ভাসমান হাটে ৪৬ কোটি টাকার ব্যবসা

প্রায় ২০০ বছর আগে ঝালকাঠি সদর উপজেলার কীর্তিপাশা ইউনিয়নের ভীমরুলি বিল ও এর আশপাশে পেয়ারার আবাদ শুরু হয়। প্রতিবছর বর্ষাকালে ভীমরুলি বিলসহ বিভিন্ন খালে পেয়ারার ভাসমান হাট জমে ওঠে। এবারেও তা–ই ঘটেছে। এখন চাষি-ব্যবসায়ীদের পেয়ারা বেচাকেনা ও দেশি-বিদেশি পর্যটকদের সরব পদচারনে পেয়ারার হাট বেশ মুখর।

ভোরেই শুরু হয়ে যায় গাছ থেকে পেয়ারা পাড়ার কাজ। সেই কাঁচা-পাকা পেয়ারাভর্তি ছোট ছোট ডিঙি নিয়ে হাজির হয় চাষিরা।ছবি: প্রথম আলো

সকাল নয়টা বাজতেই চাষিরা কাঁচা-পাকা পেয়ারাভর্তি ছোট ছোট ডিঙিনৌকা নিয়ে হাজির হন খালের দুই পাশে। নৌকার ওপরেই চলে কেনাবেচা। সেই সঙ্গে অবশ্য কাগজি লেবু, আমড়া, আখ, জাম্বুরাসহ হরেক রকম ফলেরও বেচাকেনা চলে ভাসমান এই হাটে।

ঝালকাঠির খাল-বিলের এই ভাসমান হাট ও গ্রামের পর গ্রামজুড়ে পেয়ারার বাগান দেখতে এরই মধ্যে দেশের বিভিন্ন প্রান্তের ফল ব্যবসায়ী ও পর্যটকের ঢল নেমেছে, যাঁরা স্থল ও নৌ উভয় পথে এখানে আসছেন। কারণ, বর্ষায় জোয়ারের পানিতে টইটম্বুর খালপাড়ের সবুজ প্রকৃতি আর আশপাশের বনবাদাড়ে পাখির কিচিরমিচির শব্দে তৈরি হয়ে আছে এক মনোমুগ্ধকর পরিবেশ।

প্রতিবছর বর্ষাকালে ঝালকাঠি সদর উপজেলার কীর্তিপাশা ইউনিয়নের ভীমরুলি বিলসহ বিভিন্ন খালে মৌসুমি ফল পেয়ারার ভাসমান হাট জমে ওঠে। এবারেও ব্যতিক্রম ঘটেনি। সব মিলিয়ে ঝালকাঠির ভাসমান হাটসহ আশপাশের এলাকাগুলো চাষি–ব্যবসায়ীদের পেয়ারা বেচাকেনা ও দেশি–বিদেশি পর্যটকদের সরব পদচারণে এখন বেশ মুখর। বিশেষ করে প্রতি শুক্র ও শনিবার এই এলাকায় পর্যটক বোঝাই তিন শতাধিক ট্রলার আসে বলে জানা যায়।

ঝালকাঠি কৃষি বিভাগের তথ্য অনুযায়ী চলতি বছর ঝালকাঠি সদর উপজেলার ২১টি গ্রামে মোট ৮০০ হেক্টর জমিতে প্রায় ৩০০ চাষি পরিবার পেয়ারার বাগান করেছে। এর মধ্যে কীর্তিপাশা ইউনিয়নের ১১টি গ্রাম—কীর্তিপাশা, ভীমরুলি, মীরাকাঠি, ভৈরমপুর, ডুমুরিয়া, খেজুরা, খোদ্দবরাহর, বেশাইন খান, শংকর ধবল, বেউখান ও স্থানসিংহপুর এবং নবগ্রাম ইউনিয়নের নবগ্রাম, হিমানন্দকাঠি, দাড়িয়াপুর, সওরাকাঠি ও গাভারামচন্দ্রপুর—এই পাঁচটি গ্রামে সবচেয়ে বেশি পেয়ারা উৎপাদন হয়। আষাঢ়-শ্রাবণসহ তিন মাস ভাসমান নৌকায় পেয়ারার হাট বসে। সব মিলিয়ে ঝালকাঠি সদর উপজেলায় বছরে ২৪ থেকে ২৫ হাজার টন পেয়ারা উৎপাদিত হয়, যা কেনাবেচায় প্রায় ৪৬ কোটি টাকার লেনদেন হয়ে থাকে।

এলাকার প্রবীণ ব্যক্তিরা জানান, এখন থেকে প্রায় ২০০ বছর আগে ভীমরুলি বিলের আশপাশে পেয়ারার আবাদ শুরু হয়। এই পেয়ারার জাত আনা হয়েছিল ভারতের তীর্থস্থান গয়া থেকে। যদিও পরে এটি স্বরূপকাঠি জাত নামে পরিচিতি পায়। বংশপরম্পরায় এখানকার মানুষ পেয়ারার আবাদ করেছেন। সাধারণত মাঘ-ফাল্গুন মাসে পেয়ারাগাছে ফুল আসে। আর ফল পাকা শুরু হয় আষাঢ় মাসে। এদিকে চাষিরা পেয়ারার পাশাপাশি আমড়া, কাগজি লেবু, জাম্বুরাসহ বিভিন্ন সবজি চাষেও সাফল্য পেয়েছেন।

ভীমরুলি গ্রামের পেয়ারাচাষি গোবিন্দ হালদার জানান, তিনি ১০ বিঘা জমিতে পেয়ারা ও আমড়াবাগান করে এ বছর ২ লাখ টাকার ফল পেয়েছেন। ঢাকা-চট্টগ্রামের পাইকার এসে বাগান থেকেই নগদ টাকা দিয়ে ফল কিনে নিয়েছেন।

আরেক বাগান মালিক শঙ্কর মুখার্জী বলেন, গত ১০ বছরে পেয়ারার ফলন ও বেচাবিক্রি কয়েক গুণ বেড়েছে। দ্রুত পচনশীল পেয়ারা ও সবজি সংরক্ষণে জেলায় কোনো হিমাগারের ব্যবস্থা থাকলেও পদ্মা সেতুর কল্যাণে এখন তিন–চার ঘণ্টার মধ্যে পাইকারেরা পেয়ারা নিয়ে ঢাকায় পৌঁছাতে পারেন।

এদিকে স্থানীয় জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশন এখানকার পেয়ারাবাগানগুলোকে পর্যটন এলাকা হিসেবে ঘোষণা করেছে। সে অনুযায়ী অবকাঠামো নির্মাণসহ উন্নয়ন কর্মকাণ্ড হাতে নেওয়া হয়েছে। ভীমরুলির ভাসমান হাটকে কেন্দ্র করে ব্যক্তিগত উদ্যোগে তোলা হয়েছে বিনোদনকেন্দ্র ও পিকনিক স্পট। পর্যটকেরা এসব বিনোদনকেন্দ্রে যাত্রাবিরতি করেন। কৃষকদের ঋণ দেওয়ার জন্য বিভিন্ন বেসরকারি ব্যাংকও এখানে এজেন্ট ব্যাংকিং চালু করেছে।

পুরোনো ঢাকার টিকাটুলি থেকে পেয়ারাবাগানে বেড়াতে আসা একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আয়শা আক্তার প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি সুযোগ পেলেই বন্ধুদের নিয়ে এখানে ছুটে আসি। ভালো লাগার জায়গাগুলোর মধ্যে ভীমরুলির ভাসমান হাট অন্যতম।’

নৌকার ওপরেই চলে কেনাবেচা
ছবি: প্রথম আলো

ভীমরুলি পেয়ারার ভাসমান হাটের পাশে গড়ে তোলা হয়েছে গৌরব ইকো পেয়ারা পার্ক, যেখানে ঢুকতে লাগে ৩০ টাকা। এগুলোর ভেতরে রয়েছে বিশ্রামাগার, শৌচাগার ও পিকনিক করার সুবিধা। এই পার্কের ব্যবস্থাপক দীপঙ্কর ঢালী বলেন, ছুটির দিনে পার্কে পর্যটকের উপচে পড়া ভিড় থাকে।

কীর্তিপাশা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আবদুর রহিম মিয়া বলেন, প্রতি মৌসুমে এই ইউনিয়নের প্রায় ১২ হাজার মানুষ পেয়ারা চাষের সঙ্গে যুক্ত হন। তিনি বলেন, আধুনিক পর্যটনকেন্দ্র গড়ে তোলার জন্য এই অঞ্চলে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা প্রয়োজন।

জেলা কৃষি বিভাগ জানায়, পদ্মা সেতু চালু হওয়ায় ‘স্মল হোল্ডার অ্যাগ্রিকালচারাল কম্পিটিটিভনেস প্রজেক্ট (এসএসিপি)’ শীর্ষক একটি প্রকল্পের আওতায় উৎপাদিত পেয়ারাসহ কৃষিপণ্য ঢাকায় বিক্রির উদ্যোগ নেওয়া হবে। কৃষকদের উৎপাদিত পণ্য মাঠপর্যায় থেকেই সংগ্রহ করে কৃষকদের সমিতির মাধ্যমে ঢাকায় বিক্রি করা হবে।

প্রতিবছর বর্ষা মৌসুমে ঝালকাঠি সদর উপজেলার কীর্তিপাশা ইউনিয়নের ভীমরুলিসহ আশপাশের বিলে মৌসুমি ফল পেয়ারার ভাসমান হাট জমে ওঠে। গত বৃহস্পতিবার ভীমরুলি ভাসমান হাটে
ছবি: প্রথম আলো

জানতে চাইলে ঝালকাঠি কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মনিরুল ইসলাম বলেন, কীর্তিপাশার বিল অঞ্চলের কৃষকেরা কান্দি বা সজ্জন পদ্ধতিতে দেশি পেয়ারার চাষ করে আসছেন। কৃষি বিভাগের পক্ষ থেকে পেয়ারা, আমড়া ও সবজি ন্যায্যমূল্যে বিক্রি করতে ‘সদায়’ নামে একটি অ্যাপ চালু করা হয়েছে। চাষিরা প্রতিবছরই পেয়ারা ও আমড়া চাষে লাভবান হচ্ছেন। তবে পেয়ারার চেয়ে আমড়ায় লাভ বেশি হওয়ায় চাষিরা আমড়াবাগান করায় আগ্রহী হয়ে উঠছেন।

জেলা প্রশাসক জোহর আলী বলেন, পদ্মা সেতু উদ্বোধনের ফলে এই অঞ্চলের পেয়ারাকেন্দ্রিক অর্থনীতির পরিধি দিনেদিনে আরও বৃদ্ধি পাবে। সরকার কৃষকদের সহজ শর্তে প্রণোদনার ঋণ দিচ্ছে। এতে কৃষকেরা উপকৃত হচ্ছেন।

ঢাকার সদরঘাট থেকে প্রতিদিন সন্ধ্যায় ঝালকাঠির উদ্দেশে লঞ্চ ছেড়ে আসে। ঝালকাঠি লঞ্চঘাটে নেমে ইজিবাইকে চড়ে সোজা ভীমরুলি বাজার। সেখানে পৌঁছালেই দেখা যায় খালের মধ্য পেয়ারাভর্তি শত শত নৌকা। ঢাকার গাবতলী থেকে বিভিন্ন পরিবহনের বাসে করেও ঝালকাঠি জেলা সদর এসে এরপর ইজিবাইকে ভাসমান বাজারে যেতে সময় লাগে আধা ঘণ্টা। আর ইঞ্জিনচালিত নৌকায় গেলে সময় লাগে এক ঘণ্টা। এখানে নৌকায় ঘুরতে নৌকায় ভাড়া পাওয়া যায়। এ জন্য প্রতি ঘণ্টায় লাগে ৩০০ টাকা। জুলাই, আগস্ট ও সেপ্টেম্বর মাস হলো পেয়ারার মৌসুম। চাইলে এই সময়ের মধ্যে আপনিও চলে আসতে পারেন।