করব্যবস্থার ডিজিটালাইজেশনে রাজনৈতিক সদিচ্ছা দরকার

রাজধানীর লেকশোর হোটেলে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) এক সংলাপের আয়োজন করে। আজ রোববারছবি: সংগৃহীত

যাঁরা কর দিচ্ছেন, তাঁদের জন্য ন্যায্যতা নিশ্চিত করা দরকার। করব্যবস্থার ডিজিটালাইজেশনের মাধ্যমে এই ন্যায্যতা নিশ্চিত করা সম্ভব এবং এই ডিজিটালাইজেশন নিশ্চিত করতে রাজনৈতিক সদিচ্ছা দরকার। একই সঙ্গে রাজস্বের অর্থ কোন কাজে ব্যয় করা হচ্ছে, সে বিষয়ে স্বচ্ছতা না থাকলে মানুষ কর দিতে আগ্রহ পাবে না। ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) আয়োজিত এক সংলাপে অংশগ্রহণকারীরা এ কথা বলেন।

বক্তারা মনে করেন, দেশের সব শ্রেণির মানুষের মধ্যে করছাড় পাওয়ার মানসিকতা আছে। তাঁরা বলেন, ব্যবসায়ীদের অনেকে প্রায়ই অভিযোগ করেন যে রাজস্ব বোর্ডের যন্ত্রণায় ব্যবসা করা যায় না। কাঁচামালের বাড়তি দাম, পরিবহনের জন্য অতিরিক্ত খরচ, জ্বালানির জন্য বাড়তি ব্যয়—সবই তাঁরা মানতে রাজি। কিন্তু সরকারকে ঠিকমতো রাজস্ব দেওয়ার ক্ষেত্রে তাঁদের অনেকেরই অনীহা।

রাজধানীর লেকশোর হোটেলে আজ রোববার বিকেলে এ সংলাপ অনুষ্ঠিত হয়। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন। মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন অর্থ প্রতিমন্ত্রী ওয়াসিকা আয়শা খান।

মূল প্রবন্ধে মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, দেশের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি ঋণনির্ভর হয়ে যাচ্ছে। এখন যে ঋণ নেওয়া হচ্ছে, তার সুদহার অনেক বেশি। সরকারের সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় লক্ষ্যমাত্রা ছিল, ২০২০ সালের মধ্যে কর-জিডিপির অনুপাত ২০ শতাংশে উন্নীত করা হবে। সেটা হলে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির জন্য ঋণ নেওয়ার প্রয়োজন হতো না। গত কয়েক বছরে দেশে কর-জিডিপির অনুপাত উল্টো কমেছে।

প্রধান অতিথির বক্তব্যে অর্থ প্রতিমন্ত্রী বলেন, রাজস্ব আদায় বৃদ্ধিতে আমাদের রাজনৈতিক সদিচ্ছা আছে, তা না হলে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যানের সঙ্গে আমি এতক্ষণ এখানে বসে থাকতাম না। তিনি আরও বলেন, নতুন সরকারের প্রথম বাজেট এটি। সেই হিসাবে নির্বাচনী ইশতেহার বাস্তবায়নেরও প্রথম বাজেট। সরকার বিভিন্নভাবে প্রয়োজনীয় সম্পদ আহরণের চেষ্টা করছে।

অনুষ্ঠানের অতিথি ছিলেন জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম। তিনি বলেন, দেশে করজাল বাড়ানো যাচ্ছে না। তবে গত চার বছরে দেশে রিটার্ন জমা দেওয়া মানুষের সংখ্যা দ্বিগুণ হয়েছে। ২০১৯-২০ অর্থবছরে এ সংখ্যা ছিল ২০ লাখের মতো; এ বছর এখন পর্যন্ত ৪১ লাখ মানুষ রিটার্ন দিয়েছেন। যদিও টিআইএনধারী আছেন এক কোটির বেশি।

এনবিআর চেয়ারম্যান বলেন, মানুষকেও সচেতন হতে হবে। যেসব দোকানে ভ্যাট সংগ্রহের যন্ত্র স্থাপন করা হয়েছে, সেখানে গিয়ে এনবিআরের পক্ষে পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব নয়। সে জন্য ভ্যাট দেওয়ার ক্ষেত্রে মানুষকে সচেতন হওয়ার আহ্বান জানান তিনি।

আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম অভিযোগ করে বলেন, প্রতিবছর বাজেট এলেই এনবিআরকে রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা দেওয়া হয়। তা আদায়ের বাস্তবতা আছে কি না, সেটা দেখা হয় না। এনবিআরকে সারা বছর রাজস্ব আদায় নিয়ে ব্যস্ত থাকতে হয়। সে জন্য কর আহরণে অভিনবত্ব আনা সম্ভব হয় না।

রাজস্ব আহরণ ও ব্যয়ের বিষয়ে ন্যায্যতা নিশ্চিত করা দরকার বলে মত দেন সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। তিনি মনে করেন, সরকারি ব্যয়ের গুণমান রক্ষা করা গেলে এবং তার স্বচ্ছতা থাকলে মানুষ কর দিতে আগ্রহী হবে। অর্থাৎ শুধু কর আহরণে দৃষ্টি না দিয়ে করদাতাদের সেবা দেওয়ার দিকেও নজর দেওয়া দরকার। তিনি বলেন, বিষয়টি রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক।

এ ছাড়া কর আহরণ বৃদ্ধির জন্য করদাতা ও কর সংগ্রাহকদের মধ্যে অন্তর্বর্তী স্তর যত কমানো যাবে, ততই এই প্রক্রিয়া মসৃণ হবে বলে মত দেন দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য।

অনুষ্ঠানে এনবিআরের সাবেক দুজন চেয়ারম্যান ও সাবেক একজন সদস্য উপস্থিত ছিলেন। তাঁরা বলেন, এনবিআরের ডিজিটালাইজেশনের পরিকল্পনা আজকের নয়। সেই ১৯৯০ সাল থেকে এখন পর্যন্ত প্রায় ২৫টি প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। কিন্তু যথাযথ পরিকল্পনার অভাব ও রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাবে তা বাস্তবায়িত হচ্ছে না। প্রযুক্তিগত পরিবর্তন আনার জন্য কিছু মানুষকে দীর্ঘদিন কাজ করার সুযোগ দিতে হবে। কিন্তু সরকারি চাকরিতে এক জায়গায় বেশি দিন কাজ করা সম্ভব হয় না।

বিডিজবসের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা এ কে এম ফাহিম মাশরুর বলেন, ‘ডিজিটাইজেশন বলতে এখনো কম্পিউটার ও ইন্টারনেট বোঝানো হয়। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, এখন চলছে এআই বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার যুগ। আমাদের এখন এআই ব্যবহার নিয়ে ভাবতে হবে।’

অনুষ্ঠানে আলোচক ছিলেন বিজিএমইএর পরিচালক শামস মাহমুদ। তিনি ব্যবসা-বাণিজ্য সহজীকরণের ওপর জোর দেন। এ ছাড়া নীতি প্রণয়নে তিনি বেসরকারি খাতের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার দাবি জানান।

উপস্থাপনায় মোস্তাফিজুর রহমান দেখান, ২০২০-২১ অর্থবছরে দেশের কর-জিডিপির অনুপাত ছিল ১০ দশমিক ৩৬ শতাংশ; ২০২১-২২ অর্থবছরে তা ছিল ৮ দশমিক ৪৩ শতাংশ; ২০২২-২৩ অর্থবছরে ছিল ৮ দশমিক ২৬ শতাংশ। চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জন্য কর-জিডিপি অনুপাতের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে ৯ দশমিক ৯৯ শতাংশ। মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, এখন যে পদ্ধতিতে কর আহরিত হচ্ছে, সেই পদ্ধতিতে এই লক্ষ্য অর্জন সম্ভব নয়।

কর আহরণ বৃদ্ধিতে বাংলাদেশে ভারতের মতো আধার কার্ড প্রণয়নের পরামর্শ দেওয়া হয় উপস্থাপনায়। বলা হয়, জাতীয় পরিচয়পত্রের ভিত্তিতে ব্যাংক হিসাব সংযুক্ত আধার কার্ড জমা দেওয়া বাধ্যতামূলক করা হলে কর ফাঁকি রোধ করা সম্ভব হবে।

অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য দেন বিশ্বব্যাংকের সরকারি খাতবিষয়ক জ্যেষ্ঠ বিশেষজ্ঞ সৈয়দ খালেদ আহসান, সংসদ সদস্য কাজী নাবিল আহমেদ প্রমুখ।