রাষ্ট্রায়ত্ত ৮ সংস্থা ঋণখেলাপি

  • সবচেয়ে বেশি খেলাপি ঋণ বিজেএমসির, ১৩১ কোটি ৩০ লাখ টাকা।

  • বিটিএমসির ২৪ কোটি ৯০ লাখ, বিএডিসির ২১ কোটি ২৭ লাখ ও বিটিবি ৪ কোটি ৬২ লাখ টাকার ঋণ খেলাপি।

  • বিসিআইসি, বিএসএফআইসি, বিআরটিসি ও টিসিবি মিলে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৬ কোটি টাকা।

শুধু বেসরকারি কোম্পানি নয়, রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলোও এখন ঋণখেলাপিতে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা ২০২৪-এর তথ্য অনুযায়ী, রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর কাছে আটটি রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা এখন ঋণখেলাপি। এসব প্রতিষ্ঠানের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১৮৪ কোটি টাকা।

মোট ৪৯টি রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার মধ্যে যেসব সংস্থা ঋণখেলাপি, সেগুলো হলো বাংলাদেশ পাটকল করপোরেশন (বিজেএমসি), বাংলাদেশ বস্ত্রকল করপোরেশন (বিটিএমসি), বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন (বিএডিসি), বাংলাদেশ টি বোর্ড (বিটিবি), বাংলাদেশ রসায়ন শিল্প সংস্থা (বিসিআইসি), বাংলাদেশ খাদ্য ও চিনি শিল্প করপোরেশন (বিএসএফআইসি), বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন সংস্থা (বিআরটিসি) ও ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি)।

বিজেএমসি, বিটিএমসিসহ এসব সংস্থা ১৮৪ কোটি টাকা ঋণখেলাপি। সব মিলিয়ে ৪৯ সংস্থার কাছে ব্যাংকগুলোর ঋণের স্থিতি ৬৫ হাজার ৮৯ কোটি টাকা।

অর্থনৈতিক সমীক্ষার তথ্য অনুযায়ী, রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি খেলাপি ঋণ বিজেএমসির। সংস্থাটি ১৩১ কোটি ৩০ লাখ টাকার খেলাপি। এর বাইরে বিটিএমসির ২৪ কোটি ৯০ লাখ, বিএডিসির ২১ কোটি ২৭ লাখ ও বিটিবি ৪ কোটি ৬২ লাখ টাকার ঋণ খেলাপি। আর বিসিআইসি, বিএসএফআইসি, বিআরটিসি ও টিসিবি মিলে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৬ কোটি টাকা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত মার্চ শেষে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ বেড়ে রেকর্ড ১ লাখ ৮২ হাজার কোটি টাকায় উন্নীত হয়েছে। এ খেলাপি গ্রাহকেরা মূলত বেসরকারি খাতের। সরকারি সংস্থার খেলাপি ঋণের তথ্য বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষায় প্রতিবছরই তুলে ধরছে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ।

ঋণখেলাপির বিষয়ে জানতে চাইলে বিটিএমসির চেয়ারম্যান ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. জিয়াউল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘এগুলো অনেক পুরোনো ঋণ এবং শ্রমিকদের নেওয়া কিছু ঋণও বিটিএমসির ঘাড়ে এসেছে। আমরা চেষ্টা করছি সুদ বাদ দিয়ে শুধু আসল পরিশোধ করে বিষয়টা নিষ্পত্তি করার। ব্যাংকের সঙ্গে এ ব্যাপারে বৈঠক করা হবে।’

এদিকে যোগাযোগ করলে বাংলাদেশ টি বোর্ডের চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল মো. আশরাফুল ইসলাম গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি নিশ্চিত হয়েই জানাচ্ছি যে বাংলাদেশ টি বোর্ড কখনো ব্যাংকঋণ নেয়নি। ফলে ঋণখেলাপি হওয়ার প্রশ্নই ওঠে না।’

অর্থ বিভাগের অর্থনৈতিক উপদেষ্টা অনুবিভাগের একটি দল সমীক্ষা তৈরির কাজটি করে, যার সমন্বয়ক ছিলেন একজন যুগ্ম সচিব। টি বোর্ডের চেয়ারম্যানের বক্তব্য ওই যুগ্ম সচিবসহ অনুবিভাগটির একাধিক কর্মকর্তাকে জানানো হলে তাঁরা সবাই জানান, তাঁদের এ তথ্য দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

 যেসব ব্যাংকের ঋণ খেলাপি হয়েছে, সেগুলো হলো সোনালী, জনতা, অগ্রণী, রূপালী ও বেসিক। প্রতিবছর এসব ব্যাংক থেকে সংস্থাগুলোর ঋণ বাড়ছে। সমীক্ষার তথ্য অনুযায়ী, গত ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত দেশের ৩০টি সরকারি সংস্থার কাছে ব্যাংকের পাওনা বা ঋণ স্থিতি দাঁড়িয়েছে ৬৫ হাজার ৮৯ কোটি টাকা। এসব সংস্থার কাছে এক বছরে ব্যাংকগুলোর ঋণ বেড়েছে প্রায় সাড়ে ৫ হাজার কোটি টাকা। এক বছর আগেও সংস্থাগুলোর কাছে পুঞ্জীভূত ঋণের পরিমাণ ছিল প্রায় ৫৯ হাজার ৭৩১ কোটি টাকা। আর দুই বছর আগে ছিল ৪৮ হাজার ৩৬২ কোটি টাকা।

চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের মার্চ শেষে রাষ্ট্রায়ত্ত ১২ সংস্থার লোকসান দাঁড়িয়েছে প্রায় সাড়ে ১৯ হাজার কোটি টাকা। লোকসানি সংস্থাও এক বছরে ৮টি থেকে বেড়ে ১২টি হয়েছে। গত অর্থবছরের একই সময় পর্যন্ত আট সংস্থার লোকসান ছিল ১৩ হাজার ৭৪১ কোটি টাকা।

কোন সংস্থার বকেয়া কত

ব্যাংকগুলোর কাছে সবচেয়ে বেশি ঋণ রয়েছে বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের (বিএডিসি)। যার পরিমাণ ১৭ হাজার ৭০৪ কোটি টাকা। এক বছর আগে সংস্থাটির ব্যাংকঋণ ছিল ১৩ হাজার ৮৭৮ কোটি টাকা। সেই হিসাবে এক বছরের ব্যবধানে ঋণ বেড়েছে ৩ হাজার ৬২৭ কোটি টাকা।

রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলোর মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ঋণ বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি), ৯ হাজার ৮৬৩ কোটি টাকা। এক বছরের ব্যবধানে সংস্থাটির ঋণ বেড়েছে ১ হাজার ২৯৪ কোটি টাকা। তৃতীয় সর্বোচ্চ ঋণ রয়েছে বিএসএফআইসির। পরিমাণ ৮ হাজার ৫৯৭ কোটি টাকা।

এ ছাড়া রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলোর মধ্যে বিসিআইসির ঋণে বেড়ে হয়েছে ৮ হাজার ২৬ কোটি টাকা, টিসিবির ৭ হাজার ৪৪৭ কোটি টাকা, বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের ৬ হাজার ৭০২ কোটি টাকা, বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের ৪ হাজার ৪৮৩ কোটি টাকা, বিজেএমসির ৬৭৩ কোটি টাকা, বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের ৫৬২ কোটি টাকা এবং বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন করপোরেশনের ঋণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৩৩ কোটি টাকা।

এর বাইরেও ব্যাংকগুলোর কাছে দেনা রয়েছে কয়েকটি সংস্থার। এর মধ্যে বাংলাদেশ ইস্পাত ও প্রকৌশল করপোরেশনের ঋণ ২২৬ কোটি টাকা, পেট্রোবাংলার ১২৮ কোটি টাকা, বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের ১২১ কোটি টাকা এবং চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের ১১০ কোটি টাকা ঋণ রয়েছে ব্যাংকগুলোর কাছে।

সূত্রগুলো জানায়, দেনা পরিশোধে এসব রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার যেমন তাগিদ নেই, তেমনি ঋণ আদায়ের ব্যাপারে ব্যাংকগুলোরও তেমন তাগিদ নেই। অগ্রণী ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ শামস্‌–উল–ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, কিছু সংস্থার কাছে অনেক বছর আগের পাওনা আটকে আছে। বহু চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু সংস্থাগুলো দেয় না। মামলাও আছে। নিষ্পত্তি না হওয়ায় টাকা পাওয়া যাচ্ছে না।

অনুদান বাড়ছে, লভ্যাংশ কমছে

সমীক্ষার তথ্য অনুযায়ী, লোকসানিগুলো বাদ দিয়ে ৪৯টি সংস্থার বাকিরা চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের এপ্রিল পর্যন্ত রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা দিয়েছে ১ হাজার ৩৭ কোটি টাকা। এর আগে ২০২২-২৩ অর্থবছরে তারা ১ হাজার ৯৩৪ কোটি (সাময়িক হিসাব), ২০২১-২২ অর্থবছরে ৮৮০ কোটি এবং ২০২০-২১ অর্থবছরে ১ হাজার ২৭৯ কোটি টাকার লভ্যাংশ জমা দিয়েছিল। যদিও সংস্থাগুলোর প্রতি সরকারের ভর্তুকি ও অনুদান বাড়ছে। এপ্রিল পর্যন্ত ১০ মাসে সংস্থাগুলো সরকার থেকে ১ হাজার ৫০৮ কোটি টাকা অনুদান পেয়েছে। আগের পুরো অর্থবছরে তারা পেয়েছিল ১ হাজার ৪৭৫ কোটি টাকা। তার আগের অর্থবছরে অনুদান পেয়েছিল ১ হাজার ৪০৭ কোটি টাকা।