জিডিপি বাড়লেও আয়করের অনুপাত বাড়েনি, বেড়েছে বৈষম্য

আইসিএবি আয়োজিত প্রাক বাজেট আলোচনায় উপস্থিত অতিথিরাছবি: প্রথম আলো

দেশের জিডিপি বা মোট দেশজ উৎপাদন গত ১৫ বছরে দ্বিগুণের বেশি বাড়লেও আয়কর-জিডিপির অনুপাত সে হারে বাড়েনি। ২০০৯-১০ সালে দেশে জিডিপি-আয়করের অনুপাত ছিল ১ শতাংশ; এখন তা সামান্য বেড়ে ১ দশমিক ৩ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। এতে বৈষম্য বেড়েছে।

রাজধানীর গুলশানে ১৯৬০-এর দশকে এক বিঘার জমির একটি প্লটের দাম ছিল ৬০ হাজার টাকা। এখন সেই জমিতে হয়তো ২৪টি ফ্ল্যাট হয়েছে। সেই সব ফ্ল্যাটের দাম ৬ থেকে ১০ কোটি টাকা। কিন্তু এখনো সেই সম্পদের মূল্যায়ন করা হচ্ছে মাত্র ৬০ হাজার টাকার ভিত্তিতে। এই পরিস্থিতিতে দেশে বৈষম্য বাড়ছে। প্রত্যক্ষ কর বা আয়কর বৃদ্ধি না পাওয়ার কারণে এই পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে বলে মনে করেন বক্তারা। এই পরিস্থিতিতে সম্পদকর আরোপের কথা বলেন তাঁরা।

আজ রাজধানীতে হিসাববিদদের সংগঠন ইনস্টিটিউট অব চার্টার্ড অ্যাকাউনট্যান্টস অব বাংলাদেশ (আইসিএবি) আয়োজিত প্রাক্‌-বাজেট আলোচনায় বক্তারা এসব কথা বলেন। অনুষ্ঠানে ব্যবসায়ী নেতা, অর্থনীতিবিদ, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সাবেক কর্মকর্তা ও হিসাববিদেরা আলোচনা করেন। অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি ছিলেন সাবেক পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী শামসুল আলম।

পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর দেশের করব্যবস্থার সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। তিনি বলেন, দেশের করব্যবস্থার দক্ষতা বাড়ানো গেলে রাজস্ব আয় তিন গুণ বাড়ানো সম্ভব। কেন করব্যবস্থার সংস্কার হয় না, তা সবাই কমবেশি জানেন। অথচ কর কর্মকর্তাদের অসীম ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে।

মূল্যস্ফীতি প্রসঙ্গে আহসান মনসুর বলেন, গত অর্থবছরে সরকার বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ ঋণ নিয়েছে। এবার তা হচ্ছে না, ভালো কথা। কিন্তু কেন্দ্রীয় ব্যাংক ব্যাংকগুলোকে টাকা দিচ্ছে এবং সেই অর্থ অর্থনীতিতে সঞ্চালিত হচ্ছে। দেশের মূল্যস্ফীতির হার না কমার এটি একটি কারণ। তিনি বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক হলো ঋণের সর্বশেষ আশ্রয়স্থল, তারা যেন ঋণের প্রথম আশ্রয় হয়ে না যায়।

অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি শামসুল আলম কর-জিডিপির অনুপাত বৃদ্ধিতে জোর দেন। তিনি বলেন, বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছেন, ঢাকা নগরের অনেক বাড়িওয়ালা কর দেন না; রাজস্ব বিভাগের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে একধরনের বন্দোবস্ত করে ফেলেন তাঁরা। এতে বিপুল পরিমাণে রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে দেশ।

শামসুল আলম আরও বলেন, আইএমএফের হিসাবমতে, দেশে কর-জিডিপির অনুপাত ৮ শতাংশের নিচে; ভিয়েতনামের সাড়ে ১১ শতাংশ। সে দেশে যে বিপুল পরিমাণে এফডিআই বা প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ আসে, এর সঙ্গে কর-জিডিপির অনুপাতের সম্পর্ক আছে বলে উল্লেখ করেন তিনি। বলেন, কর-জিডিপির অনুপাত বেশি হলে বিনিয়োগকারীরা আশ্বস্ত হতে পারেন যে মুনাফা দেশে ফিরিয়ে নেওয়া সহজ হবে।

বিশ্লেষকেরা প্রায়ই বলেন, দেশের করব্যবস্থা সম্প্রসারণ করা উচিত। কিন্তু এনবিআরের সাবেক সদস্য আমিনুর রহমান বলেন, দেশে টিআইএনধারীর সংখ্যা এখন ৯৬ লাখ। গত কয়েক বছরে এই সংখ্যাটা বেড়েছে। সেই সঙ্গে ব্যাংকের আমানত থেকে কর কেটে নেওয়া হচ্ছে। এতে সামগ্রিকভাবে দেশে কর দিচ্ছেন প্রায় চার কোটি মানুষ। অর্থাৎ করজাল সম্প্রসারিত হয়েছে। কিন্তু তাঁর মতে, দেশে সম্পদের কেন্দ্রীভবন হচ্ছে। বড় বড় গোষ্ঠীগুলোর গায়ে হাত দেওয়া যাচ্ছে না। এমনকি আদালত থেকে এ বিষয়ে নির্দেশনা দেওয়া হচ্ছে।

সম্পদ করারোপের ক্ষেত্রে কিছুটা জটিলতা আছে বলে মনে করেন আমিনুর রহমান। তিনি বলেন, কীভাবে সম্পদের মূল্যায়ন করা হবে, তা নিয়ে বড় ধরনের জটিলতা তৈরি হতে পারে। রাস্তার পাশের জমির এক দাম; ভেতরে গেলে আরেক দাম। আবার গুলশানের মতো জায়গায় অনেকের জমি থেকে হয়তো আয় হচ্ছে না; তাঁদের সম্পদের মূল্যায়ন কীভাবে হবে। এ ক্ষেত্রে এনবিআরের প্রস্তুতি নেই বলে তিনি মনে করেন।

অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণকারী ব্যবসায়ীরা নানা ধরনের ঝামেলার কথা তুলে ধরেন। এমনকি তাঁরা এ-ও বলেন, রপ্তানিকারকদের ওপর জুলুম করা হচ্ছে। বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, দেশের করব্যবস্থা বিনিয়োগ ও ব্যবসা পরিপন্থী।

অনুষ্ঠানে বক্তারা সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় একীভূত করার পরামর্শ দেন। তাঁরা মনে করেন, স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে এর প্রয়োজন আছে। সরকারের রাজস্ব আয় না বাড়ায় যেভাবে ঋণ বাড়ছে সেই পরিপ্রেক্ষিতে বক্তাদের পরামর্শ, এখন খরচের বিষয়ে আরও সচেতন হওয়া দরকার। রাজনৈতিক নেতাদের ঘোষণার সাপেক্ষে যেন প্রকল্প হাতে নেওয়া না হয়।    

অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য দেন অর্থনীতিবিষয়ক সাংবাদিকদের সংগঠন ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরামের (ইআরএফ) সভাপতি রিফায়েত উল্লাহ মিরধা, সাবেক সাধারণ সম্পাদক রাশিদুল ইসলাম, অর্থনীতিবিষয়ক জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক দৌলত আক্তার মালা প্রমুখ।