রপ্তানি পণ্য বহুমুখীকরণে জোর দিতে হবে

বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) থেকে পুরোপুরি বের হয়ে গেলে অন্যতম রপ্তানি গন্তব্য ইউরোপের বাজারে বেশ কিছু বাণিজ্য সুবিধা হারাবে। সেই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় শুধু তৈরি পোশাকের ওপর নির্ভর না করে রপ্তানি পণ্য বৈচিত্র্য করার দিকে নজর দিতে হবে। পাশাপাশি ইউরোপের বাইরে অন্যান্য অঞ্চলেও রপ্তানি বাজার বাড়াতে হবে।

সোমবার গবেষণা সংস্থা রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি ইন্টিগ্রেশন ফর ডেভেলপমেন্ট (র‍্যাপিড) আয়োজিত এক ভার্চ্যুয়াল সেমিনারে বক্তারা এসব কথা বলেন। ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক নিয়ে আয়োজিত এই সেমিনারে বক্তারা বলেন, এলডিসি থেকে উত্তরণ হলে বিদ্যমান অনেক সুবিধা হারানোর বিপরীতে কিছু সুবিধাও মিলবে। কিন্তু পরিবেশগত বিষয়সহ অনেক কঠিন শর্ত পূরণ করে তবেই সুবিধাগুলো অর্জন করতে হবে, যা অনেক চ্যালেঞ্জের। এ জন্য এখনই সরকারি–বেসরকারি যৌথ উদ্যোগ নিতে হবে।

সিপিডির বিশেষ ফেলো মোস্তাফিজুর রহমানের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন জ্যেষ্ঠ বাণিজ্যসচিব তপন কান্তি ঘোষ। অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন র‍্যাপিডের চেয়ারম্যান এম এ রাজ্জাক। এতে আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন সরকারি কর্ম কমিশনের (পিএসসি) সদস্য ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক দেলোয়ার হোসেন, একই বিভাগের অধ্যাপক আমেনা মহসিন ও লাইলুফার ইয়াসমিন, ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সভাপতি রিজওয়ান রাহমান, ট্যারিফ কমিশনের সাবেক সদস্য মোস্তফা আবিদ খান, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বিভাগের মহাপরিচালক সৈয়দ মুনতাসীর মামুন প্রমুখ।

সেমিনারে আরও বক্তব্য দেন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মো. আব্দুর রহিম খান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সালমা আক্তার, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের (বিআইআইএসএস) গবেষণা পরিচালক মাহফুজ কবীর, শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব মো. হুমায়ুন কবীর, অর্থ মন্ত্রণালয়ের উপসচিব মোহাম্মদ জহিরুল কাইউম ও র‍্যাপিডের নির্বাহী পরিচালক আবু ইউসুফ।

জ্যেষ্ঠ বাণিজ্যসচিব তপন কান্তি ঘোষ বলেন, ‘ইইউর জিএসপি প্লাস সুবিধা না পেলে আমরা পথে বসে যাব, এমনটা আমি মনে করি না। বরং আমরা আমাদের পণ্যবৈচিত্র্য ও দক্ষতা বাড়াতে পারলে বিশ্ববাজারে অনেক ভালো করব। এতে আমাদের সামনে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (এফটিএ) করার সুযোগ তৈরি হবে।’

রপ্তানি পণ্য বৈচিত্র্যকরণের ওপর জোর দিয়ে তপন কান্তি ঘোষ বলেন, তৈরি পোশাকের বাইরে দেশের ইলেকট্রনিকস, চামড়াসহ বিভিন্ন শিল্প অনেক ভালো করছে। এসব পণ্যের রপ্তানি সম্ভাবনা কাজে লাগাতে হবে।

বাংলাদেশের সামনে এফটিএর অনেক সম্ভাবনা আছে বলে মনে করেন তপন কান্তি ঘোষ। তিনি বলেন, ‘এত দিন ইইউকে আমরাই বলতাম এফটিএ করার জন্য। এখন ইইউর প্রতিনিধিদলের সদস্যরাই এ দেশে এসে বলে গেছেন এফটিএ নিয়ে ভাবতে। এটা আমাদের জন্য অনেক আশাব্যঞ্জক।’

মূল প্রবন্ধে র‍্যাপিডের চেয়ারম্যান এম এ রাজ্জাক বলেন, ‘স্বাধীনতার পর থেকেই ইইউ আমাদের অন্যতম প্রধান বাণিজ্য অংশীদার হিসেবে আছে। এ জন্য এলডিসি–পরবর্তী সময়ে ইইউর সঙ্গে সম্পর্কটা কেমন হবে, তা নিয়ে কাজ করা দরকার।’ এম এ রাজ্জাক আরও বলেন, ‘আগামী ২০৫০ সালের মধ্যে শূন্যকার্বনের দিকে যাওয়ার লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছে ইইউ। এ জন্য তারা নীতিমালা করে বেসরকারি খাতকে তা মানতে বাধ্য করছে। এ জন্য আমাদেরও পরিবেশসহ অন্যান্য বিষয় দ্রুত বাস্তবায়ন করা প্রয়োজন।’

সিপিডির বিশেষ ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘ঐতিহাসিকভাবে ইইউ আমাদের আলোকিত অংশীদার। তাই তাদের সঙ্গে দক্ষতার সঙ্গে আলোচনা চালাতে পারলে আমাদের জন্য অনেক সুবিধা পাওয়া সম্ভব।’

অন্যদিকে রপ্তানি পণ্য বহুমুখীকরণের পাশাপাশি রপ্তানিবাজার বহুমুখী করার পরামর্শ দিয়েছেন ঢাকা চেম্বারের সভাপতি রিজওয়ান রাহমান। তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্র ও ইইউর বাইরে আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্য ও এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে রপ্তানির সম্ভাবনা আছে। এসব স্থানে রপ্তানিতে ঝুঁকি নেই।

ইইউর পাশাপাশি অন্য বাণিজ্যিক অংশীদারদের সঙ্গে সম্পর্ক বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছেন কর্ম কমিশনের সদস্য অধ্যাপক দেলোয়ার হোসেন।

ট্যারিফ কমিশনের সাবেক সদস্য মোস্তফা আবিদ খান বলেন, ‘আমাদের শুধু এলডিসি থেকে গ্র্যাজুয়েশন নিয়ে ভাবলে হবে না। সার্বিকভাবে দেশের অর্থনীতির চ্যালেঞ্জ নিয়ে ভাবতে হবে।’ এ জন্য অর্থনৈতিক সংস্কারের পাশাপাশি দেশের বেসরকারি খাতকে প্রস্তুত করার পরামর্শ দেন তিনি।

ইউরোপের বাজারে রপ্তানি বাণিজ্যে সুবিধা আদায় করতে আলোচনার দক্ষতা বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছেন ঢাবির অধ্যাপক আমেনা মহসিন। আর বাণিজ্য সম্ভাবনা বাড়ানোর জন্য বৈশ্বিক ভূরাজনৈতিক কলাকৌশল বুঝে সিদ্ধান্ত নেওয়া প্রয়োজন বলে মত দিয়েছেন অধ্যাপক লাইলুফার ইয়াসমিন।

বিআইআইএসএসের গবেষণা পরিচালক মাহফুজ কবীর বলেন, দেশের অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোতে বিনিয়োগ বাড়ানোর প্রতি আরও জোর দিতে হবে। এর মাধ্যমে দেশের রপ্তানি সম্ভাবনা আরও বাড়বে।

অন্যান্য দক্ষতা অর্জনের পাশাপাশি প্রযুক্তিগত ও উদ্ভাবনী দক্ষতা বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছেন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বিভাগের মহাপরিচালক সৈয়দ মুনতাসীর মামুন। তিনি বলেন, ‘এটা করা না গেলে আমরা অন্যান্য প্রতিযোগী দেশ থেকে পিছিয়ে থাকব।’