লক্ষ্যমাত্রার সঙ্গে বাস্তবের হিসাব–নিকাশ মিলছে না

বাজেটের সময় এক বিবৃতিতে অর্থ মন্ত্রণালয় দেশি-বিদেশি সংকট স্বীকার করলেও মূল্যস্ফীতির লক্ষ্য কমিয়ে ধরেছে।

  • বিবিএসের খসড়া হিসাবে গত আগস্ট মাসে মূল্যস্ফীতি প্রায় ১০ শতাংশ ছুঁয়েছে বলে জানা গেছে।

মূল্যস্ফীতি
প্রতীকী ছবি

মূল্যস্ফীতি নিয়ে সরকারের সব হিসাব-নিকাশ পাল্টে যাচ্ছে। বৈশ্বিক সংকটে দেশে মূল্যস্ফীতি বাড়বে—এমন আশঙ্কা করা হলেও চলতি অর্থবছরের বাজেটে গড় মূল্যস্ফীতি কমিয়ে ধরেছে সরকার। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন।

চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম মাসেই মূল্যস্ফীতি ছিল প্রায় সাড়ে ৭ শতাংশ। আগস্টের মূল্যস্ফীতির হিসাব এখনো প্রকাশ করা হয়নি। তবে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) খসড়া হিসাবে আগস্টে মূল্যস্ফীতি প্রায় ১০ শতাংশ ছুঁয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।

চলতি অর্থবছরের বাজেট ঘোষণার সময় অর্থ মন্ত্রণালয় একটি নীতি বিবৃতি প্রকাশ করেছে। সেখানে বলা হয়েছে, বিশ্বব্যাপী মূল্যস্ফীতি বাড়বে। বিশ্বব্যাপী মূল্যস্ফীতির বাড়ার কারণে বাংলাদেশেও মূল্যস্ফীতি বাড়বে বলে ধারণা করা হয়। মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধির আশঙ্কার কথা স্বীকার করলেও চলতি অর্থবছরের গড় মূল্যস্ফীতির লক্ষ্য ধরা হয় ৫ দশমিক ৬ শতাংশ; যা আগের অর্থবছরে ছিল ৫ দশমিক ৮ শতাংশ।

আগামী কয়েক মাস উচ্চ মূল্যস্ফীতি থাকবে। সাড়ে ৫ শতাংশ গড় মূল্যস্ফীতির লক্ষ্য ঠিক করা এই সময়ে কোনোভাবে বাস্তবসম্মত নয়।
সেলিম রায়হান, নির্বাহী পরিচালক, সানেম

অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, মূল্যস্ফীতির লক্ষ্য পুনর্নির্ধারণ করার কোনো উদ্যোগ এখনো নেওয়া হয়নি। অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আগামী ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত পর্যালোচনা করে মূল্যস্ফীতিসহ সামষ্টিক অর্থনীতির অন্য সূচকগুলো পুনর্বিন্যাস করা হতে পারে।

এবার দেখা যাক, নীতি বিবৃতিতে কী বলা হয়েছে। মূল্যস্ফীতি নিয়ে সেখানে বলা হয়েছে, সাম্প্রতিক সময়ে বৈশ্বিক সরবরাহব্যবস্থায় বড় ধরনের অভিঘাতের আশঙ্কা করা হচ্ছে। যার কারণে বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধি হ্রাস পেতে পারে এবং একই সঙ্গে বৃদ্ধি পেতে পারে মূল্যস্ফীতি।

যার ফলে কোভিড-পরবর্তী অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার বিঘ্নিত হতে পারে। ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলা এবং তার জেরে রাশিয়ার ওপর পশ্চিমা দেশগুলোর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা বিশ্বব্যাপী জ্বালানি সরবরাহকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিয়েছে। রাশিয়া বিশ্বের প্রায় ১০ শতাংশ জ্বালানি সরবরাহ করে, যার মধ্যে ১৭ শতাংশ প্রাকৃতিক গ্যাস এবং ১২ শতাংশ তেল। তেল ও গ্যাসের দামের ঊর্ধ্বগতি শিল্পে উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি করবে এবং ভোক্তাদের প্রকৃত আয় কমিয়ে দেবে। বিশ্বে একটি রেকর্ড পরিমাণ উচ্চ মূল্যস্ফীতি ইতিমধ্যে দৃশ্যমান হয়েছে, বাংলাদেশও যার প্রভাব থেকে মুক্ত নয়।

মূল্যস্ফীতির সরকারি লক্ষ্য নির্ধারণের বিষয়ে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান বলেন, ‘বাজেটের সময় যে মূল্যস্ফীতির লক্ষ্য ঠিক করা হয়েছে, তা দেখেই বলেছিলাম, এটি বাস্তবতার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়।

জুন মাস থেকে উচ্চ মূল্যস্ফীতি হয়েছে। ক্রমেই এটি বাড়ছে। আগামী কয়েক মাস উচ্চ মূল্যস্ফীতি থাকবে। সাড়ে ৫ শতাংশ গড় মূল্যস্ফীতির লক্ষ্য ঠিক করা এই সময়ে কোনোভাবে বাস্তবসম্মত নয়। তাই মূল্যস্ফীতির লক্ষ্য পুনর্বিন্যাস করার পরামর্শ দেন সেলিম রায়হান।

পাঁচ বছর মূল্যস্ফীতি লক্ষ্যেই ছিল

গত পাঁচ অর্থবছরে মূল্যস্ফীতি সরকারের নিয়ন্ত্রণেই ছিল। প্রতিবছর বাজেটে যে লক্ষ্য ধরা হতো, তার আশপাশেই ছিল মূল্যস্ফীতি। পাঁচ বছরের মধ্যে তিন বছরই লক্ষ্য অর্জিত হয়েছে। বাকি দুই বছর লক্ষ্যের খুব কাছাকাছি ছিল।

২০১৭-১৮ অর্থবছরে মূল্যস্ফীতির লক্ষ্য ছিল সাড়ে ৫ শতাংশ, তার বিপরীতে ওই অর্থবছরে গড় মূল্যস্ফীতি হয়েছিল ৫ দশমিক ৪ শতাংশ। পরের অর্থবছরে মূল্যস্ফীতির লক্ষ্য ছিল ৫ দশমিক ৬ শতাংশ। বছর শেষে মূল্যস্ফীতি ঠেকেছে ৫ দশমিক ৮ শতাংশে।

২০১৯-২০ অর্থবছরে মূল্যস্ফীতির লক্ষ্য ও অর্জন—দুটিই সাড়ে ৫ শতাংশ। ২০২০-২১ অর্থবছরে ৫ দশমিক ৪ শতাংশ মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যের বিপরীতে অর্জন ৫ দশমিক ৭ শতাংশ।

গত অর্থবছর প্রথমে মূল্যস্ফীতির লক্ষ্য ধরা হয় ৫ দশমিক ৬ শতাংশ, পরে বিশ্ব পরিস্থিতি বিবেচনায় তা বাড়িয়ে ৫ দশমিক ৮ শতাংশ করা হয়। বছর শেষে মূল্যস্ফীতি সেই লক্ষ্যমাত্রার মধ্যেই ছিল।

গত কয়েক বছরে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ সরকারের একটি সাফল্য। তবে মূল্যস্ফীতির তথ্য-উপাত্তের মান নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন অর্থনীতিবিদদের কেউ কেউ। তাঁরা বলছেন, বিবিএস প্রতি মাসে যে মূল্যস্ফীতির তথ্য প্রকাশ করে, বাস্তবে মূল্যস্ফীতির চাপ তার চেয়ে অনেক বেশি।

এবার যে কারণে মূল্যস্ফীতি বাড়ছে

মূলত তিন-চারটি কারণে এবার জিনিসপত্রের দাম বেশ ঊর্ধ্বমুখী। প্রথমত, আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যমূল্য বেশি। দ্বিতীয়ত, আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম বেড়ে যাওয়ায় স্থানীয় বাজারেও জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো হয়েছে। তৃতীয়ত, ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ায় আমদানি খরচও বেড়ে গেছে।

গত আগস্ট মাসে সব ধরনের জ্বালানি তেলের দাম ৪২ থেকে ৫১ শতাংশ বাড়ানোর কারণে বাজারে সব ধরনের ভোগ্যপণ্যের দাম বেড়েছে। আবার যাতায়াত খরচ বৃদ্ধির পাশাপাশি তেল, সাবান, বই, খাতা, কলম, পোশাক-আশাকসহ খাদ্যবহির্ভূত পণ্যের দামও বাড়তি। স্বাভাবিকভাবে যার বড় ধরনের প্রভাব মূল্যস্ফীতিতে পড়ার কথা।

কিন্তু বিবিএস এখনো আগস্ট মাসের মূল্যস্ফীতির তথ্য আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করেনি। ফলে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার প্রভাব মূল্যস্ফীতিতে কতটা পড়ল, তা জানা যাচ্ছে না।

গত ৯ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ ৭ দশমিক ৫৬ শতাংশ মূল্যস্ফীতি হয়েছে গত জুনে। এর আগে ২০১৩ সালের জুলাই মাসে ৭ দশমিক ৮৫ শতাংশ মূল্যস্ফীতি হয়েছিল। উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ এখন অর্থনীতির নতুন চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিয়েছে।

পাঁচ মাস ধরেই মূল্যস্ফীতি ধারাবাহিকভাবে বেড়েছে। গত জানুয়ারি মাসে মূল্যস্ফীতি ৫ শতাংশের নিচে ছিল। ফেব্রুয়ারি মাসে তা ৬ শতাংশ অতিক্রম করে। এরপরে মূল্যস্ফীতি ধারাবাহিকভাবে বেড়ে জুন মাসে সাড়ে ৭ শতাংশ ছাড়িয়ে যায়।