তিন বছরের মধ্যে বাতিল করতে হবে সব করছাড়

আগামী অর্থবছর থেকে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে করছাড় দেওয়ার ক্ষমতা বাতিলের শর্তও আছে। 

আগামী ২০২৪–২৫ অর্থবছরের জাতীয় বাজেটে রাজস্ব খাত বিষয়ে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) দেওয়া শর্ত পূরণের প্রতিফলন থাকতে হবে। এ জন্য করছাড় কমানোর উদ্যোগ নিতে হবে। ২০২৭ সালের ১ জুলাইয়ের আগে তিন ধাপে বিদ্যমান সব ধরনের করছাড় বাতিল করতে হবে। আগামী অর্থবছর থেকে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে করছাড় দেওয়ার ক্ষমতা বাতিলের শর্তও দিয়েছে সংস্থাটি। আইএমএফের শর্ত অনুযায়ী, রাজস্ব আদায় বাড়াতে হবে। অথচ এনবিআরের কার্যক্রমে তার খুব একটা প্রতিফলন নেই।

এমন অবস্থায় আইএমএফের ঋণের তৃতীয় কিস্তি ছাড়ের আগে অর্থনীতি পর্যালোচনা করতে ঢাকা এসেছে আইএমএফের প্রতিনিধিদল। এই প্রতিনিধিদল এনবিআরের কর্মকর্তাদের সঙ্গে একাধিক বৈঠক করবে।

আইএমএফের কাছ থেকে আগামী ২০২৬ সাল পর্যন্ত সাড়ে তিন বছরে মোট সাত কিস্তিতে ৪৭০ কোটি ডলার মিলবে। এর মধ্যে দুই কিস্তির অর্থ ইতিমধ্যে পাওয়া গেছে। তবে আগামী জুন মাসের মধ্যে তৃতীয় কিস্তির অর্থ ছাড়ের আগে রাজস্ব খাতে দৃশ্যমান বড় সংস্কার করতে হবে। 

রাজস্ব খাতে সংস্কারের অন্যতম হলো আয়কর, মূল্য সংযোজন কর (মূসক বা ভ্যাট) এবং শুল্ক খাতে বছরের পর বছর যেসব করছাড় দেওয়া হয়েছে, সেগুলো কমাতে হবে। 

এনবিআর এবারও যে বিরাট রাজস্ব–ঘাটতির মধ্যে থাকবে, তা বলা বাহুল্য। বছর শেষে বড়জোর ৩ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকার মতো রাজস্ব আদায় হতে পারে। রাজস্ব খাতের সংস্কার করতে হবে।
আহসান এইচ মনসুর, নির্বাহী পরিচালক, পিআরআই

এনবিআরের সূত্রগুলো বলছে, বছরের পর বছর বিভিন্ন খাতে যেসব করছাড় দেওয়া হয়েছে, তা ধীরে ধীরে কমিয়ে ফেলার শর্ত দিয়েছে আইএমএফ। এই করছাড় কমানোর জন্য অগ্রাধিকার ভিত্তিতে তিন ধরনের পদক্ষেপ নেওয়ার কথা বলেছে সংস্থাটি। প্রথমত, যেসব করছাড় ভালো ফল দেয়নি, সেগুলো শিগগিরই বাতিল করা। দ্বিতীয়ত, কিছু করছাড় আছে যেগুলো যৌক্তিক করা যেতে পারে। এ জন্য শিগগিরই অর্থনৈতিক বিশ্লেষণ করা (যেমন—যৌক্তিকতা, প্রাসঙ্গিকতা, কার্যকারিতা) দরকার। তৃতীয়ত, যেসব করছাড় রাখা প্রয়োজন, সেগুলো মধ্য মেয়াদে বিবেচনা করা যেতে পারে। 

সম্প্রতি আইএমএফের আরেকটি দল এসে করছাড় সম্পর্কে এসব পরামর্শ দিয়েছে। তারা নতুন আয়কর আইনের ৭৬(১) ধারা বাতিলের মাধ্যমে কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে করছাড় দেওয়ার স্বেচ্ছাচারী ক্ষমতা বাতিলের শর্ত মানতে বলেছে। এই ধারায় যত করছাড় দেওয়া হয়েছে, তার সব কটিই ২০২৭ সালের ১ জুলাইয়ের মধ্যে বাতিল করতে হবে। 

গত পাঁচ দশকে ২০০–এর বেশি প্রজ্ঞাপন জারি করে বিভিন্ন খাতকে করছাড় দেওয়া হয়েছে। আইএমএফের শর্ত পূরণ করতে এনবিআর একটি কমিটি গঠন করেছে। সেই কমিটি বাজেটের আগে করছাড় নিয়ে একটি পর্যালোচনা প্রতিবেদন দেবে। সেই অনুসারে আগামী ২০২৪–২৫ অর্থবছরের বাজেটে অন্তত ভ্যাট ও আয়করের কয়েকটি খাতের কর অব্যাহতি তুলে দেওয়া হবে বলে এনবিআরের একাধিক কর্মকর্তা প্রথম আলোকে জানিয়েছেন। 

রাজস্ব আদায় নাজুক

চলতি ২০২৩–২৪ অর্থবছর থেকেই মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) দশমিক ৫ শতাংশ পরিমাণ অতিরিক্ত শুল্ক-কর আদায়ের শর্ত আছে। মূল বাজেটে এনবিআরের রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য ছিল, ৪ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। পরে তা ২০ হাজার কোটি কমিয়ে ৪ লাখ ১০ হাজার কোটি টাকা করা হয়েছে। 

কিন্তু রাজস্ব আদায়ের পরিস্থিতি ভালো নয়। চলতি অর্থবছরের প্রথম ৯ মাস জুলাই-মার্চে রাজস্ব আদায় ঘাটতি হয়েছে ২১ হাজার ৯৩০ কোটি টাকা। এ সময় সব মিলিয়ে ২ লাখ ৫৯ হাজার ৮১৪ কোটি টাকা আদায় হয়েছে। সে হিসাবে আগামী তিন মাসে প্রায় দেড় লাখ কোটি টাকা আদায় করতে হবে। অর্থাৎ প্রতি মাসে আদায়ের লক্ষ্য বেড়ে হয়েছে ৫০ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু কখনোই এক মাসে এই পরিমাণ রাজস্ব আদায় করতে পারেনি এনবিআর।

বেসরকারি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর প্রথম আলোকে বলেন, এনবিআর এবারও যে বিরাট রাজস্ব–ঘাটতির মধ্যে থাকবে, তা বলা বাহুল্য। বছর শেষে বড়জোর ৩ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকার মতো রাজস্ব আদায় হতে পারে। রাজস্ব খাতের সংস্কার করতে হবে। শুল্ক-করব্যবস্থা স্বয়ংক্রিয় করতে হবে। বর্তমান রাজস্ব প্রশাসন দিয়ে এত বিশাল রাজস্ব আদায় করা সম্ভব নয়। 

আহসান এইচ মনসুর আরও বলেন, করছাড় একবারে তোলা সম্ভব নয়। ধীরে ধীরে তুলতে হবে। আগের বাজেটে যেসব খাতে করছাড় দেওয়ার পরও তেমন লাভ হয়নি, এমন কিছু খাতের করছাড় তুলে দেওয়া উচিত।