দেশের চলমান অর্থনৈতিক সংকটে বড়দের ঋণ কমিয়ে দেওয়ার পাশাপাশি নীতি সুদহার বাড়িয়ে বাজার থেকে টাকা তুলে নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর আতিউর রহমান। পাশাপাশি মূল্যস্ফীতি কমাতে ‘সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি ও রাজস্ব নীতি’ গ্রহণ এবং খরচ কমাতে সরকারকে পরামর্শ দিয়েছেন তিনি।

দেশের অর্থনীতির চলমান সংকট সমাধানে অর্থনীতিবিদ ও আর্থিক খাতের বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে পরামর্শ নিচ্ছে সরকার। এ জন্য ধাপে ধাপে অর্থনীতিবিদ ও আর্থিক খাতের বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে বৈঠক করছেন সরকারের প্রতিনিধিরা। তারই অংশ হিসেবে গতকাল বুধবার বিকেলে আলোচনার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকে যান সাবেক গভর্নর আতিউর রহমান ও সাবেক অর্থসচিব মোহাম্মদ তারেক।

সেখানে আতিউর রহমান নীতি সুদহার বাড়ানোসহ বেশকিছু পরামর্শ দেন বলে জানা গেছে। আতিউর রহমানের পাশাপাশি মোহাম্মদ তারেকও সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি ও রাজস্ব নীতি প্রনয়ণের ওপর জোর দেন।

সরকারের পক্ষে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার, অর্থসচিব মো. খায়েরুজ্জামান মজুমদার, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব শেখ মোহাম্মদ সলীম উল্লাহসহ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের চার ডেপুটি গভর্নর বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে অর্থনীতির নানা সূচক, নীতি উদ্যোগ ও তার প্রভাব নিয়ে একটি উপস্থাপনা দেন প্রধান অর্থনীতিবিদ হাবিবুর রহমান। সংকট কাটাতে সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক যেসব উদ্যোগ নিয়েছে, উপস্থাপনায় সেগুলো তুলে ধরা হয়।

বৈঠক সূত্রে জানা গেছে, অর্থনীতির এ কঠিন সময়ে বড় বড় ব্যবসায়ীর ঋণ কমিয়ে দিয়ে ছোট ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের বেশি ঋণ দেওয়ার পরামর্শ দেন আতিউর রহমান। বিশেষ করে কৃষি ও এসএমই (ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগ) খাতে ঋণ বাড়ানোর পরামর্শ দেন তিনি। বৈঠকে তিনি বলেন, বড় ব্যবসায়ীরা ঋণ নেওয়ার ক্ষেত্রে যত বেশি আগ্রহ দেখান, ঋণ ফেরত দেওয়ার ক্ষেত্রে তারা তত বেশি আগ্রহী হন না। বিপরীতে ছোট ও মাঝারি উদ্যোক্তারা ঋণ নিলে সেই ঋণ ফেরত দেন। চলমান এ সংকটে তাই বড়দের ঋণ কিছুটা কমিয়ে দিলে তাতে খুব বেশি সমস্যা হবে না। ছোট ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের ঋণ দিতে যাতে ব্যাংকগুলো বেশি আগ্রহী হয়, সে জন্য ক্রেডিট গ্যারান্টি স্কিম বা ঋণ নিশ্চয়তা কর্মসূচি দ্রুত চালুর জন্যও সরকারকে তিনি পরামর্শ দেন বলে জানা যায়।

বৈঠক শেষে যোগাযোগ করা হলে আতিউর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘এ মুহূর্তে অর্থনীতিতে যে চাপ তৈরি হয়েছে, তা মোকাবিলায় সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি ও রাজস্ব নীতি গ্রহণের পরামর্শ দিয়েছি আমি। মূল্যস্ফীতির লাগাম টানতে হলে এ মুহূর্তে এ ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণের বিকল্প নেই। আমি বলেছি, এ মুহূর্তে প্রবৃদ্ধির চেয়ে অর্থনীতির স্থিতিশীলতা বড় বিষয়। তাই সরকারের খরচ উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমিয়ে ফেলার পরামর্শ দিয়েছি। খুব জরুরি প্রকল্প ছাড়া অন্যান্য প্রকল্প ব্যয় এ সময় না করলে তাতে কিছুটা হলেও সাশ্রয় হবে বৈদেশিক মুদ্রার।’

আতিউর রহমান আরও বলেন, ‘সার্বিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতার স্বার্থে নিত্য ব্যবহার্য পণ্য ও জ্বালানি আমদানিতে সতর্কতার সঙ্গে ডলারের জোগান দিয়ে যেতে হবে। পাশাপাশি আগামীতে অর্থনৈতিক সংস্কারের প্রতি জোর দেওয়া ও খেলাপি ঋণের চাপ থেকে অর্থনীতিকে ভারমুক্ত করার পরামর্শ দিয়েছি।’

দেশের চলমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে সরকারের পক্ষ থেকে অর্থনীতিবিদ ও আর্থিক খাতের বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নেওয়া শুরু হয় গত ২১ সেপ্টেম্বর। প্রথম দিন সরকারের প্রতিনিধিরা বাংলাদেশ ব্যাংকে বৈঠক করেন অর্থনীতিবিদ ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদের সঙ্গে।

এরপর গত ২৭ সেপ্টেম্বর বৈঠক করেন বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্স ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) ভাইস চেয়ারম্যান সাদিক আহমেদ ও নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুরের সঙ্গে।

অর্থনীতিবিদ ও আর্থিক খাতের বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নিতে সরকারের পক্ষ থেকে এমন সময়ে এসব বৈঠকের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, যখন দেশের অর্থনীতি বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের মধ্যে পড়েছে। আগস্ট মাসে খাদ্যে মূল্যস্ফীতি সাড়ে ১২ শতাংশ ছাড়িয়ে যাওয়ার পর সেপ্টেম্বর মাসেও তা ১২ শতাংশের ওপরে রয়ে গেছে। দেড় বছর ধরে চলা ডলার-সংকটের কারণে ব্যবসা-বাণিজ্য বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। বাড়ছে খেলাপি ঋণও। আবার শরিয়াহভিত্তিক কিছু ব্যাংকে চলছে তারল্যসংকট।

 গতকালের বৈঠক সূত্রে জানা যায়, আগামী নির্বাচনের আগে ও পরের সামগ্রিক বিষয় মাথায় রেখে এ সময়ে সমন্বিত নীতি গ্রহণের পরামর্শ দেন সাবেক গভর্নর ও সাবেক অর্থসচিব। এ মুহূর্তে তাই সরকারের খরচ কমানোর পরামর্শ দেন দুজনই।

বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র মেজবাউল হক প্রথম আলোকে বলেন, মূল্যস্ফীতি এখন প্রধান চ্যালেঞ্জ। তাঁরা এটা নিয়ন্ত্রণে নানা পরামর্শ দিয়েছেন। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে ইতিমধ্যে নীতি সুদহার বাড়ানো হয়েছে।