বিশেষ সাক্ষাৎকার

বছর বছর শ্রমিকদের প্রকৃত মজুরি কমছে

শ্রমিকদের স্বীকৃতি, বৈষম্য নিরসন, তিন বছর পরপর মজুরি পুনর্নির্ধারণ, ট্রেড ইউনিয়ন নিবন্ধন সহজীকরণসহ ২৫ দফা সুপারিশ করেছে শ্রম সংস্কার কমিশন। মে দিবস উপলক্ষে কমিশনের সুপারিশের পাশাপাশি দেশের শ্রমিকদের কম মজুরি, দুর্ঘটনার বিচার না হওয়াসহ বিভিন্ন বিষয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন শ্রম সংস্কার কমিশনের প্রধান সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহম্মদ। গত ২৮ এপ্রিল সাক্ষাৎকার নিয়েছেন প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক শুভংকর কর্মকার।

প্রথম আলো:

বাংলাদেশের কোন খাতের শ্রমিকেরা বেশি বৈষম্যের শিকার হন?

সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহম্মদ: আমাদের অভিজ্ঞতা হচ্ছে, বৈষম্য সব খাতেই আছে। উদাহরণ হিসেবে বলি, সচিবালয়ের সব মন্ত্রণালয়ে আউটসোর্সিং কর্মচারী রয়েছে। স্থায়ী শ্রমিক ও আউটসোর্সিং শ্রমিকের মধ্যে অনেক বৈষম্য। মন্ত্রণালয়ের একজন নারী কম্পিউটার অপারেটর কমিশনের সঙ্গে মতবিনিময় সভায় বলেছেন, গর্ভধারণের পর দুই মাস ধরে তাঁকে সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে যে সন্তান রাখবেন, নাকি রাখবেন না। কারণ, আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে নিয়োগ পাওয়ায় তিনি মাতৃত্বকালীন ছুটি পাবেন না। বিনা বেতনে দু-তিন মাসের জন্য ছুটি নিতে হবে। অথচ স্থায়ী নিয়োগ পাওয়া নারী কর্মচারীরা বেতনসহ ছয় মাসের মাতৃত্বকালীন ছুটি পান। অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতেও বিশাল শ্রমগোষ্ঠীর কোনো আইনি সুরক্ষা নেই। ব্যক্তি খাতের গাড়িচালক ২০ বছর কাজ করার পরও নিয়োগকর্তা যদি বলেন কাল থেকে আসার দরকার নেই, তাহলে তাঁর আর যাওয়ার জায়গা (প্রতিকার) নেই। আসলে সব শ্রমজীবী মানুষই আয়ের ক্ষেত্রে বৈষম্যের শিকার। এক কথায় বললে বৈষম্য, অনিশ্চয়তা ও সুরক্ষার অভাব শ্রমক্ষেত্রের সর্বত্র বিরাজমান।

প্রথম আলো:

শ্রম সংস্কার কমিশন তিন বছর পরপর মজুরি পুনর্নির্ধারণ, নির্ধারিত সময়ে মজুরি না দিলে শ্রমিককে ক্ষতিপূরণ দেওয়াসহ বেশ কিছু সুপারিশ করেছে। এগুলো বাস্তবায়ন করতে গেলে মালিকের খরচ বাড়বে। কমিশনের সদস্যদের মধ্যে থাকা মালিকপক্ষের প্রতিনিধিরা এই সুপারিশের সঙ্গে একমত হয়েছেন?

সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহম্মদ: শ্রম সংস্কার কমিশনের শক্তিশালী দিক হচ্ছে বিভিন্ন পক্ষের লোকজন থাকলেও আমরা অভিন্ন সুপারিশ দিয়েছি। কোনো ভিন্নমত হয়নি, বিশেষ করে অর্থনৈতিক বিষয়ে। অবশ্যই মালিকদের জন্য বিষয়গুলো সংবেদনশীল ছিল। কতগুলো বিষয়ে মালিক প্রতিনিধিরা একমত হয়েছেন, এখন যেভাবে চলছে, সেভাবে চলতে পারে না। প্রায়ই পত্রপত্রিকায় খবর আসছে, মজুরি না পেয়ে শ্রমিকেরা রাস্তা অবরোধ করছেন। মালিক প্রতিনিধিরা এগুলো শৃঙ্খলার মধ্যে নিয়ে আসার বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছেছেন। সেই শৃঙ্খলার অংশ হিসেবে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে মজুরি না দিলে জরিমানার সুপারিশ করা হয়েছে। শ্রম কমিশনের সদস্যরা প্রথম থেকেই মনে করেছেন, কয়েকটি বিষয় থেকে জাতিকে সরিয়ে আনা দরকার। তার মধ্যে একটি হচ্ছে, সস্তা শ্রম থেকে বেরিয়ে আসা। এটার মধ্য দিয়ে আমরা সক্ষমতা অর্জন করব। তারপর আমরা মজুরি বাড়ানোর দিকে যেতে পারব।

প্রথম আলো:

বাংলাদেশের শ্রম খাতের মজুরি কেন কম?

সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহম্মদ: মজুরি কম হওয়ার জন্য দায়ী আমাদের জাতীয় মনোভাব, ‘কম মজুরি আমাদের প্রতিযোগিতার শক্তি’। দ্বিতীয়ত, মজুরি নির্ধারণে আমাদের কোনো মানদণ্ড নেই। ৪২ খাতে ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ করে নিম্নতম মজুরি বোর্ড। যদিও তাদের কাছে কোনো মানদণ্ড নেই। সেই বোর্ড মালিক ও শ্রমিকের কাছ থেকে একটা করে মজুরি প্রস্তাবনা নেয়। শেষ পর্যন্ত এখানে রাজনৈতিক বিবেচনার বিষয় চলে আসে। আসে সমঝোতার ব্যাপারও। তারপর একটা মজুরি নির্ধারিত হয়। আমরা শ্রম সংস্কার কমিশন থেকে স্থায়ী মজুরি কমিশনের কথা বলেছি। তাদের মজুরি নিয়ে নিজস্ব গবেষণা থাকতে হবে। সরকারের বিভিন্ন সংস্থা থেকে তথ্য–উপাত্ত সংগ্রহ করে মজুরি কমিশন নিজেই একটা মানদণ্ড তৈরি করবে। মানদণ্ড না থাকাটাও মজুরি কম হওয়ার আরেকটি বড় কারণ।

প্রথম আলো:

শ্রম সংস্কার কমিশন থেকে মজুরি নির্ধারণের ক্ষেত্রে জীবনধারণের উপযোগী দিকগুলোও বিবেচনায় নেওয়ার কথা এসেছে।

সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহম্মদ: হ্যাঁ, জীবনধারণের উপযোগী মজুরি নির্ধারণে লিভিং ওয়েজ একটা মানদণ্ড। এ ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) কিছু উপাদান রয়েছে, যা বিবেচনা করতে হয়। ন্যূনতম মজুরির চেয়ে লিভিং ওয়েজে সঞ্চয়, সন্তানদের শিক্ষা, পরিবার মর্যাদার দিকে যাতে যেতে পারে, সেসব বিষয় থাকতে হবে। বহু দেশেই লিভিং ওয়েজ আছে। গত সপ্তাহে ভারতের শ্রম মন্ত্রণালয় সংসদের জন্য একটি প্রস্তাব তৈরি করেছে, ন্যূনতম মজুরি হতে হবে ২৭ হাজার রুপি। তার মানে বাংলাদেশি টাকায় ৩৫ হাজার টাকা। ভারতের শ্রম মন্ত্রণালয় বলেছে, এটা আরও বাড়বে। পাশের একটা দেশে যদি মজুরি ২৭ হাজার রুপি হয়, তাহলে বাংলাদেশে মজুরি কতটুকু হবে। আমরা মনে করি, সস্তা শ্রম, সস্তা পণ্য ও সস্তা মূল্য—এই তিনটি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। আমরা দেখছি, দেশে বছর বছর শ্রমিকদের প্রকৃত মজুরি কমছে।

প্রথম আলো:

পাঁচ বছর অন্তর তৈরি পোশাক খাতের মজুরি পুনর্নির্ধারণের সময় দেখা যায়, মালিকপক্ষ মজুরি কম হারে বাড়ানোর জন্য বিভিন্ন সমস্যা সামনে আনেন। এখন তিন বছর পর মজুরি পুনর্নির্ধারণের বিষয়টি বাস্তবায়ন করতে হলে কী করণীয়?

সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহম্মদ: মজুরি নিয়ে বেশি আপত্তি তৈরি পোশাক বা যেসব শিল্পের মজুরি নিয়মিত পর্যালোচনা হয়, সেখান থেকে আসে। এখানে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, প্রকৃত মজুরি কমে গেলে মানুষের কাছ থেকে প্রত্যাশিত শ্রম পাওয়া সম্ভব কি না। মজুরির নিয়মই হচ্ছে সেটি যাতে শ্রমকে পুনঃ উৎপাদন করতে পারে। আমরা দেখছি, বছর বছর শ্রমিকদের প্রকৃত মজুরি কমার পাশাপাশি রেশন বন্ধ হয়ে গেছে। রেশন উপমহাদেশের সব দেশে থাকলেও আমাদের দেশে নেই। মূল্যস্ফীতির ভিত্তিতে মজুরি পুনর্নির্ধারিত করা না হলে সেটি পুনর্নির্ধারিত হয়েছে বলা যাবে না। রপ্তানিশিল্পের মালিকেরা মজুরি বাড়ানোর প্রশ্নে বলেন বিদেশি ক্রেতারা পণ্যের ন্যায্য মূল্য দেয় না। এ বিষয়ে ক্রেতারা বলেন, আমরা ন্যায্য মূল্য দিতে চাই; তবে তোমার মালিকেরা তা শ্রমিকদের দেবে না। এ জন্য আমরা কমিশনের পক্ষ থেকে জাতীয়ভাবে সামাজিক সংলাপের কথা বলেছি। সেখানে এই বিষয়গুলো নিয়ে আলাপ হতে পারে। মজুরি পুনর্নির্ধারণে ন্যূনতম মজুরি বোর্ডকে বড় ভূমিকা নিতে হবে। তারা যে মালিক ও শ্রমিকপক্ষের কাছে মজুরি প্রস্তাব চায়, সেটি ভুল। মজুরি আইনে কোথাও বলা নেই, মালিক-শ্রমিক প্রস্তাব দেবে; তারপর সেই প্রস্তাবের আলোচনা করে মজুরি নির্ধারিত হবে। আইনে বলা আছে, একটি পরিবারের চলা, অর্থনৈতিক অবস্থা, সামাজিক চাহিদা ও উন্নয়ন—সবকিছু বিবেচনা করে মজুরি ঠিক করতে হবে। সেসব বিবেচনা নিয়ে একটি পরিমাণ মজুরি বোর্ডকে ঠিক করতে হবে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) যদি বলে, এখন একটি পরিবারের খরচ ১৯ হাজার টাকা। তাহলে মজুরি আলোচনা ১৯ হাজার দিয়ে শুরু করতে হবে।

প্রথম আলো:

এ জন্য কি প্রথমেই ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ করা জরুরি?

সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহম্মদ: অবশ্যই। এটা না হলে কোনো খাতেই সুশৃঙ্খলভাবে গ্রহণযোগ্য মজুরি নির্ধারণ করা যাবে না।

প্রথম আলো:

শ্রম সংস্কার কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়ন কোথা থেকে শুরু করা দরকার?

সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহম্মদ: আমরা মনে করি, কতগুলো বিষয় খুব সহজেই বাস্তবায়ন করা যায়। আমরা যে সামাজিক সংলাপ ফোরামের কথা বলেছি, এটার জন্য আইনে পরিবর্তন লাগবে না। এটা করা গেলে আলোচনার ক্ষেত্র তৈরি হবে। এমনকি আগে বাস্তবায়ন শুরু করা যায়, এমন বিষয় সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যাবে। জাতীয় ন্যূনতম মজুরি প্রজ্ঞাপন দিয়ে করতে পারে সরকার। এটার জন্য খুব বেশি আলোচনা নয়, বরং তথ্য–উপাত্ত প্রয়োজন। শ্রমিকের স্বীকৃতির জন্য একটা ডিজিটাল তথ্যভান্ডারের কাজও দ্রুত শুরু করা সম্ভব।

প্রথম আলো:

কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনায় ক্ষতিপূরণের পরিমাণ খুবই কম। সেটি বাড়ানোর কথা আপনারা বলেছেন। ক্ষতিপূরণ কীভাবে নির্ধারণ করা দরকার?

সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহম্মদ: ক্ষতিপূরণের পরিমাণ বাড়াতে হবে। ক্ষতিপূরণের সর্বনিম্ন একটা হার থাকবে। এ ছাড়া অবহেলা, অবজ্ঞা, আইন না মানার কারণে দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে আইএলওর ১২১ কনভেনশন ধরে আয়ভিত্তিক ক্ষতিপূরণ নির্ধারণ করতে হবে। পর্যায়ক্রমে সারা দেশে আয়ের পরিমাণ অনুযায়ী ক্ষতিপূরণ নির্ধারণে একটা ফর্মুলা তৈরি করা দরকার। রানা প্লাজা ধসের ঘটনায় আহত ও নিহতের ক্ষতিপূরণের জন্য হাইকোর্টের নির্দেশনায় একটা ফর্মুলা তৈরি করা হয়েছিল। সেই অভিজ্ঞতাও কাজে লাগানো যেতে পারে।

প্রথম আলো:

রানা প্লাজা ধস, তাজরীন ফ্যাশনসের অগ্নিকাণ্ডসহ কোনো শিল্প দুর্ঘটনার বিচার হয়নি। বিচার না হওয়ার প্রভাব কতটা ভয়াবহ?

সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহম্মদ: রানা প্লাজা ধসের পর হাশেম ফুড ফ্যাক্টরি ও টাম্পাকো ফয়েলস কারখানা, চট্টগ্রামে কনটেইনার ডিপোতে অগ্নিকাণ্ডের প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে। হাশেম ফুড কারখানায় ৫০টি শিশু পুড়ে মারা গেছে। এতগুলো ঘটনা তো ঘটার কথা ছিল না। বিচারহীনতার কারণেই এমনটা হয়েছে। এই বিচারহীনতার সংস্কৃতির কারণে যেখানে বৈদেশিক বাণিজ্যের চাপ নেই, সেখানে কোনো কিছুই মানা হচ্ছে না। অর্থাৎ আইন ভঙ্গ করলে শাস্তি হতে পারে—সেই ধারণা মানুষের মধ্যে নেই। ধরেই নেওয়া হচ্ছে, শ্রম আইন এমন একটা আইন, যেটা না মানলে হইচই হবে, আর বেশি হতাহত হলে ক্ষতিপূরণ একটু বাড়াতে হতে পারে। বিচারহীনতার সংস্কৃতির কারণে আইন উপেক্ষা বা অবজ্ঞা করার প্রবণতা বাড়াচ্ছে।

প্রথম আলো:

ট্রেড ইউনিয়ন নিবন্ধনে প্রতিষ্ঠানের মোট শ্রমিকের অনুপাতের শর্তের পরিবর্তে ন্যূনতম শ্রমিক সংখ্যা বিবেচনা করার ওপর জোর দিয়েছে কমিশন। এতে কি ট্রেড ইউনিয়ন নিবন্ধনে গুণগত পরিবর্তন আসবে?

সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহমেদ: আমরা মনে করি, অনেক উন্নতি হবে। বর্তমানে একটি বা দুটি খাতে ট্রেড ইউনিয়ন সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে। এখানেই সবাই ঘুরপাক খাচ্ছে। সবচেয়ে বড় উন্নতি হবে, ইউনিয়ন অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে চলে যাবে। যেমন নির্মাণ, দিনমজুরি, সেলুন কর্মচারীরা সংগঠিত হবে। তৈরি পোশাক খাতের কোনো কারখানা থেকে ট্রেড ইউনিয়ন নিবন্ধনের আবেদন শ্রম দপ্তরে জমা হলেই প্রথমে জানতে চাওয়া হয়, কর্মীর সংখ্যা কত। স্বাক্ষর ঠিক আছে কি না। এগুলো করতে গিয়েই দুর্নীতি শুরু হয়। তখন শ্রম দপ্তর মালিক ও শ্রমিক উভয়ের কাছ থেকেই সুবিধা নেয়। ইউনিয়ন নিবন্ধনে প্রতিষ্ঠানের মোট শ্রমিকের অনুপাতের শর্তের পরিবর্তে ন্যূনতম শ্রমিকসংখ্যা বিবেচনা করলে গুণগত পরিবর্তন আসবে।

প্রথম আলো:

সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।

সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহমেদ: আপনাকেও ধন্যবাদ।