পোয়াবারো তেল কোম্পানির, বিশেষ করের প্রস্তাব

জ্বালানি কোম্পানিগুলোর অস্বাভাবিক মুনাফাকে অনৈতিক আখ্যা দিয়েছেন জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস।

গত বছরের মধ্যভাগের পর থেকে কোভিডের বিধিনিষেধ উঠে গেলে জ্বালানি তেলের দাম বাড়তে শুরু করে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর সেই জ্বালানির দর প্রতি ব্যারেল ১০০ ডলারের ওপরে উঠে যায়। এতে বিশ্ব অর্থনীতির চাকা থমকে গেলেও পোয়াবারো হয়েছে জ্বালানি কোম্পানিগুলোর। তাই এ ক্ষেত্রে বাংলা ভাষার সেই প্রবাদ ভালোভাবে খেটে যায়: কারও পৌষ মাস, কারও সর্বনাশ।

স্ট্যাটিস্টার সূত্রে জানা গেছে, এ বছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে বিশ্বের জ্বালানি কোম্পানিগুলোর মুনাফা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় কয়েক গুণ বেড়েছে। অথচ বিশ্বের অনেক দেশেই এখন অর্থনীতি সংকুচিত হচ্ছে। এই বাস্তবতায় জ্বালানি কোম্পানিগুলোর অস্বাভাবিক মুনাফাকে অনৈতিক আখ্যা দিয়েছেন জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস। তাঁর দাবি, জ্বালানি কোম্পানিগুলোর ওপর বিশেষ করারোপ করা হোক।

পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে যে যুক্তরাজ্যের মতো উন্নত দেশের মানুষের পক্ষে জ্বালানির ব্যয় বহন করা অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে। এতে দেশটির বিভিন্ন পেট্রলপাম্প থেকে জ্বালানি চুরির ঘটনা বাড়ছে। এ বছরের শীতে সে দেশে বার্ষিক হিসাবে জ্বালানির ব্যয় দাঁড়াবে ৩ হাজার ৫০০ পাউন্ডের ওপরে।

এদিকে ২০২১ সালের নভেম্বর মাসে বাংলাদেশে ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধির কারণে মূল্যস্ফীতির হার টানা ছয় মাস বেড়েছে। জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির জেরে একসঙ্গে সব পণ্যের দাম বেড়েছে, এক অভূতপূর্ব পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছে দেশের মানুষ। এই পরিস্থিতিতে মানুষের সঞ্চয় কমতে শুরু করেছে।

অথচ এমন বাস্তবতায় বিশ্বের জ্বালানি কোম্পানিগুলো বিপুল মুনাফা করছে। বছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে ব্রিটিশ পেট্রোলিয়াম ১৪ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ মুনাফা করেছে। আরেক কোম্পানি শেলেরও রেকর্ড মুনাফা হয়েছে। তেলের বাজারের চার বৃহৎ কোম্পানি এক্সন, শেভরন, শেল ও টোটাল এনার্জি সর্বশেষ প্রান্তিকে অর্থাৎ তিন মাসে ৫১ বিলিয়ন ডলারের বেশি আয় করেছে, যা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় দ্বিগুণ।

এই পরিপ্রেক্ষিতে শেল কর্মীদের এককালীন ৮ শতাংশ ভাতা দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। তারা বলেছে, মূল্যস্ফীতির কারণে নয়, বরং কর্মীদের মুনাফার অংশ দেওয়া হচ্ছে এর মাধ্যমে। তবে কোম্পানির প্রধান নির্বাহী এর আওতায় পড়ছেন না, কারণ কোম্পানির মুনাফা বৃদ্ধির পুরস্কার হিসেবে ইতিমধ্যে কয়েক দফায় তাঁর বেতন বেড়েছে।

এই পরিপ্রেক্ষিতে আন্তোনিও গুতেরেস বলেন, ‘এই জঘন্য লোভ বিশ্বের সবচেয়ে দরিদ্র মানুষদের আঘাত করছে, আর আমাদের এই অভিন্ন বসবাসের জায়গা নষ্ট তো করছেই। সে জন্য সংশ্লিষ্ট দেশের সরকারের প্রতি আমার আহ্বান, এসব তেল কোম্পানির অতিরিক্ত মুনাফার ওপর করারোপ করুন এবং সেই অর্থ দিয়ে সমাজের অরক্ষিত ও দরিদ্র মানুষকে সহায়তা করুন।’

এদিকে তেল কোম্পানিগুলোর অতিরিক্ত মুনাফার ওপর গত মাসে যুক্তরাজ্যে এককালীন ২৫ শতাংশ উইন্ডফল ট্যাক্স আরোপ করা হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে যুক্তরাজ্য সরকার ২৫ বিলিয়ন বা ২ হাজার ৫০০ কোটি পাউন্ড কর আহরণ করবে বলে আশা করছে। এই অর্থ দিয়ে মূলত জ্বালানির ব্যয় মেটাতে হিমশিম খাওয়া পরিবারগুলোকে সহায়তা করা হবে। যুক্তরাজ্যের এই নজিরে আগ্রহী হয়ে ইতালি, ফ্রান্সসহ আরও বেশ কয়েকটি দেশ এই উদ্যোগ নেওয়ার চেষ্টা করেছে। কিন্তু ফ্রান্সের সংসদ সদস্যরা এই প্রস্তাব নাকচ করে দিয়েছেন। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রে এমন প্রস্তাব কিছুটা রাজনৈতিক গতি পেয়েছে।

দাম কমছে

কীভাবে জ্বালানির দামে রাশ টানা যায়, তার হদিস পাওয়ার চেষ্টায় মরিয়া বিশ্বের তাবৎ রাষ্ট্রনায়ক। এই অনিশ্চয়তার মধ্যেই ব্রেন্ট ক্রুডের দর গতকাল বৃহস্পতিবার এই প্রতিবেদন লেখার সময় প্রতি ব্যারেল প্রায় ৯৬ ডলারে নেমেছে। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সূত্রের মতে, এটা হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রে তেলের মজুত ভান্ডার প্রত্যাশার তুলনায় বৃদ্ধি পাওয়ায়; কারণ, এতে চাহিদা কমছে। বাংলাদেশের মতো তেল আমদানিকারক দেশের পক্ষে অপরিশোধিত তেল সস্তা হওয়া সুখবর।

কিন্তু দাম কমছে দেখেই তেল রপ্তানিকারী দেশগুলোর বৃহত্তর গোষ্ঠী ‘ওপেক প্লাস’ তেলের জোগান জুলাই-আগস্টের চেয়ে সেপ্টেম্বরে কম হারে বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ফলে ব্রেন্টের দরপতন বহাল থাকবে কি না, তা নিয়ে সংশয় তৈরি হয়েছে। চাহিদার তুলনায় জোগান না বাড়লে দাম আবারও বাড়তে পারে। যদিও বিশেষজ্ঞদের একাংশের মতে, এই দফায় তা না-ও হতে পারে। কারণ, যুক্তরাষ্ট্র-যুক্তরাজ্যের মতো অনেক দেশে মন্দার আশঙ্কা দানা বেঁধেছে। এতে চাহিদা বৃদ্ধির সম্ভাবনা ক্ষীণ।