। তবে চালের দাম স্থিতিশীল আছে। তাঁর মতে, উদীয়মান অর্থনীতিতে মূল্যস্ফীতি আশীর্বাদ। তবে মূল্যস্ফীতি বেশি বেড়ে গেলে তা নিয়ন্ত্রণ করা চ্যালেঞ্জিং।

আগস্টে মূল্যস্ফীতি ৯ দশমিক ৯২ শতাংশ হওয়ার মানে হলো, ২০২২ সালে আগস্টে একজন মানুষ যে পণ্য ও সেবা ১০০ টাকায় কিনতেন, চলতি বছরের আগস্টে একই পণ্য কিনতে তাঁর খরচ হয়েছে ১০৯ টাকা ৯২ পয়সা। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে খরচ বেড়েছে ৯ টাকা ৯২ পয়সা। মূল্যস্ফীতি হলো একধরনের করের মতো, যা ধনী-গরিব নির্বিশেষে সবার ওপর চাপ বাড়ায়। 

এর আগের মাসে, অর্থাৎ জুলাইয়ে মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ৬৯ শতাংশ এবং জুনে তা ছিল ৯ দশমিক ৭৪ শতাংশ। তবে গত মে মাসে দেশে মূল্যস্ফীতি হয়েছিল ৯ দশমিক ৯৪ শতাংশ। এই হার গত প্রায় এক যুগের মধ্যে সর্বোচ্চ। এ ছাড়া গত ২০২২-২৩ অর্থবছরের গড় মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক শূন্য ২ শতাংশ, যা বছরওয়ারি হিসাবে এক যুগের মধ্যে সর্বোচ্চ। 

আরও পড়ুন

খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১২%–এর বেশি

বিবিএসের হিসাবে, একটি পরিবারে যত অর্থ খরচ হয়, তার ৪৮ শতাংশের মতো খরচ হয় খাবার কিনতে। সেই খাবারের খরচ জোগানোর ক্ষেত্রে অনেক সাধারণ মানুষ এখন চাপে পড়ছেন। মূল্যস্ফীতির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে তাঁদের আয় বাড়ছে না। ফলে তাঁদের ক্রয়ক্ষমতা কমে যাচ্ছে, প্রকৃত অর্থে তাঁরা আরও গরিব হয়ে যাচ্ছেন। বিবিএসের হিসাবে, গত আগস্ট মাসে মজুরি বৃদ্ধির হার ছিল ৭ দশমিক ৫৮, যা মূল্যস্ফীতির হারের চেয়ে কম। 

গ্রাম-শহরনির্বিশেষে খাদ্য মূল্যস্ফীতি এখন ১২ শতাংশের বেশি। তবে এই হার আবার গ্রামাঞ্চলে বেশি। গত আগস্ট মাসে গ্রামে খাদ্য মূল্যস্ফীতি হয়েছে ১২ দশমিক ৭১ শতাংশ। আর শহরে তা ছিল ১২ দশমিক ১১ শতাংশ। 

বিবিএসের তথ্য অনুযায়ী, আগস্টে গ্রামাঞ্চলে সার্বিক মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৯ দশমিক ৯৮ শতাংশ। তুলনায় শহরে সার্বিক মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ৬৩ শতাংশ। 

তুলনামূলকভাবে উচ্চ মূল্যস্ফীতির স্তরে দেশের যাত্রা গত বছরের আগস্টে। ওই মাসে জ্বালানি তেলের দাম হঠাৎ বেশ বাড়ানো হয়। ফলে মূল্যস্ফীতি বেড়ে দাঁড়ায় ৯ দশমিক ৫২ শতাংশ। আর এ বছরের আগস্ট মাসে ৯ দশমিক ৯২ শতাংশ বেশি দামে পণ্য কিনতে হয়েছে। এতেই বোঝা যায়, সাধারণ মানুষের ওপর মূল্যস্ফীতির চাপ এক বছরের ব্যবধানে কতটা বেড়েছে। গত বছরের আগস্টের পর আর কখনোই মূল্যস্ফীতি সাড়ে ৮ শতাংশের নিচে নামেনি।

আরও পড়ুন

কেমন আছেন সাধারণ মানুষ

সিলেট শহরতলির তারাপুর চা–বাগানের পাশে গোয়াবাড়ি এলাকার মিন্টু যাদব অটোরিকশা চালান। প্রতি মাসে আয় ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা। তাঁর স্ত্রী গৃহপরিচারিকার কাজ করে আয় করেন আরও ৫ হাজার টাকা। চার মেয়েসহ ছয়জনের সংসার। তাঁদের আয়ে খাবার খরচ, বাড়িভাড়া, মেয়েদের স্কুলের বেতন, কোচিং, যাতায়াতসহ বিভিন্ন খরচ কুলায় না। প্রতি মাসেই ৫-৬ হাজার টাকা ধারকর্জ করতে হয়। সপ্তাহে এক দিন মাছ এবং মাসে একবার মাংস জোটে তাঁদের। 

মাধব মহলদার পেশায় মৎস্যজীবী। তাঁর বাড়ি খুলনার বটিয়াঘাটা উপজেলার জলমা গ্রামে। নদীতে মাছ কম, ফলে তাঁর আয়ও কমেছে। মাছ পেলে দিনে ৫০০ টাকার মতো আয় হয়। এ ছাড়া দেড় বিঘা জমিতে ধান চাষ করেন। জমানো ধানও ফুরিয়ে আসছে। চার সদস্যের পরিবারের খরচ চালাতে তাঁর নাভিশ্বাস ওঠে। আগে মাসে ১০ হাজার টাকা হলেই সংসার চলত। এখন জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে, তাই ১৪-১৫ হাজার টাকার কমে চলে না। 

আরও পড়ুন

ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার দেওগাঁও গ্রামের কৃষক রফিকুল ইসলাম। চার বিঘা জমিতে ধান, শাকসবজি আবাদ করেন। এটি তাঁর আয়ের উৎস। গত বোরো মৌসুমে তিন বিঘা জমিতে ধান আবাদ করে ৩০ হাজার টাকা মুনাফা করেছিলেন। এবার কৃষিপণ্য, সেচের খরচ বেড়েছে। সবজির মুনাফা চলে যাচ্ছে মধ্যস্বত্বভোগীর কাছে। ধারকর্জ করে জোড়াতালি দিয়ে চলছে তাঁর চারজনের সংসার। এখন বেশির ভাগ দিন শাকসবজি খেয়ে চলতে হয়।

চট্টগ্রাম নগরের চেরাগী পাহাড় মোড়ে রহমানিয়া কুলিং কর্নার নামের একটি খাবারের দোকান চালান ষাটোর্ধ্ব আলী আহম্মদ। গতকাল বেলা তিনটার দিকে যখন আলী আহম্মদের সঙ্গে কথা হচ্ছিল, তখন বললেন, বাজারে গেলে মাথা খারাপ হয়ে যায়। ১০০ টাকার পাঙাশ মাছের দাম এখন ২০০ টাকা।


[প্রতিবেদনে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন প্রথম আলোসিলেট, খুলনা, চট্টগ্রামঠাকুরগাঁওয়েরপ্রতিবেদকপ্রতিনিধিরা]