এলডিসি থেকে উত্তরণের শেষ ধাপেও পাস, তবে চ্যালেঞ্জ ৪টি 

২০২৪ সালের মূল্যায়নেও তিন সূচকেই উত্তীর্ণ বাংলাদেশ। তবে জাতিসংঘ মনে করে যে বাংলাদেশের সামনে চারটি চ্যালেঞ্জ রয়েছে।

স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে উত্তরণের সর্বশেষ মূল্যায়নেও বাংলাদেশ বেশ ভালোভাবে পাস করেছে। জাতিসংঘের ২০২৪ সালের ত্রিবার্ষিক মূল্যায়নে মাথাপিছু আয়, মানবসম্পদ, জলবায়ু ও অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা—এই তিন সূচকেই বাংলাদেশ উত্তীর্ণ হয়েছে। এলডিসি থেকে উত্তরণ হয়েছে কিংবা হওয়ার পথে রয়েছে এমন দেশগুলোর মধ্যে একমাত্র বাংলাদেশই টানা তিনটি মূল্যায়নে সব সূচকে পাস করেছে। গত ফেব্রুয়ারি মাসে জাতিসংঘের কমিটি ফর ডেভেলপমেন্ট পলিসির (সিডিপি) ত্রিবার্ষিক প্রতিবেদনে এভাবেই বাংলাদেশের সম্ভাবনা তুলে ধরা হয়েছে। 

সিডিপি মনে করে, বাংলাদেশসহ যে ছয়টি দেশ এলডিসি থেকে উত্তরণের পথে রয়েছে, তাদের সবার সামনেই চারটি চ্যালেঞ্জ রয়েছে। চ্যালেঞ্জগুলো হলো বৈশ্বিক সংকট; ভূরাজনৈতিক উত্তেজনা; জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি; বিদেশি সহযোগিতা বাড়ানো।

যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে জাতিসংঘের সদর দপ্তরে গত ৪ থেকে ৮ মার্চ সিডিপির পর্যালোচনা বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সিডিপির চেয়ার সাকিকো ফুকুদাপারের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত ওই বৈঠকে বলা হয়, এলডিসি থেকে উত্তরণের পথে থাকা ছয়টি দেশই টেকসইভাবেই এগিয়ে যাচ্ছে। দেশগুলো হচ্ছে বাংলাদেশ, অ্যাঙ্গোলা, লাওস, নেপাল, সাও তোমে অ্যান্ড প্রিন্সেপ ও সোলোমন দ্বীপপুঞ্জ।

জাতিসংঘের ওয়েবসাইট সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশের এলডিসি থেকে উত্তরণের তারিখও ঠিক করা হয়েছে। সবকিছু ঠিক থাকলে ২০২৬ সালের ২৪ নভেম্বর এলডিসি থেকে বাংলাদেশের উত্তরণ ঘটবে।

২০২১ সালে সিডিপি যখন এলডিসি থেকে উত্তরণের জন্য বাংলাদেশের নাম চূড়ান্তভাবে সুপারিশ করে, তখন বলা হয়েছিল যে ২০২৪ সালেও বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিস্থিতি মূল্যায়ন করা হবে। গত ফেব্রুয়ারিতে সেই মূল্যায়ন হয়।

তিন সূচকেই পাস

এলডিসি থেকে কোনো দেশের বের হওয়ার বিষয়ে সুপারিশ করে সিডিপি। প্রতি তিন বছর পর এলডিসিগুলোর মূল্যায়ন করা হয়। কোনো দেশ স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে বের হতে পারবে কি না, সে যোগ্যতা নির্ধারণ করা হয় মাথাপিছু আয়, মানবসম্পদ, জলবায়ু ও অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা—এই তিন সূচকের ভিত্তিতে। এ ক্ষেত্রে যেকোনো দুটি সূচকে যোগ্যতা অর্জন করতে হয় কিংবা মাথাপিছু আয় নির্দিষ্ট সীমার দ্বিগুণ করতে হয়। সিডিপির সর্বশেষ ২০২৪ সালের মূল্যায়নে দেখা যায় যে বাংলাদেশ সব সূচকেই উত্তীর্ণ হয়েছে। যেমন বাংলাদেশের জনগণের মাথাপিছু আয় এখন ২ হাজার ৬৮৪ ডলার। মাথাপিছু আয় সূচকে মাথাপিছু আয় কমপক্ষে ১ হাজার ৩০৬ ডলার হতে হয়। মানবসম্পদ সূচকে ৬৬ পয়েন্টের ওপরে থাকতে হয়, যা বাংলাদেশের আছে সাড়ে ৭৭ পয়েন্ট। এ ছাড়া অর্থনৈতিক ও পরিবেশের ভঙ্গুরতা সূচকে একটি দেশের ৩২ পয়েন্টের নিচে থাকতে হয়। এটি বাংলাদেশের ২১ দশমিক ৯ পয়েন্ট।

এর আগে ২০১৮ ও ২০২১ সালেও সব কটি সূচকে বাংলাদেশ উত্তীর্ণ হয়েছিল। পরপর দুটি ত্রিবার্ষিক মূল্যায়নে নির্দিষ্ট মান অর্জন করলেই এলডিসি থেকে বের হওয়ার বিষয়ে চূড়ান্ত সুপারিশ করে সিডিপি। সিডিপির সুপারিশগুলো চলতি ২০২৪ সালে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য ওঠার কথা ছিল। কিন্তু করোনার কারণে বাংলাদেশ বাড়তি আরও দুই বছর সময় পেয়েছে। সবকিছু ঠিক থাকলে ২০২৬ সালে এলডিসি থেকে বের হবে বাংলাদেশ।

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়া নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান প্রথম আলোকে বলেন, বাংলাদেশের এলডিসি থেকে উত্তরণ অবধারিত। জাতিসংঘের মূল্যায়নে বাংলাদেশ সূচকগুলোয় উত্তীর্ণ হয়েছে। কিন্তু এই মুহূর্তে সামষ্টিক অর্থনীতি চাপে আছে। উচ্চ মূল্যস্ফীতিতে বিশাল জনগোষ্ঠী খাদ্যনিরাপত্তার ঝুঁকিতে আছে। এসব বিষয় জাতিসংঘের পর্যালোচনায় বিস্তারিত উঠে আসেনি।

বাংলাদেশের যত চ্যালেঞ্জ 

এলডিসি থেকে বের হলে সবচেয়ে সমস্যায় পড়বে রপ্তানি খাত। কারণ, এলডিসি হিসেবে বাংলাদেশ বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) আওতায় শুল্কমুক্ত বাণিজ্যসুবিধা পায়। ইউরোপীয় ইউনিয়নেও আঞ্চলিক বা দ্বিপক্ষীয় ভিত্তিতে (যেমন ভারত, চীন) এ ধরনের শুল্কসুবিধা মিলছে। বিদ্যমান নিয়ম অনুযায়ী ২০২৬ সালে এসব সুবিধা বন্ধ হয়ে যাবে। যদিও ইউরোপীয় ইউনিয়নে জিএসপির আওতায় শুল্কসুবিধা ২০২৯ সাল পর্যন্ত থাকবে।

এলডিসি তালিকা থেকে বের হলে বাংলাদেশের পাওয়া কিছু বাণিজ্য ও অন্যান্য সুবিধা স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাতিল হয়ে যাবে। সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশের পণ্যের ওপর নিয়মিত হারে শুল্ক বসবে। ডব্লিউটিওর এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাড়তি শুল্কের কারণে বাংলাদেশের রপ্তানি বছরে ৫৩৭ কোটি ডলার বা সাড়ে ৪৫ হাজার কোটি টাকা কমতে পারে।