শর্ত শিথিল করছে আইএমএফ

আইএমএফ বলছে, বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার মজুত বা রিজার্ভ এখন কম। তবে আশা করা যায়, স্বল্প মেয়াদে ধারাবাহিকভাবে তা বাড়বে।

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)
ছবি: রয়টার্স

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) বাংলাদেশের জন্য ঋণের শর্ত কিছুটা শিথিল করছে। ফলে পাওয়া যাবে দ্বিতীয় কিস্তি, যার পরিমাণ ৬৮ কোটি ১০ লাখ ডলার। আইএমএফ বলছে, বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার মজুত বা রিজার্ভ এখন কম। তবে আশা করা যায়, স্বল্প মেয়াদে ধারাবাহিকভাবে তা বাড়বে। মধ্য মেয়াদে চার মাসের আমদানির সমপরিমাণও থাকবে এ রিজার্ভ। তবে সংস্থাটি মনে করে, বাংলাদেশের সামনে আছে উচ্চ মাত্রার অনিশ্চয়তা ও ঝুঁকি।।

আইএমএফ গতকাল বৃহস্পতিবার সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এসব কথা বলেছে। তারা বলেছে, সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা অর্জনে বাংলাদেশকে একদিকে রাজস্ব আয় বাড়াতে হবে, অন্যদিকে দক্ষতা আনতে হবে খরচ করার ক্ষেত্রে। উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে যে চাপ পড়েছে সাধারণ জনগণের ওপর, তা মোকাবিলায় অধিকতর মনোযোগী হতে হবে বাংলাদেশকে।

শুধু তা–ই নয়, ক্রমবর্ধমান অর্থায়নের চাহিদা মেটাতে ব্যাংক খাতের দুর্বলতা মোকাবিলা করাও বাংলাদেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। রাষ্ট্রমালিকানাধীন বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ কমানো, পুরো ব্যাংক খাতে তদারকব্যবস্থা বৃদ্ধি ও সুশাসনব্যবস্থা জোরদার করলে আর্থিক খাতের দক্ষতা বাড়বে। আর প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে অভ্যন্তরীণ পুঁজিবাজারের উন্নয়নও জরুরি।

আইএমএফের এশিয়া ও প্যাসিফিক বিভাগের প্রধান রাহুল আনন্দের নেতৃত্বাধীন দল সরকারের বিভিন্ন দপ্তরের সঙ্গে ১৫ দিন ধরে (৪-১৯ অক্টোবর) বৈঠক করে। দলটি গতকাল শেষ দিন বৈঠক করে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার এবং অর্থসচিব খায়েরুজ্জামান মজুমদারের সঙ্গে।

* নতুন লক্ষ্যমাত্রার মধ্যে প্রকৃত (নিট) রিজার্ভ রাখতে হবে ডিসেম্বরের মধ্যে ১ হাজার ৮০০ কোটি এবং আগামী জুনের মধ্যে ২ হাজার কোটি ডলার। * আইএমএফের দেওয়া শর্ত অনুযায়ী গত জুনেই বাংলাদেশের প্রকৃত রিজার্ভ থাকার কথা ২ হাজার ৪৪৬ কোটি ডলার।

বাংলাদেশের জন্য গত ৩০ জানুয়ারি ৪৭০ কোটি মার্কিন ডলারের ঋণ প্রস্তাব অনুমোদন করে আইএমএফ, যা থেকে ২ ফেব্রুয়ারি প্রথম কিস্তি ৪৭ কোটি ৬২ লাখ ৭০ হাজার ডলার ছাড় করে। দ্বিতীয় কিস্তি ছাড় করার আগে প্রথম কিস্তির মূল্যায়ন করতেই আইএমএফের দলটির এবার ঢাকায় আসা।

আইএমএফ সময়ভিত্তিক কিছু লক্ষ্য দিয়েছিল বাংলাদেশকে। তবে দ্বিতীয় কিস্তি পাওয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ রিজার্ভ, রাজস্ব আয় ইত্যাদি লক্ষ্য পূরণে সক্ষম হয়নি। তবে সরকারের দিক থেকে আইএমএফের দলকে শর্ত পূরণ করতে না পারার কিছু কারণ তুলে ধরা হয়েছে। বাংলাদেশের দিক থেকে বলা হয়েছে, আগামী জানুয়ারিতে যেহেতু বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ নির্বাচন, ফলে এ সময়ের মধ্যে লক্ষ্যগুলো অর্জন করার বাস্তবতা নেই। একটু কমিয়ে আগামী জুন পর্যন্ত নতুন লক্ষ্যমাত্রা চাইলে আইএমএফ তাতে সম্মতি প্রকাশ করে বলে অর্থ বিভাগের সূত্রগুলো জানায়।

সূত্রগুলো জানায়, নতুন লক্ষ্যমাত্রার মধ্যে প্রকৃত (নিট) রিজার্ভ রাখতে হবে ডিসেম্বরের মধ্যে ১ হাজার ৮০০ কোটি এবং আগামী জুনের মধ্যে ২ হাজার কোটি ডলার। আইএমএফের দেওয়া শর্ত অনুযায়ী গত জুনেই বাংলাদেশের প্রকৃত রিজার্ভ থাকার কথা ২ হাজার ৪৪৬ কোটি ডলার। আর সেপ্টেম্বরের রিজার্ভের লক্ষ্য ছিল ২ হাজার ৫৩০ কোটি ডলার। এ ছাড়া ডিসেম্বরে লক্ষ্য ছিল ২ হাজার ৬৮০ কোটি ডলার। আগের দুটি পারেনি এবং ডিসেম্বরেরটিও বাংলাদেশ পারবে না বলে আইএমএফকে জানিয়েছে। কারণ, বর্তমানে প্রকৃত রিজার্ভ ১ হাজার ৭০০ কোটি ডলারের কম।

এদিকে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের আয় লক্ষ্যমাত্রা ও বাজেটঘাটতি কমানো এবং একক মুদ্রা বিনিময় হার চালুর বিষয়ে আইএমএফের কারিগরি সহায়তা পাওয়া যাবে বলে আশা করছে বাংলাদেশ।

বিজ্ঞপ্তিতে আইএমএফ বলেছে, বাংলাদেশ মুদ্রানীতি ও মুদ্রা বিনিময় হারের ব্যবস্থা আধুনিকীকরণ করতে হবে। সুদের হারের করিডর–পদ্ধতি চালু এবং একক মুদ্রা বিনিময় হার চালু করার উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে আইএমএফ বলেছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের উচিত হবে সুদহার ও মুদ্রা বিনিময় হারকে পরিপূর্ণভাবে বাজারভিত্তিক করার দিকে নিয়ে যাওয়া।

স্বল্পমেয়াদি পদক্ষেপ হিসেবে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের পরামর্শ দিয়ে আইএমএফ বলেছে, অর্থনীতি যেভাবে নানা কারণে ব্যাহত হচ্ছে, তার প্রভাব যেন অরক্ষিত জনগোষ্ঠীর ওপর তেমন একটা না পড়ে। বাংলাদেশ ব্যাংক যে ৪ অক্টোবর নীতি সুদহার দশমিক ৭৫ শতাংশীয় পয়েন্ট বৃদ্ধি করেছে, সে জন্য তারা স্বাগত জানিয়েছে।

আইএমএফের প্রতিনিধিদলের প্রধান রাহুল আনন্দ বিবৃতিতে বলেন, বাংলাদেশ ও আইএমএফের প্রতিনিধিদল ২০২৩ সালের আর্টিকেল ৪ পর্যালোচনা করেছে এবং বর্ধিত ঋণ তহবিল (ইসিএফ), বর্ধিত ঋণ তহবিল (ইএফএফ) এবং রেজিলিয়েন্স অ্যান্ড সাসটেইনেবিলিটি ফ্যাসিলিটির (আরএসএফ) অধীনে প্রথম পর্যালোচনা সম্পন্ন করতে যেসব প্রয়োজনীয় নীতি গ্রহণ করতে হবে, সে বিষয়ে ঐকমত্যে এসেছে। সেই হিসাবে দ্বিতীয় কিস্তিতে ইসিএফ ও এফএফের আওতায় ৪৬ কোটি ২০ লাখ এবং আরএসএফের আওতায় ২১ কোটি ৯০ লাখ অর্থাৎ মোট ৬৮ কোটি ১০ লাখ ডলার পাওয়া যেতে পারে।

অনিশ্চয়তা ও ঝুঁকি

আইএমএফ মনে করে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বাংলাদেশ ৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে পারে। আর অর্থবছর শেষে মূল্যস্ফীতির হার ৭ দশমিক ২৫ শতাংশে নেমে আসতে পারে। এ সময়ে রিজার্ভ বাড়বে বলে আশা করলেও আইএমএফ উচ্চ মাত্রার অনিশ্চয়তা এবং ঝুঁকি আছে বলেও জানিয়েছে। তবে এর বিস্তারিত ব্যাখ্যা করা হয়নি।

বিবৃতিতে রাহুল আনন্দ বলেন, সামাজিক খাতে ব্যয় বৃদ্ধি ও বিনিয়োগের জন্য রাজস্ব সংগ্রহ বাড়ানো গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের কর-জিডিপির অনুপাত অনেক কম, এ পরিস্থিতিতে টেকসইভাবে কর সংগ্রহ বাড়াতে সমন্বিত করনীতি ও প্রশাসনিক ব্যবস্থা প্রয়োজন। তবে ভর্তুকির যৌক্তিকীকরণ, ব্যয়ের সক্ষমতা বৃদ্ধি ও আর্থিক ঝুঁকি মোকাবিলা করা গেলে সামাজিক নিরাপত্তা খাত ও প্রবৃদ্ধি সহায়ক বিনিয়োগ বাড়ানো সম্ভব হবে।

আইএমএফ বলেছে, ২০৩১ সালের মধ্যে উচ্চ মধ্যম আয়ের দেশে পৌঁছানোর জন্য যে কাঠামোগত সংস্কারের প্রয়োজন হবে, আইএমএফ তাতে সহযোগিতা করবে। বাণিজ্য সম্প্রসারণ, সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ, বিনিয়োগের পরিবেশ বাড়ানো এবং নারীদের অর্থনৈতিক অংশগ্রহণ মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির হার বাড়াতে সহায়তা করবে বলেও মনে করে আইএমএফ।

আইএমএফের সাবেক কর্মকর্তা ও পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর এ নিয়ে প্রথম আলোকে বলেন, নির্বাচনের আগে সরকারকে খরচ করতে হবে এটা ঠিক, তবে রিজার্ভ যাতে কোনোভাবেই ১ হাজার ৫০০ কোটি ডলারের নিচে না নামে, তা খেয়াল রাখতে হবে। নইলে উচ্চ ঝুঁকির কবলে পড়বে বাংলাদেশ এবং আস্থার সংকট দেখা দেবে।

আগামী জুন পর্যন্ত নতুন লক্ষ্যমাত্রা দেওয়া এবং সেই লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে না পারলে পরিণতি কী হতে পারে—এমন প্রশ্নের জবাবে আহসান এইচ মনসুর বলেন, তখন অবধারিতভাবে আইএমএফের ঋণ কর্মসূচি বাতিলের দিকে যাবে। তবে এটা ইতিবাচক যে আইএমএফকে বোঝানো গেছে এবং সংস্থাটি যথেষ্ট সংবেদনশীলতা দেখিয়েছে। ফলে ডিসেম্বর পর্যন্ত আর কোনো শর্ত নেই, সমস্যাও নেই। কিন্তু জুনের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা কোনোভাবেই যেন ব্যর্থ না হয়, সে ব্যাপারে সরকারকে সজাগ থাকতে হবে।

দ্বিতীয় কিস্তি আসছে: বাংলাদেশ ব্যাংক

এদিকে গতকাল সংবাদ সম্মেলন করে বাংলাদেশ ব্যাংক বলেছে, আইএমএফের ঋণের দ্বিতীয় কিস্তি ছাড় নিয়ে সংস্থাটির সঙ্গে বাংলাদেশের সমঝোতা হয়েছে। আগামী ডিসেম্বরে আইএমএফের পর্ষদ সভায় ঋণের দ্বিতীয় কিস্তি ছাড়ের বিষয়টি অনুমোদন পাবে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র মেজবাউল হক গতকাল সংবাদ সম্মেলন করে জানান, ঋণের জন্য আইএমএফ যেসব শর্ত দিয়েছিল, তার মধ্যে বেশ কয়েকটি পূরণ হয়েছে। তবে রিজার্ভ ও রাজস্ব আহরণের শর্ত পূরণ হয়নি। এর পেছনে দেশীয় ও বৈশ্বিক যেসব কারণ আছে, সেগুলো আইএমএফের কাছে তুলে ধরা হয়েছে। এর পরই ঋণের দ্বিতীয় কিস্তি ছাড়ের বিষয়ে সমঝোতা হয়েছে।