পণ্যমূল্য বৃদ্ধির সুফল আমদানি শুল্কে

আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ার প্রভাবে দেশের মানুষ ভুগছে। তবে সুফল পাচ্ছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) শুল্ক বিভাগ।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) প্রধান কার্যালয়
ছবি: সংগৃহীত

আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দাম বাড়ার কারণে দেশের জনগণ ভুগছে। তবে সুফল পাচ্ছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) শুল্ক বিভাগ। কারণ, বেশি দামে পণ্য আনলে ট্যারিফ মূল্য বেড়ে যায়। ফলে শুল্কায়ন করার পর শুল্ক-কর বেশি আরোপ হচ্ছে। শুল্ক-কর হার না বাড়িয়েও শুধু বেশি দামে পণ্য আমদানির ফলে বেশি রাজস্ব আদায় করতে পারছেন শুল্ক কর্মকর্তারা।

একটি উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে আমদানি পর্যায়ে ৬ হাজার ৭৬৬ কোটি টাকার শুল্ক-কর আদায় হয়েছে। ২০২১ সালের জুলাইয়ে আদায় হয়েছিল ৪ হাজার ৯১৪ কোটি টাকা। এতে দেখা যায়, এ বছরের জুলাইয়ে শুল্ক বিভাগ আগের বছরের একই মাসের তুলনায় প্রায় ৩৮ শতাংশ বেশি রাজস্ব আদায় করেছে।

আমদানি পর্যায়ের শুল্ক-কর আদায় বৃদ্ধির বিষয়টি টেকসই হবে না। এটি সাময়িক উল্লম্ফন। সরকার ইতিমধ্যে আমদানি নিয়ন্ত্রণে নানা উদ্যোগ নিয়েছে। নিকট ভবিষ্যতে আমদানি পর্যায়ে শুল্ক-কর আদায় আবার কমে যাবে।
সেলিম রায়হান, নির্বাহী পরিচালক, সানেম

একই প্রবণতা আগস্ট মাসেও অব্যাহত থাকে। ফলে জুলাই-আগস্ট দুই মাস মিলিয়ে আমদানি পর্যায়ে শুল্ক-কর আদায়ে প্রবৃদ্ধি হয়েছে সাড়ে ২৮ শতাংশ। ওই দুই মাসে ১৪ হাজার ৮৬২ কোটি টাকা আদায় হয়েছে, যা ২০২১ সালের একই সময়ে ছিল ১১ হাজার ৫৬১ কোটি টাকা। এনবিআর সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

আমদানি পর্যায়ে শুল্ক-কর বেশি আদায় হওয়ায় সার্বিকভাবে এনবিআরের রাজস্ব আদায় বেড়েছে, যা সরকারের অর্থের জোগান ধরে রাখছে। এ বছর এনবিআরকে আগের বছরের তুলনায় ২৩ শতাংশ বেশি রাজস্ব আদায় করতে হবে।

ছয়-সাত মাস ধরেই আন্তর্জাতিক বাজারে জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে প্রতি ব্যারেল জ্বালানি তেলের দাম ১৩৯ ডলার পর্যন্ত ওঠে। এখনো জ্বালানি তেলের দাম ৯০ ডলারের আশপাশেই আছে। ভোজ্যতেলের দাম টনপ্রতি ১ হাজার ২০০ থেকে ১ হাজার ৩০০ ডলার থেকে বেড়ে ১ হাজার ৯০০ ডলার পর্যন্ত উঠেছিল। পোশাক, চামড়াসহ বিভিন্ন শিল্পের মূলধনি যন্ত্রপাতি ও অন্যান্য কাঁচামাল এবং মধ্যবর্তী পণ্যের দামও বেড়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারে পোশাকের অন্যতম কাঁচামাল সুতার দামও বেশ চড়া।

ঋণপত্রে (এলসি) অর্থের পরিমাণ দেখলেও একই চিত্র পাওয়া যায়। পণ্যের পরিমাণ না বাড়লেও অর্থের অঙ্কে বেশ বেড়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, গত জুলাই মাসে ৫৬৯ কোটি ডলারের এলসি খোলা হয়েছে, যা আগের বছরের একই মাসের চেয়ে ৫৫ কোটি ডলার বেশি। ২০২১ সালের জুলাই মাসে ৫১৪ কোটি ডলারের এলসি খোলা হয়েছিল। সার্বিকভাবে ২০২১-২২ অর্থবছরে ৯ হাজার ২২৩ কোটি ডলারের ঋণপত্র খোলা হয়েছে, যা তার আগের অর্থবছরের চেয়ে ২ হাজার ৫২০ কোটি ডলার বেশি।

কীভাবে দাম বাড়লে শুল্ক–কর বৃদ্ধি পায়, এর একটি উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। ধরা যাক, গত জানুয়ারি মাসে একটি পণ্যের দাম বাংলাদেশি মুদ্রায় ১০০ টাকা ছিল। এটি ট্যারিফ মূল্য হলে ২০ শতাংশ শুল্ক–কর বাবদ আমদানিকারককে ২০ টাকা শুল্ক–কর দিতে হলো। কিন্তু আন্তর্জাতিক বাজারে জুলাই মাসে এসে ওই পণ্যের দাম ১২০ টাকা হলো। তখন আমদানিকারককে শুল্ক-কর দিতে হবে ২৪ টাকা। অর্থাৎ ৪ টাকা বাড়তি কর দিতে হয়েছে।

এ বিষয়ে বেসরকারি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হানপ্রথম আলোকে বলেন, আমদানি পর্যায়ের শুল্ক-কর আদায় বৃদ্ধির বিষয়টি টেকসই হবে না। এটি সাময়িক উল্লম্ফন। সরকার ইতিমধ্যে আমদানি নিয়ন্ত্রণে নানা উদ্যোগ নিয়েছে। নিকট ভবিষ্যতে আমদানি পর্যায়ে শুল্ক-কর আদায় আবার কমে যাবে। আমদানি শুল্কনির্ভর রাজস্ব খাত থেকে বেরিয়ে আয়করনির্ভর রাজস্ব খাতের দিকে যেতে হবে।

দুই মাসে ঘাটতি ৩ হাজার ৩১৯ কোটি টাকা

চলতি ২০২২–২৩ অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে আয়কর, মূল্য সংযোজন কর (মূসক বা ভ্যাট) ও শুল্ক খাতে সব মিলিয়ে ৪০ হাজার ২৭০ কোটি টাকা আদায় হয়েছে, যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৩ হাজার ৩১৯ কোটি টাকা কম।

তবে সার্বিকভাবে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ২১ শতাংশ। গত ২০২১–২২ অর্থবছরে একই সময়ে ৩৩ হাজার ২৪৬ কোটি টাকার রাজস্ব আদায় হয়েছিল। চলতি অর্থবছরে সব মিলিয়ে ৩ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করা হয়েছে।

এনবিআর সূত্রে জানা গেছে, প্রথম দুই মাসে আয়কর খাতে ১০ হাজার ৩৭৩ কোটি টাকা ও ভ্যাট খাতে ১৫ হাজার ৩৩ কোটি টাকা আদায় হয়েছে।

জুলাই মাসের শেষ সপ্তাহে শুল্ক, ভ্যাট ও আয়কর বিভাগের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেন এনবিআরের চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম।

সভায় তিনি রাজস্ব আদায়ে আরও কঠোর হওয়ার জন্য মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের নির্দেশ দেন এবং করদাতাদের হয়রানি না করে সহজে কর আদায় করতে বলেন। এ ছাড়া রাজস্ব আদায়ের সভায় লক্ষ্য নির্ধারণ ও কর্মকৌশল ঠিক করার তাগিদ দেওয়া হয়েছে।