মূল্যস্ফীতির কিঞ্চিৎ নিম্নগতি ও ‘ফকিরের কেরামতি’

সামান্য কমেছে মূল্যস্ফীতি। অথচ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিলে আরও কমত। তাতে স্বস্তি পেত সাধারণ মানুষ।

বাজারে নিত্যপণ্যের দাম বাড়তে থাকায় দিন দিন বাড়ছে ওএমএসের পণ্য কিনতে আসা মানুষের সংখ্যা। এ পণ্যের অপেক্ষায় দীর্ঘ সময় দাঁড়িয়ে থাকতে হয় সারিতে। গত রোববার রাজধানীর মিরপুর-২–এছবি: খালেদ সরকার

গ্রামে একটা প্রবাদ আছে, ‘ঝড়ে বক মরে, ফকিরের কেরামতি বাড়ে।’ সম্প্রতি মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমে আসার পর বাংলাদেশের নীতিনির্ধারকদেরও আত্মতুষ্টির ভাব জাগরিত হয়েছে—এ যেন তাদেরই সঠিক নীতিমালার ফল। কিন্তু এর পেছনে আছে অনুকূল বিশ্ববাজার—পণ্য ও জ্বালানির মূল্যহ্রাস। এখানে যে তাদের কোনো কৃতিত্ব বরং উল্টোমুখী, তা বলতে গেলেই অর্থনীতিবিদেরা অপ্রিয় হয়ে যান। সরকারের নীতি জড়তা, অর্থ মন্ত্রণালয়ের নব নব তত্ত্ব উৎপাদন এবং বাংলাদেশ ব্যাংককে ঠিকভাবে কাজ করতে না দেওয়ার কারণে মূল্যস্ফীতির পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে। তা না হলে মূল্যস্ফীতি ৬-এর অঙ্কে নেমে আসত। ভোক্তাশ্রেণি দামের আগুনে ছটফট করত না। নতুন উদ্যমে বাড়ত প্রবৃদ্ধি।

পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান সম্প্রতি মূল্যস্ফীতি আগামী কয়েক মাসে কমতেই থাকবে, এমন কথা শুনিয়ে দামদগ্ধ মধ্যবিত্তকে কিছুটা মানসিক শান্তি দিয়েছেন। তিনি সজ্জন ব্যক্তি। মধ্যবিত্তের জন্য তাঁর মমতা আছে বলেই মনে হয়। তিনিই স্বীকার করেছেন যে দাম যেভাবে বেড়েছে, মানুষের আয় সেভাবে বাড়েনি। অন্য মন্ত্রীদের মতো ‘বেহেশত হাইপোথিসিস’ বা ‘ব্যাংক ভালো আছে’—এমন মজাদার তত্ত্ব দেওয়ার রেকর্ড পরিকল্পনামন্ত্রীর নেই। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো বা বিবিএসের তথ্য উল্লেখ করে তিনি বলেছেন মূল্যস্ফীতি গত আগস্টে ছিল ৯ দশমিক ৫২ শতাংশ। তা প্রতি মাসে কমতে কমতে নভেম্বরে ৮ দশমিক ৮৫ শতাংশে নেমেছে। এটা আসলে সাড়ে ৯ ভাগ থেকে চার মাস পর ৯ ভাগে নামার কাহিনি, যা অর্থমিতির ভাষায় ‘পরিসংখ্যানগতভাবে তাৎপর্যপূর্ণ’ নয়। তারপরও পরিকল্পনামন্ত্রীকে ধন্যবাদ, তিনি একটা প্রবণতারেখা টেনে সরকারের কিছুটা কৃতিত্ব দাবি করেছেন কিছুটা অঙ্ক দিয়ে।

সামান্য নিম্নগতি যে কারণে

আসলে এই তাৎপর্যহীন অদৃশ্যমান মূল্যক্ষয়ের পেছনে সরকারের বা বাংলাদেশ ব্যাংকের কোনো দৃশ্যমান ভূমিকা ছিল না। বিশ্ববাজারের তেল ও পণ্যমূল্যের অধোগতিই মূলত বাংলাদেশের মূল্যস্ফীতির কিঞ্চিৎ দমন সম্ভব করেছে, এটা বলে কোনো মন্ত্রীই আত্মপ্রশংসার কোথাও ঘাটতি হতে দেবেন না। অর্থ মন্ত্রণালয়ের স্ব–উৎপাদিত নীতি বিপ্লব ও হাত-পাবাঁধা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতি অক্ষমতা না থাকলে এ দেশের মূল্যস্ফীতি এখন বিবিএসের হিসাবেই ৬-৭ শতাংশের মধ্যেই থাকত। এ রকম হার এখন ভারতে চলছে। কারণ, ওরা মে মাস থেকে এ পর্যন্ত পাঁচবার নীতি সুদহার বাড়িয়েছে। এটি ব্যবসায়ী মহলের চরম অপছন্দ ও প্রতিরোধের বিষয় ছিল। সবকিছু উপেক্ষা করেই ভারতের কেন্দ্রীয় ব্যাংক-রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়ার (আরবিআই) গভর্নর শক্তিকান্ত দাস তাঁর নীতিশক্তি প্রমাণ করেছেন এবং ভারতকে মূল্যস্ফীতির আগুন থেকে রক্ষা করেছেন।

* ক্ষতি হলো মানুষের। সঞ্চয় কমে গেল। মূল্যস্ফীতির সঙ্গে সঙ্গে আমানতের হার বাড়েনি বলে টাকা তুলে নিয়ে পণ্য, সোনা, ডলার বা মূল্যবান সামগ্রী কিনে রাখাকেই অনেকে যৌক্তিক মনে করলেন। * উচিত ছিল অর্থ সংকোচনের প্রয়োজনে খেলাপি ঋণ আদায় বাড়ানো। তা না করে দায়িত্ব নেওয়ার কয়েক দিনের মাথায় খেলাপিদের আরও বড় ছাড় দিলেন। এটিই ছিল গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদারের বড় ভুল।

ব্যবসায়ীদের চাপে গভর্নর শক্তিকান্ত দাসকে ক্লান্ত করা যায়নি। তাঁকে খেদানো হয়নি। কারণ, তিনি কেন্দ্রীয় ব্যাংকিংয়ের পাঠ্যবই অনুযায়ী কাজ করেছেন। সুদের হার বাড়িয়েছেন। তাতে বাজারে ঋণ সুদহার বেড়েছে। ওদের ঋণ সুদহারে কোনো টুপি পরানো ছিল না। ব্যক্তিঋণের ঊর্ধ্বগমন নিয়ন্ত্রিত হয়েছে ও শেষতক মূল্যস্ফীতির পাগলা ঘোড়ার লাগামে টান পড়েছে। ঠিক যেমনটি করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ব্যবস্থা ফেড-এর চেয়ারম্যান জেরোমি পাওয়েল কিংবা ব্যাংক অব ইংল্যান্ডের গভর্নর অ্যান্ড্রু বেইলি। ব্যতিক্রম শুধু বাংলাদেশ। এখানে বাজেটে মূল্যস্ফীতি দমনকে ১ নম্বর কর্মসূচি হিসেবে বলা হলেও তা কেতাবি ঘোষণাই থেকে গেছে। কোনো উল্লেখযোগ্য কার্যকর পদক্ষেপ রাজস্বকাঠামোতে ছিল না। ধনিকের আয়কর বাড়েনি। বরং কালোটাকা বা পাচার করা অর্থকে একধরনের প্রণোদনা দেওয়া হয়েছে।

অথচ খেলাপিদের আরও ছাড়

ওদিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে হাত-পা বেঁধে সাঁতার দিতে বলা হয়েছে। উচিত ছিল অর্থ সংকোচনের প্রয়োজনে খেলাপি ঋণ আদায় বাড়ানো। তা না করে গভর্নর দায়িত্ব নেওয়ার কয়েক দিনের মাথায় খেলাপিদের আরও বড় ছাড় দিলেন। এটিই ছিল গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদারের সবচেয়ে বড় ভুল। তাঁর গৃহীত অন্য সব পদক্ষেপই ইতিবাচক ও অর্থনীতিজ্ঞানের প্রতিফলক। ব্যাংক লুণ্ঠনের স্বস্তিপ্রদায়ক কাজটি তিনি অর্থ মন্ত্রণালয়ের বাসনা বাস্তবায়নেই হয়তো করেছেন বা করতে বাধ্য হয়েছেন। কিন্তু দায় তাঁর কাঁধেই থেকে গেল। এ জন্য অর্থমন্ত্রী এখন আর ব্যাংক খাতের দুর্বলতা চোখে দেখতে পান না। পেলেও রাতারাতি সংজ্ঞা বদলে খেলাপিকে ‘পরিশ্রমী ঋণগ্রহীতা’ বানিয়ে ফেলতে কতক্ষণ। সংজ্ঞা পাল্টেও ব্যাংক খাতের দুর্বলতা ঢাকা যাচ্ছে না। থলের বিড়ালবৃন্দ একে একে বের হচ্ছেন। খেলাপিবৃন্দকে স্বস্তিদানের কর্মটি যে রাষ্ট্রীয় কল্যাণবিরোধী কাজ, সে কথা হাইকোর্টকে বলে দিতে হলো। একটা কেন্দ্রীয় ব্যাংককে যদি ঘন ঘন হাইকোর্ট সতর্ক করে, তাহলে তা ভালো লক্ষণ নয়।

প্রয়োজন সুদহার বাড়ানো

মূল্যস্ফীতির নিয়ন্ত্রণে প্রয়োজন ছিল ঋণ সুদহারের মাথায় ছাদ ভেঙে ওকে নীতি সুদহার দিয়ে ঠেলে ওপরে তোলা এবং ব্যক্তিঋণের প্রবাহকে কমিয়ে ফেলা বা বাড়তে না দেওয়া। মুদ্রানীতির এই প্রথম পাঠ কাজে লাগতে দেওয়া হয়নি। কেন্দ্রীয় ব্যাংক নীতি সুদহার যৎসামান্য বাড়িয়েছে। কিন্তু ঋণ সুদহারের মাথায় ছাদ থাকায় ওটা বাড়েনি বলে মুদ্রানীতির সামান্য কমানো বা ‘টাইটেনিং’ অভিনয়ের পর্যায়েই থেকে গেছে। প্রকৃত সুদহার অর্থাৎ বাজার সুদহার বিয়োগ মূল্যস্ফীতি—চলে গেছে শূন্যের কোঠায়। ফিশারের এই সমীকরণ অনুযায়ী ‘চিপ মানি’ বা সস্তা টাকার সুযোগ নিয়ে ব্যক্তিঋণ বেড়ে গিয়ে মূল্যস্ফীতির আগুনে আরও ঘি ঢেলে দিয়েছে। ফেব্রুয়ারিতে ব্যক্তিঋণের ১১ শতাংশ প্রবৃদ্ধি সেপ্টেম্বরে ১৪ শতাংশে পৌঁছে গেছে।

ঋণ সুদহারের ছাদ যদি পুতিনের ইউক্রেন আক্রমণের পরপরই ভেঙে দেওয়া হতো এবং বাংলাদেশ ব্যাংক যদি যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য বা পাশের দেশ ভারতের মতো নীতি সুদহার দফায় দফায় বাড়িয়ে যেত, তাহলে বাংলাদেশে আজ মূল্যস্ফীতি ৬-৭ শতাংশের মধ্যে থাকতে পারত। তাহলে মন্ত্রীরা নীতি কেরামতির কৃতিত্ব দাবি করতে পারতেন। পরিকল্পনামন্ত্রী গত আগস্ট থেকে মূল্যস্ফীতির যে পিপীলিকা গতির অবদমন ঘটেছে, তা দেখিয়েছেন। এটি আসলে মাত্র ৭ শতাংশ পতন। অর্থাৎ আগস্টের মূল্যসূচককে ১০০ ধরলে বর্তমানে তা ৯৩–এ এসেছে। কিন্তু এ সময় বিশ্ববাজারে পণ্যের দামসূচক কমেছে ৩০ শতাংশ, তেলের দাম কমেছে ৩৩ শতাংশ এবং গ্যাসের দাম পড়েছে ৫৮ শতাংশ। পুতিনের যুদ্ধও এদের পতন থামাতে পারছে না। বাংলাদেশ এগুলোর সুফল পুরোপুরি ভোগ করতে পারেনি শুধু পদক্ষেপ–জড়তা বা ক্ষেত্রবিশেষে নীতি গোঁয়ার্তুমির কারণে, যা মূল্যস্ফীতিকে নামতে দেয়নি।

এই তো সেদিন অর্থমন্ত্রী ৯ শতাংশের টুপিকে ‘যৌক্তিক’ বানানোর কসরত হিসেবে বিনিয়োগ বৃদ্ধির অকালগীতি পরিবেশনা করেছেন। অবশ্য গভর্নর সেই সংগীতে সুর মেলাননি। বুঝতে পারছিলেন যে দামাগ্নির এই যুগে এ বড় বেসুরো বিলাপ। সম্প্রতি গভর্নর ঋণ সুদহারের ছাদ ভাঙার ঘোষণা দিয়েছেন। বড় দেরি হয়ে গেল। তারপরও গভর্নরকে ধন্যবাদ। তিনি বাজারকে একটা সংকেত দিলেন যে ঋণ সুদহারের নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বটি তার ব্যাংকের—অর্থ মন্ত্রণালয়ের নয়।

যেভাবে মানুষের ক্ষতি

ক্ষতি হলো মানুষের। সঞ্চয় কমে গেল। মূল্যস্ফীতির সঙ্গে সঙ্গে আমানতের হার বাড়েনি বলে টাকা তুলে নিয়ে পণ্য, সোনা, ডলার বা মূল্যবান সামগ্রী কিনে রাখাকেই অনেকে যৌক্তিক মনে করলেন। ‘চিপ মানি’ বা সস্তা অর্থের বদৌলতে খেলাপিরা তহবিল লুটে নেওয়ায় একটা আতঙ্ক সৃষ্টি হলো। সরকারি হিসাবমতেই ব্যাংক থেকে চলে গেল প্রায় লাখ কোটি টাকা। সময়মতো অর্থনীতির সুস্থ জ্ঞানে পদক্ষেপ নিলে এগুলোর কিছুই হতো না। একবার বাজার অগ্রাহ্যকারী বিনিময় হার বানিয়ে রেখে করা হলো ডলার–সংকট। এর পাশাপাশি বাজারকে উপেক্ষা করে ঋণ সুদহারকে বন্দী করা হলো। বাড়ল তহবিল গ্রাস ও মূল্যস্ফীতি। এর কোনোটির ফল কি ভালো হয়েছে? কেন্দ্রীয় ব্যাংককে অর্থ মন্ত্রণালয়ের খপ্পর থেকে উদ্ধার করে এ প্রতিষ্ঠানকে জ্ঞান ও গবেষণার ভিত্তিতে কাজ করতে না দিলে ভবিষ্যতে সংকট আরও বাড়বে।

● ড. বিরূপাক্ষ পাল যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ইউনিভার্সিটি অব নিউইয়র্ক অ্যাট কোর্টল্যান্ড-এ অর্থনীতির অধ্যাপক ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ।