পণ্য পেতে মিলগেটে দীর্ঘ অপেক্ষা

বাড়তি ট্রাকভাড়া, পণ্যের বিশেষ দাম—সবকিছুর দাম ধরেই আটা, ময়দা ও চিনি বিক্রি করতে হচ্ছে খুচরা বিক্রেতাদের।

চিনিকলের সামনে চিনি নিতে আসা অপেক্ষমাণ ট্রাকের সারি। ট্রাকগুলো দুই থেকে চার দিন পর্যন্ত অপেক্ষায় রয়েছে চিনির জন্য। গতকাল দুপুরে নরসিংদীর পলাশে
ছবি: প্রথম আলো

নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের রূপসী এলাকায় দেশের অন্যতম একটি শিল্প গ্রুপের অর্থনৈতিক অঞ্চলের ট্রাকস্ট্যান্ডে বৃহস্পতিবার দুপুরে শত শত ট্রাক অপেক্ষমাণ ছিল। এসব ট্রাক ওখানকার একটি কারখানা থেকে চিনি নিতে এসে অপেক্ষায় রয়েছে।

গতকাল বেলা দুইটায় ওই স্ট্যান্ডে পৌঁছানো ট্রাকচালকেরা বুথে টোকেন সংগ্রহের জন্য ভিড় করেন। আগে থেকে যাঁরা অপেক্ষায় ছিলেন, তাঁদের বেশির ভাগই ট্রাকে ঘুমিয়ে অলস সময় পার করছেন। এ রকম ১৭ জন ট্রাকচালক ও তাঁদের সহযোগীর সঙ্গে গতকাল প্রথম আলোর কথা হয়।

তাঁদের একজন ট্রাকচালক আবদুল কাইয়ুম। ৪ নভেম্বর কিশোরগঞ্জ থেকে চিনি নিতে এসেছেন তিনি। গতকাল বৃহস্পতিবার পর্যন্ত তিনি জানেন না, ঠিক কবে চিনি নিয়ে কিশোরগঞ্জ ফিরতে পারবেন। ছয় দিন যাবৎ সহকারীসহ তিনি ট্রাকেই ঘুমাচ্ছেন। ট্রাকস্ট্যান্ডের ফটকের খাবার হোটেলগুলোতে খাচ্ছেন। তিনি বলেন, ‘গত ২১ অক্টোবর চিনি পাওয়ার কথা ছিল। তখন মিল ফটকে এসে ৩ দিন অপেক্ষার পরে জানানো হয়, কমপক্ষে ১৫ দিন পর চিনি পাওয়া যাবে। এরপর কিশোরগঞ্জ ফিরে যাই। ৪ নভেম্বর থেকে আবার চিনি নিতে এসে মিলের ফটকের সামনে অপেক্ষায় আছি।’

এভাবে শুধু শুধু ট্রাক বসিয়ে রাখলে মালিকের ক্ষতি। আয় নেই। তবু প্রতিদিন তিনবেলা খাবার খাওয়াতে হচ্ছে আমাদের। আর এভাবে বসে থাকতেও ভালো লাগে না।
লুৎফর রহমান, রংপুরের ট্রাকচালক

ঢাকার পাইকারি বাজার কিংবা ঢাকার বাইরে থেকে আসা অপেক্ষমাণ এসব ট্রাককে প্রতিদিন অপেক্ষায় থাকার জন্য দুই থেকে তিন হাজার টাকা ক্ষতিপূরণ গুনতে হয়। তাতে অপেক্ষার সময় যত বাড়ে, ভাড়া বা আনুষঙ্গিক খরচও তত বাড়তে থাকে। আর বাড়তি খরচ গিয়ে পড়ে পণ্যের দামের ওপর।

এ কারণে পাইকারি ও খুচরা বাজারে আটা-ময়দা-চিনির দাম বেড়ে যাচ্ছে। তবে জ্বালানি সংকট তীব্র হওয়ার পর থেকে বিশেষ চাহিদা আদেশের (ডিও) মাধ্যমে মিলগুলোর বিরুদ্ধে বেশি দামে পণ্য বিক্রির অভিযোগ উঠেছে। পাইকারি ক্রেতারা বলছেন, তাড়াতাড়ি পণ্য পেতে বিশেষ ডিও কিনতে গিয়ে তাঁদের আটা, ময়দা ও চিনিতে কেজিপ্রতি দুই থেকে তিন টাকা বেশি গুনতে হচ্ছে।

বিশেষ চাহিদা আদেশের মাধ্যমে পণ্য বিক্রির সত্যতা মেলে ট্রাকচালক আবদুল কাইয়ুমের কথায়। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা দিনের পর দিন অপেক্ষায় থাকলেও বিশেষ চাহিদা আদেশ নিয়ে আসা ট্রাক চিনি বোঝাই করে নিয়ে গন্তব্যে ফিরে গেছে। আর আমরা রাতদিন ট্রাকে অপেক্ষা করছি। মিল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে গত পরশু যোগাযোগ করা হলে তারা জানিয়েছে, পণ্যের সিরিয়াল পেতে আরও সাত-আট দিন লাগতে পারে। এখন অপেক্ষা ছাড়া উপায় নেই।’

ঝিনাইদহ থেকে গত বুধবার রাতে চিনি নিতে আসা ট্রাকচালক মো. আবদুল্লাহর অভিজ্ঞতাও প্রায় কাছাকাছি। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, চাহিদা আদেশ বা ডিও অনুযায়ী গত ৭ আগস্ট চিনি পাওয়ার কথা ছিল। ওই সময় এসে চার দিন অপেক্ষার পর জানানো হয় এক মাস পরে আসতে। সে অনুযায়ী সেপ্টেম্বরে আসার পর বলা হয় ১০ নভেম্বর আসতে। সেই অনুযায়ী গতকাল এসেছি। মিলগেটে কাউন্টারে কাগজ দেখানোর পর সেখান থেকে বলা হলো, রাত ১০টার পর বোঝা যাবে চিনি পাব কি পাব না।

তবে উল্টো চিত্রও আছে। নরসিংদী থেকে বিশেষ চাহিদা আদেশ বা ডিও নিয়ে চিনি নিতে আসা ট্রাকচালক শামীম আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, তিনি বড় একটি কোম্পানির জন্য চিনি নিতে এসেছেন। গতকাল সকালে এসেছেন। আশা করছেন শনিবার সকালের মধ্যে তিনি চিনি পাবেন। মিল কর্তৃপক্ষ তেমনটাই জানিয়েছে তাঁকে।

নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের রূপসী এলাকার বেসরকারি একটি চিনি মিলের সামনে অপেক্ষমাণ প্রায় ১৭ জন ট্রাকচালক ও সহযোগীর সঙ্গে কথা হয় প্রথম আলোর। তাঁদের ১২ জনই জানিয়েছেন, তাঁরা ‘বিশেষ চাহিদা আদেশের চিনি নিতে এসেছেন। তাই বেশি দিন অপেক্ষা করতে হবে না। অথচ ঢাকার বাইরে থেকে আসা অনেক ট্রাকচালক অভিযোগ করেছেন, গত তিন মাসে কয়েক দফা এসেও চিনি পাচ্ছেন না তাঁরা।

এবার নরসিংদীর পলাশের চরসিন্দুরের বেসরকারি আরেকটি চিনি মিলের কথায় আসা যাক। গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুর ১২টায় ওই এলাকার আঞ্চলিক সড়ক থেকে মিলগেট পর্যন্ত অপেক্ষমাণ ট্রাকের সারি। কোথাও সারিবদ্ধ, কোথাও এলোমেলো দাঁড়িয়ে অপেক্ষায় আছে চিনি নিতে আসা ট্রাক। এই মিলগেটের বাইরে ৫১টি ট্রাক ও ভেতরে ২টি ট্রাক অপেক্ষায় ছিল গতকাল দুপুর পর্যন্ত। এসব ট্রাকের কোনোটা দুই দিন, কোনোটা চার দিন ধরে মিলগেটের সামনে অপেক্ষা করছে।

রাজশাহী থেকে চিনি নিতে আসা ট্রাকচালক বাবু মিয়া প্রথম আলোকে বলেন, ‘তিন দিন ধরে মিলগেটে অপেক্ষা করছি। এখনো জানি না, কখন পণ্য পাব।’

মিলগেটের পাশে চায়ের দোকানে আড্ডা দিচ্ছিলেন রংপুর থেকে আসা ট্রাকচালক লুৎফর রহমান। চার দিন ধরে তিনি অপেক্ষায় রয়েছেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘এভাবে শুধু শুধু ট্রাক বসিয়ে রাখলে মালিকের ক্ষতি। আয় নেই তবু প্রতিদিন তিন বেলা খাবার খাওয়াতে হচ্ছে আমাদের। আর এভাবে বসে থাকতেও ভালো লাগে না।’

নাম প্রকাশ না করার শর্তে একটি চিনি মিলের কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, ‘এভাবে ট্রাক বসে থাকার সঙ্গে বাজারে চিনির দাম বাড়ার কোনো সম্পর্ক নেই। ট্রাকমালিকেরা তাঁদের স্বার্থেই এভাবে অপেক্ষায় থাকেন। আমাদের মিলে প্রতিদিন যে চিনি উৎপাদিত হয়, তার পুরোটাই দিয়ে দেওয়া হয়। তাতে আমরা ২৫-৩০ ট্রাক চিনি দিতে পারি।’

চিনি পরিশোধনকারী কোম্পানিগুলোর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গ্যাস ও বিদ্যুৎ–সংকটের কারণে মিলগুলোর উৎপাদন অর্ধেক কমে গেছে। আবার ডলার–সংকটের কারণে অপরিশোধিত চিনি আমদানির ঋণপত্র খুলতে পারছেন না তাঁরা। এ কারণে উৎপাদন সক্ষমতার পুরোটা ব্যবহার করতে পারছেন না তাঁরা। উৎপাদন যেভাবে কমেছে, বাজারে চাহিদা সেভাবে কমেনি। ফলে সরবরাহ ও চাহিদার মধ্যে একধরনের ভারসাম্যহীনতা তৈরি হয়েছে। আর এ কারণেই সময়মতো পণ্য সরবরাহ করা যাচ্ছে না।

চিনির মতো প্রায় একই অবস্থা আটা–ময়দার ক্ষেত্রেও। সময়মতো মিল থেকে পণ্য পাচ্ছেন না পাইকারি ব্যবসায়ীরা। ফলে খুচরা বাজারে সরবরাহেও টান পড়েছে। এতে বাজারে পণ্যের ঘাটতি দেখা দিয়েছে। তাতে বেড়েছে দামও।

গত বুধবার সরেজমিনে রাজধানীর মৌলভীবাজারের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সরবরাহ আদেশ বা এসও কেনাবেচা আগের চেয়ে বেড়েছে। এসব এসওর বিপরীতে সময়মতো পণ্য না পাওয়ায় বাজারে আটা, ময়দা ও চিনির সরবারহে টান লেগেছে। আর পণ্য আনতে গিয়ে দিনের পর দিন ট্রাকগুলোকে অপেক্ষায় থাকতে হচ্ছে। এতে প্রতিদিন দুই থেকে তিন হাজার টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে হচ্ছে। তাতে বাজারে পণ্যের দাম বেড়ে যাচ্ছে।

মৌলভীবাজারের ইয়াসিন স্টোরের মালিক শরিফুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, এর আগে এক গাড়ি চিনি পেতে ১৪ দিন সময় লেগেছিল। তখন ওই পণ্য পেতে ট্রাকভাড়া বাবদ ৪০ হাজার টাকা বাড়তি খরচ হয়েছিল। অথচ দিনের পণ্য দিনে পেলে মাত্র ৭ হাজার টাকা ট্রাকভাড়া দিলেই হয়।

এদিকে ব্যবসা সচল রাখতে দ্রুত পণ্য পাওয়ার জন্য বেশি দাম গুনছেন কোনো কোনো ব্যবসায়ী। তবে এ জন্য মিলগুলো আলাদা কোনো রসিদ দিচ্ছে না বলে ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে মৌলভীবাজারের এক ব্যবসায়ী প্রথম আলোকে বলেন, এই পরিস্থিতিতে ব্যবসায়ীরাও নিরুপায়। বাড়তি ট্রাকভাড়া, পণ্যের বিশেষ দাম—সবকিছুর দাম ধরেই আটা-ময়দা-চিনি বিক্রি করতে হচ্ছে। এতে প্রতিদিন দামের পরিবর্তন হচ্ছে। আবার দোকানভেদেও দামের ভিন্নতা আছে।

মিলগেটে ট্রাক অপেক্ষায় থাকলে ট্রাক ব্যবসায়ীদেরও ব্যবসার ক্ষতি হয়। তাঁরা অপেক্ষমাণ দিনগুলোর জন্য ক্ষতিপূরণ বাবদ যে অর্থ পান, তা মূলত চালক-শ্রমিকের পারিশ্রমিকেই চলে যায়। ট্রাকের ভাড়া হিসেবে কিছু পান না ট্রাকমালিক।

ঢাকার মৌলভীবাজারকেন্দ্রিক পণ্য আনা-নেওয়া করেন, এমন একজন ট্রাকমালিক মো. দাদন সরকার। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘মিলগেটে গিয়ে ট্রাক বসিয়ে রাখতে হলে ভাড়া পাওয়া যায় না। ক্ষতিপূরণ বাবদ যে অর্থ পাই, তা–ও অনেক সময় ছেড়ে দিতে হয়।’