বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেছেন, ব্যক্তি বা সংস্থার ওপর নিষেধাজ্ঞায় কিছু আসে যায় না। এটা ওদের বিষয়। কিন্তু বাণিজ্যের ওপর নিষেধাজ্ঞা বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত বড় বিষয়। একটাই মাত্র পণ্য। সেটার ওপর নতুন বিধিনিষেধ এলে অর্থনীতিতে বড় ধাক্কা আসবে।
গতকাল রোববার অর্থনীতির বর্তমান পরিস্থিতি ও ভবিষ্যৎ নিয়ে সংবাদপত্রমালিকদের সংগঠন নিউজপেপার ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (নোয়াব) এক মতবিনিময় সভার আয়োজন করে। সেখানে ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ এসব কথা বলেন। নোয়াবের এক বিজ্ঞপ্তিতে এসব কথা বলা হয়। রাজধানীর সোনারগাঁও হোটেলে এ সভা অনুষ্ঠিত হয়।
বাংলাদেশ ব্যাংককে বলেছিলাম রিজার্ভ যে পর্যায়ে নেমেছে তা ধরে রাখেন, আর কমতে দেবেন না। কারণ, আরও কমলে রিজার্ভ নিয়ে জল্পনাকল্পনা আরও বেড়ে যাবে।ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ, অর্থনীতিবিদ
মতবিনিময় সভায় অর্থনীতিবিদেরা দেশের অর্থনীতির বর্তমান অবস্থা এবং ভবিষ্যৎ গতি–প্রকৃতি নিয়ে আলোচনা করেন। তাঁদের আলোচনায় মূল্যস্ফীতি, বৈদেশিক মুদ্রার মজুত বা রিজার্ভ সংকট, রপ্তানি, সরকারি তথ্যে গরমিল, শিক্ষাব্যবস্থা ও গুণগত মান, ব্যাংকিং সমস্যা ও সংকট, বিদেশি ঋণ, ডলারের বিনিময় মূল্য, অর্থনীতি ও বাণিজ্যের ওপর বিধিনিষেধের শঙ্কা, পশ্চিমা বাজারে অগ্রাধিকারমূলক বাণিজ্য–সুবিধাসহ বিভিন্ন বিষয় উঠে আসে।
নোয়াব সভাপতি এ কে আজাদের সভাপতিত্বে মতবিনিময় সভায় উপস্থিত ছিলেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ, গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর, সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান, এসওএএস ইউনিভার্সিটি অব লন্ডনের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক মুশতাক খান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর।
ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, ‘বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এখন বড় আলোচনার বিষয়। বাংলাদেশ ব্যাংককে বলেছিলাম যে পর্যায়ে নেমেছে তা ধরে রাখেন, আর কমতে দেবেন না। কারণ, আরও কমলে রিজার্ভ নিয়ে জল্পনাকল্পনা আরও বেড়ে যাবে।’
ব্যাংক খাত নিয়ে আলোচনায় সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, সমস্যা সমাধানে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের ওপর সব দায়িত্ব দিলে হবে না। সার্বিকভাবে দেশে যা চলছে, সুশাসন বলেন, প্রতিষ্ঠানগুলো যেভাবে চলছে—এসব নিয়ে কথা বলা প্রয়োজন। এগুলো ঠিক করতে না পারলে শেষ মুহূর্তের চিকিৎসা (প্যালিয়েটিভ ট্রিটমেন্ট) দিয়ে লাভ হবে না। বাংলাদেশের সমস্যা নিয়ে কথা বললে প্রথমেই বলা হয় বহিঃখাতের সমস্যার কথা। যেমন কোভিড, ইউক্রেন যুদ্ধ। খালি বাইরের দিকে নজর দেওয়া হচ্ছে। দেশের ভেতরের সমস্যা সবচেয়ে বেশি। বাইরের সমস্যা থাকবেই, দেশের ভেতরের সমস্যাগুলো সমাধান করতে হবে।
পিআরআইয়ের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘আমরা লেনদেন ভারসাম্যের সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। এটি মাঝারি মানের সংকট। এটি এখনো পূর্ণাঙ্গ সংকটে রূপান্তরিত হয়নি। হয়তো একটু সময় লাগবে। তবে এরই মধ্যে সরকার কিছুটা নীতি উদ্যোগ নিয়েছে বা নিতে বাধ্য হয়েছে।’ অর্থনীতির বর্তমান সংকটের জন্য ঋণের সুদের হার ‘নয়-ছয়’কে বেশি দায়ী করেন আহসান এইচ মনসুর। তাঁর মতে, এ কারণে আমানত প্রবৃদ্ধি কমে গেছে। ব্যাংক থেকে অর্থ বের হয়ে গেছে।
সিপিডির বিশেষ ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, দেশে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি ছাড়া আর কোনো সূচক লক্ষ্য অনুযায়ী অর্জিত হয়নি। তথ্য–উপাত্তে বড় সমস্যা আছে। প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে বিদেশি বিনিয়োগ গুরুত্বপূর্ণ। সপ্তম পঞ্চম বার্ষিক পরিকল্পনা অনুসারে, পাঁচ বছরে ৩ হাজার ৩০০ কোটি ডলার বিনিয়োগের লক্ষ্য থাকলেও এসেছিল ৯০০ কোটি ডলার। যেসব সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে, তা তথ্য-উপাত্তের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।
বিদেশি ঋণ নিয়ে বেশ উৎকণ্ঠা প্রকাশ করেন মুশতাক খান। তিনি বলেন, বিদেশি মুদ্রায় ঋণ নেওয়া হচ্ছে, কিন্তু তা ফেরত দেওয়ার কোনো পরিকল্পনা নেই। বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি ব্যয়ে বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে। এর ফলে বাংলাদেশে বিদ্যুৎ খাত ভবিষ্যতের জন্য বড় বোঝা হবে।
মুশতাক খান আরও বলেন, দেশের বর্তমান ব্যবস্থায় সবচেয়ে বড় সমস্যা সিন্ডিকেট এবং কিছু বড় ব্যবসায়ী গোষ্ঠী। এ জন্য প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশ তৈরি হচ্ছে না। অর্থনীতিতে এখন প্রয়োজন প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশ তৈরি করা। সে জন্য শক্ত রাজনৈতিক পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর বলেন, অর্থনীতির পরিস্থিতি সবার জানা। প্রশ্ন হচ্ছে, উন্নয়নের গল্পটা ভবিষ্যতে জারি রাখতে পারবে কিনা। যেমন খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা। দেশে বিপুল পরিমাণ খাদ্যপণ্য আমদানি হয়। তিনি মনে করেন, সরকারের নীতির কারণে মূল্যস্ফীতি হচ্ছে। ভবিষ্যতে ঋণ পরিশোধ করতে টাকার দরকার হবে। তখন আবার মূল্যস্ফীতি তৈরি হবে।
নোয়াবের সদস্যদের মধ্যে মতবিনিময় সভায় উপস্থিত ছিলেন সংগঠনটির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ও ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহ্ফুজ আনাম, প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান, ফাইন্যান্সিয়াল এক্সপ্রেস সম্পাদক শামসুল হক জাহিদ, করতোয়া সম্পাদক মোজাম্মেল হক, বণিক বার্তার প্রকাশক ও সম্পাদক দেওয়ান হানিফ মাহমুদ। এ সময় নোয়াবের সদস্য বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের প্রায় ২৫ জন সংবাদকর্মী উপস্থিত ছিলেন।