আওয়ামী লীগের ১৫ বছরে সবচেয়ে বেশি দুর্নীতি ব্যাংক খাতে: প্রতিবেদনের তথ্য
ব্যাংক খাতে দুর্নীতি ও অনিয়মের জন্য ঋণ কেলেঙ্কারি, প্রতারণা, ভুয়া ঋণ ও ঋণের অপব্যবহারের বিভিন্ন ঘটনা চিহ্নিত করা হয়েছে।
বড় অবকাঠামো প্রকল্প থেকে অর্থ আত্মসাৎ করতে প্রকল্পের আওতায় অবৈধ জমি ও সম্পদ অধিগ্রহণ করা হয়েছে।
বাজারে পণ্যের স্বাভাবিক সরবরাহব্যবস্থাকে পুরোপুরি ধ্বংস করে ফেলা হয়েছে।
আওয়ামী লীগ সরকারের ১৫ বছরের শাসনামলে লুটপাট সবচেয়ে বেশি হয়েছে ব্যাংক খাতে। এরপর ছিল ভৌত অবকাঠামো। এ দুটিসহ মোট চারটি খাতে এই সময়ে বেশি লুটপাট হয়েছে। বাকি দুটি খাত হলো বিদ্যুৎ ও জ্বালানি এবং তথ্যপ্রযুক্তি।
বাংলাদেশের বিদ্যমান অর্থনৈতিক অবস্থার শ্বেতপত্র প্রণয়নে গঠিত কমিটির প্রতিবেদনে এসব বিষয় উঠে এসেছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। প্রতিবেদনে ব্যাংক খাতে দুর্নীতি ও অনিয়মের জন্য ঋণ কেলেঙ্কারি, প্রতারণা, ভুয়া ঋণ ও ঋণের অপব্যবহারের বিভিন্ন ঘটনা চিহ্নিত করা হয়েছে। এ ছাড়া রাষ্ট্রীয় মদদে ব্যাংক দখলে সহায়তা করা হয়েছে। ব্যাংক খাত থেকে অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে যে অর্থ লুট করা হয়েছে, তার বড় অংশই পাচার হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি এরই মধ্যে তাদের প্রতিবেদন চূড়ান্ত করেছে। আগামীকাল রোববার এই প্রতিবেদন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে জমা দেওয়ার কথা রয়েছে।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়। এরপর ২৮ আগস্ট দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক অবস্থা তুলে ধরতে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের নেতৃত্বে ১২ সদস্যের শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি গঠন হয়। এই কমিটিকে ৯০ দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়।
শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি এরই মধ্যে তাদের প্রতিবেদন চূড়ান্ত করেছে। আগামীকাল রোববার এই প্রতিবেদন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে জমা দেওয়ার কথা রয়েছে।
শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির বাকি ১১ সদস্য হলেন বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন, বেসরকারি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান, সানেমের নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান, ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক এ কে এনামুল হক, ব্যবসায়ীদের গঠিত নীতি পর্যালোচনা সংস্থা বিজনেস ইনিশিয়েটিভ লিডিং ডেভেলপমেন্টের (বিল্ড) প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ফেরদৌস আরা বেগম, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (বিআইজিডি) নির্বাহী পরিচালক ইমরান মতিন, বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণাপ্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) জ্যেষ্ঠ গবেষণা ফেলো কাজী ইকবাল, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক ম. তামিম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ আবু ইউসুফ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক শরমিন্দ নীলোর্মি ও বেসরকারি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্টস রিসার্চ ইউনিটের (রামরু) প্রতিষ্ঠাতা চেয়ার তাসনিম আরিফা সিদ্দিকী।
কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বড় বড় অবকাঠামো প্রকল্প থেকে অর্থ আত্মসাৎ করতে প্রকল্পের আওতায় অবৈধ জমি ও সম্পদ অধিগ্রহণ করা হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, কমিটির সদস্যরা আলাদা বিষয়ে একেকটি প্রতিবেদন তৈরি করেছেন। পরে সব খাতের প্রতিবেদন একত্র করে মূল প্রতিবেদন তৈরি করা হয়। ‘বাংলাদেশের অর্থনীতির অবস্থা নিয়ে শ্বেতপত্র’ শীর্ষক এই প্রতিবেদনে জিডিপি প্রবৃদ্ধি,মূল্যস্ফীতি, বৈদেশিক ভারসাম্য, ব্যাংকিং খাত, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি, সরকারের ঋণ, পরিসংখ্যানের মান, বাণিজ্য, রাজস্ব, ব্যয়, বড় প্রকল্প, ব্যবসার পরিবেশ, দারিদ্র্য ও সমতা, পুঁজিবাজার, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, নারী, জলবায়ু ইস্যুসহ বিভিন্ন বিষয়ে আলাদা অধ্যায় থাকবে। প্রধান উপদেষ্টার কাছে হস্তান্তরের পর তা জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করা হতে পারে।
কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বড় বড় অবকাঠামো প্রকল্প থেকে অর্থ আত্মসাৎ করতে প্রকল্পের আওতায় অবৈধ জমি ও সম্পদ অধিগ্রহণ করা হয়েছে। ভৌত অবকাঠামো খাতে দুর্নীতির জন্য রাজনৈতিক মদদপুষ্ট অলাভজনক প্রকল্প গ্রহণ, সম্পদের অপব্যবহার, প্রকল্পের মেয়াদ ও খরচ বৃদ্ধিকে অন্যতম কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
শুধু তা–ই নয়, বিভিন্ন প্রকল্পের সম্পদ, গাড়ি ও ভ্রমণ খরচের অপব্যবহার করা হয়েছে রাজনৈতিক ও ব্যক্তিগত লাভের জন্য। প্রকল্পের কাজ পেতে ঘুষ গ্রহণ একটি নিয়মিত চর্চায় পরিণত হয়েছিল আওয়ামী লীগের শাসনামলে।
এসব কাজ করা হয়েছে মূলত প্রকল্পের মাধ্যমে অর্থ আত্মসাতের জন্য। প্রকল্প থেকে অর্থ লুটপাটের জন্য প্রকল্প পাসের আগে কৃত্রিমভাবে খরচ বাড়ানো হয়েছে। পরে বাড়তি অর্থ নানাভাবে সরিয়ে নেওয়া হয়। প্রকল্পের কেনাকাটার ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতাহীন দরপত্রের মাধ্যমে নিজেদের পছন্দের লোককে কাজ দেওয়া হয়েছে, বাদ দেওয়া হয় যোগ্য দরদাতাদের।
শ্বেতপত্র কমিটি সূত্রে জানা গেছে, আওয়ামী লীগ সরকারের ১৫ বছরের শাসনামলে নেওয়া বিভিন্ন প্রকল্পে নিয়োগের ক্ষেত্রেও ব্যাপকভাবে স্বজনপ্রীতি করা হয়েছে। বিশেষ করে প্রকল্প পরিচালক নিয়োগের ক্ষেত্রে মেধার বদলে রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা বেশি প্রাধান্য দেওয়া হয়। প্রকল্পের ঠিকাদার নিয়োগের ক্ষেত্রেও রাজনৈতিক বিবেচনাকে প্রাধান্য দিয়ে অতিমূল্যায়িত চুক্তি করা হয়। শুধু তা–ই নয়, বিভিন্ন প্রকল্পের সম্পদ, গাড়ি ও ভ্রমণ খরচের অপব্যবহার করা হয়েছে রাজনৈতিক ও ব্যক্তিগত লাভের জন্য। প্রকল্পের কাজ পেতে ঘুষ গ্রহণ একটি নিয়মিত চর্চায় পরিণত হয়েছিল আওয়ামী লীগের শাসনামলে।
প্রতিবেদনে বাজার ব্যবস্থাপনার অকার্যকারিতার কারণ সম্পর্কে বলা হয়, বিগত ১৫ বছরে বাজারের স্বাভাবিক সরবরাহব্যবস্থাকে পুরোপুরি ধ্বংস করে ফেলা হয়েছে। এর বদলে কারসাজির সরবরাহপ্রক্রিয়া তৈরির মাধ্যমে বাজারব্যবস্থাকে অকার্যকর করা হয়। সরকারের দিক থেকে বিভিন্ন গোপন তথ্য নির্ধারিত গোষ্ঠীর কাছে সরবরাহ করা হতো আর্থিক লাভের জন্য। বাজার ব্যবস্থাপনায় অনেক সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে কিছু ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর স্বার্থ মাথায় রেখে।
কমিটি পদ্মা সেতু, পদ্মা রেলসংযোগ, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, মাতারবাড়ী বিদ্যুৎকেন্দ্র ও কর্ণফুলী টানেলের মতো বড় প্রকল্পগুলোর ওপর তাঁদের পর্যবেক্ষণ তুলে ধরেছেন। পাশাপাশি বিভিন্ন খাতে অনিয়ম-দুর্নীতি রোধে করণীয় বিষয়েও সুপারিশ করেছে কমিটি।
শ্বেতপত্র কমিটির প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, দুর্নীতি ও অনিয়মের জন্য সরকারি কর্মকর্তা ও রাজনৈতিক ব্যক্তিদের মধ্যে গড়ে উঠেছিল একধরনের আঁতাত। এ জন্য সরকারি বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে পদায়নের ক্ষেত্রে আর্থিক লেনদেনের ঘটনাও ঘটেছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে কমিটির একাধিক সদস্য প্রথম আলোকে বলেন, সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ের অংশীজনদের সঙ্গে আলোচনা, সংশ্লিষ্ট সরকারি দপ্তরের নথিপত্র পর্যালোচনা ও কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে বিভিন্ন খাতের অনিয়মের ধরন চিহ্নিত করা হয়েছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট অনিয়মের তথ্য-উপাত্তও তুলে আনা হয়েছে। কমিটি পদ্মা সেতু, পদ্মা রেলসংযোগ, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, মাতারবাড়ী বিদ্যুৎকেন্দ্র ও কর্ণফুলী টানেলের মতো বড় প্রকল্পগুলোর ওপর তাঁদের পর্যবেক্ষণ তুলে ধরেছেন। পাশাপাশি বিভিন্ন খাতে অনিয়ম-দুর্নীতি রোধে করণীয় বিষয়েও সুপারিশ করেছে কমিটি।