ঢাকা মহানগরের জন্য নতুন বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনার (ড্যাপ) অনুমোদন দিয়েছে সরকার। তাতে গুলশান, বারিধারা, ধানমন্ডিসহ কয়েকটি এলাকা ছাড়া অধিকাংশ এলাকায় বর্তমানের চেয়ে কম উচ্চতার ভবন নির্মাণ করতে হবে। নতুন ড্যাপের কারণে অ্যাপার্টমেন্টের দামও বাড়বে বলে জানিয়েছেন এ খাতের ব্যবসায়ীরা। তাঁরা বলছেন, নতুন করে নানামুখী জটিলতায় পড়বে আবাসন খাত।
আবাসন খাতের ব্যবসায়ীরা বলছেন, নতুন ড্যাপে ভবনের উচ্চতার ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করায় আবাসিক ও বাণিজ্যিক ভবন নির্মাণ প্রকল্প নেওয়া কমে যাবে। তাই অ্যাপার্টমেন্ট বা ফ্ল্যাটের দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যেতে পারে। ইতিমধ্যে জমির মালিকের সঙ্গে যেসব চুক্তি হয়েছে কিন্তু ভবনের নকশা অনুমোদন হয়নি, তা নিয়েও জটিলতায় পড়বে আবাসন প্রতিষ্ঠানগুলো।
নতুন ড্যাপের কারণে ঢাকার অধিকাংশ এলাকায় আগের চেয়ে কম উচ্চতার ভবন নির্মাণ করতে হবে। জমির দামও কমছে না। ফলে স্বাভাবিকভাবেই ফ্ল্যাটের দাম আরও বাড়বে।
গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় গত ২৩ আগস্ট নতুন ড্যাপের প্রজ্ঞাপন জারি করে। নতুন ড্যাপ অনুযায়ী, গুলশান, বারিধারা, শাহবাগ, বাংলামোটর, পরীবাগ ও ধানমন্ডি এলাকায় তুলনামূলক উঁচু ভবন বানানো যাবে। তবে উত্তরা, মিরপুর ১১, বাউনিয়া, পাইকপাড়া, কল্যাণপুর, জোয়ারসাহারা, কুড়িল, খিলক্ষেত, কালাচাঁদপুর, কড়াইল, মেরুল বাড্ডা, রামপুরা, উলন, নিকেতন, নয়াটোলা, মধুবাগ, গোড়ান, সিপাহীবাগ, মধ্য বাসাবো, আনসারাবাদ, সবুজবাগ, কদমতলা, দক্ষিণগাঁও, মালিবাগ, শান্তিবাগ, শুক্রাবাদ, পশ্চিম রাজাবাজার, জিগাতলাসহ কিছু এলাকায় নতুন ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে উচ্চতা আগের চেয়ে কমবে। বর্তমানে ইমারত নির্মাণ বিধিমালা অনুযায়ী, উত্তরায় তিন কাঠার একটি প্লটে সর্বোচ্চ সাততলা পর্যন্ত আবাসিক ভবন নির্মাণ করা যায়। নতুন ড্যাপ অনুযায়ী, সেখানে সর্বোচ্চ ছয়তলার বেশি ভবন নির্মাণ করা যাবে না।
জানতে চাইলে দেশের আবাসন ব্যবসায়ীদের সংগঠন রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (রিহ্যাব) সভাপতি আলমগীর শামসুল আলামিন প্রথম আলোকে বলেন, প্রাথমিকভাবে মনে হচ্ছে, নতুন ড্যাপের কারণে ঢাকার অধিকাংশ এলাকায় আগের চেয়ে কম উচ্চতার ভবন নির্মাণ করতে হবে। জমির দামও কমছে না। ফলে স্বাভাবিকভাবেই ফ্ল্যাটের দাম আরও বাড়বে। তাতে মধ্যবিত্তের পক্ষে ফ্ল্যাট কেনা কঠিন হয়ে যাবে। আবাসন খাতের ব্যবসায় নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। ড্যাপের খসড়া পর্যালোচনা করে আমরা আপত্তি দিয়েছিলাম, তবে তার অনেক কিছুই গ্রহণ করা হয়নি।
ড্যাপ মূলত একটি মহাপরিকল্পনা। ১৯৫৩ সালের ‘টাউন ইমপ্রুভমেন্ট অ্যাক্টে’র আওতায় এই মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়েছে। অন্যদিকে ইমারত নির্মাণ বিধিমালাটি হয়েছে ১৯৫২ সালের ‘বিল্ডিং কনস্ট্রাকশন অ্যাক্ট’ অনুযায়ী। রাজউকের আওতাধীন এলাকায় ভবন নির্মাণ করতে হলে দুই ধরনের অনুমোদন নিতে হয়। প্রথমত, ভূমি ব্যবহারের ছাড়পত্র। দ্বিতীয়ত, নির্মাণ অনুমোদন। ভূমি ব্যবহারের ছাড়পত্র দেওয়া হয় ড্যাপ অনুসরণ করে। অন্যদিকে নির্মাণ অনুমোদন দেওয়া হয় ইমারত নির্মাণ বিধিমালা অনুসারে।
এ বিষয়ে বিল্ডিং ফর ফিউচারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) তানভীরুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘নতুন ড্যাপের কারণে জমির মালিক ও আবাসন ব্যবসায়ী উভয়েই ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। ফ্ল্যাটের দাম বাড়বে সেটি তো পরের বিষয়। ছয় মাস আগে আমি একজন জমির মালিকের সঙ্গে চুক্তি করেছি। সাইনিং মানিও দেওয়া হয়েছে। সেই প্রকল্পের নকশার কাজ বর্তমানে চলমান রয়েছে। নতুন নিয়মের কারণে তো সেই চুক্তি নিয়েই জটিলতা শুরু হয়েছে। এ ধরনের সমস্যা সমাধানে ড্যাপ বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে কিছু সময় দেওয়া দরকার।’
তানভীরুল হক বলেন, ‘নতুন ড্যাপে ব্লকভিত্তিক প্লটে আবাসন প্রকল্পকে উৎসাহ দেওয়াটা ইতিবাচক। তবে আমাদের দেশের মানুষের মানসিকতা সেই পর্যায়ে যায়নি।’ তিনি আরও বলেন, ‘রড-সিমেন্টের দামের চাপই আমরা সামলাতে পারছি না।’
বিদ্যমান ইমারত নির্মাণ বিধিমালায় প্লটের (জমি) পাশে রাস্তার প্রশস্ততা অনুযায়ী এফএআরের মান নির্ধারণ করা হয়। ছয় মিটার চওড়া রাস্তার পাশে আবাসিক বাড়ি ও হোটেল নির্মাণের ক্ষেত্রে এফএআর হবে একধরনের। অন্যদিকে কোনো প্লটের পাশের রাস্তার প্রশস্ততা যদি ১৮ মিটারের বেশি হয়, তাহলে সেই প্লটে যত খুশি তত উঁচু ভবন নির্মাণের সুযোগ ছিল (বাংলাদেশ বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের বিধিনিষেধ মেনে)। নতুন ড্যাপে সেই সুযোগ আর রাখা হয়নি।
জানতে চাইলে আবাসন খাতের প্রতিষ্ঠান ক্রিডেন্স হাউজিং লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক জিল্লুল করিম বলেন, ‘অনেক এলাকায় আগে যে জমিতে সাততলা ভবন করা যেত বর্তমানে সেখানে চারতলা করতে হবে। এ কারণে অধিকাংশ জমির মালিকই আবাসন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তিতে যাবেন না। ফলে নতুন আবাসন প্রকল্প নেওয়ার হার ব্যাপকভাবে কমে যাবে। ফ্ল্যাটের দামও অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাবে। আমাদের মতো ছোট দেশে বহুতল ভবন নির্মাণ ছাড়া আবাসন সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। নাগরিক সুযোগ-সুবিধা না বাড়িয়ে ভবন নির্মাণে বিধিনিষেধ আরোপ করাটা কাজের কথা নয়।’