অর্থনীতি বড় হয়েছে ২৭১ গুণ

এক দশক ধরে বাংলাদেশে প্রবৃদ্ধি বেড়েছে, যা করোনার আগের বছর ৮ শতাংশ ছাড়িয়েছে। করোনার মধ্যেও ৫.২৪% প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে

বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির ধারাবাহিক সফলতা এখন সারা বিশ্বের কাছে বড় এক বিস্ময়। ক্ষুধা-দারিদ্র্য, খরা-বন্যা-দুর্যোগের দেশ হিসেবে পরিচিতি পাওয়া দেশটির অর্থনীতিতে ভালো একটা প্রবৃদ্ধি হবে—এমনটা দু-তিন দশক আগেও ভাবনার মধ্যে আনা কঠিন ছিল। অথচ এক দশক ধরে সেই দেশেই কিনা ধারাবাহিকভাবে প্রবৃদ্ধি বেড়েছে, যা করোনার আগের বছর ৮ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে। এমনকি করোনার মতো সংকটের মধ্যেও অন্য দেশগুলো যখন প্রবৃদ্ধি নিয়ে খাবি খাচ্ছিল, অনেক দেশের প্রবৃদ্ধি নেতিবাচক হয়ে পড়েছিল, তখন বাংলাদেশে জিডিপি প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ৫ শতাংশ।

তথ্য-উপাত্ত পর্যালোচনা করে দেখা যায়, স্বাধীনতার পর প্রায় তিন দশক বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি ৫ শতাংশের নিচে ছিল। গত দুই দশকে তা ৮ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে। উচ্চ প্রবৃদ্ধি অর্জনের ফলে দেশে দারিদ্র্যের হার কমে গত দুই দশকে অর্ধেকে নেমে এসেছে। আবার মাথাপিছু আয়ও দুই হাজার ডলার ছাড়িয়েছে। মূলত নব্বইয়ের দশকে অর্থনীতি উন্মুক্ত করার ফলে বেসরকারি খাতের অংশগ্রহণ ব্যাপক হারে বেড়ে যাওয়ায় পরিস্থিতি পাল্টাতে শুরু করে। ওই সময় থেকে দেশে একটি পরিপক্ব উদ্যোক্তা শ্রেণি গড়ে ওঠে, যা অভ্যন্তরীণ বাজার চাঙা রাখার পাশাপাশি রপ্তানির পথও সুগম করে দেয়।

দেড় দশক আগে প্রথমবারের মতো আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। বিশেষ করে ২০০৫ সালে আন্তর্জাতিক বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান গোল্ডম্যান স্যাকসের একটি প্রতিবেদন হইচই ফেলে দেয়। প্রতিবেদনটিতে ‘নেক্সট ইলেভেন’ (এন-১১) শীর্ষক তালিকা প্রকাশ করা হয়। এতে উচ্চ প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনার বিচারে উন্নয়নশীল ১১টি দেশের নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয়। তাতে বাংলাদেশের নাম স্থান পায়। অন্য দেশগুলো হলো মিসর, ইন্দোনেশিয়া, ইরান, মেক্সিকো, নাইজেরিয়া, পাকিস্তান, তুরস্ক, দক্ষিণ কোরিয়া, ফিলিপাইন ও ভিয়েতনাম।

২০১৪ সালে ফরাসি আর্থিক ও বিমা প্রতিষ্ঠান কোফেস ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন ও দক্ষিণ আফ্রিকার (ব্রিকস) পাশাপাশি আরও ১০টি উদীয়মান অর্থনীতির তালিকা প্রকাশ করে। ওই তালিকায়ও বাংলাদেশের নাম আসে। ২০১৭ সালে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম (ডব্লিউইএফ) ‘দেয়ার কুড বি এ নিউ এশিয়ান টাইগার, হেয়ারস হোয়াই’ শীর্ষক প্রতিবেদন প্রকাশ করে। ওই প্রতিবেদনে এশিয়ার ‘এমার্জিং টাইগার’ বা ‘উদীয়মান বাঘ’ হিসেবে বাংলাদেশকে চিহ্নিত করা হয়। এর আগে এশিয়ার উদীয়মান বাঘ হিসেবে হংকং, সিঙ্গাপুর, দক্ষিণ কোরিয়া ও তাইওয়ানের নামই বলা হতো। এসব দেশ ষাটের দশক থেকে নব্বইয়ের দশক পর্যন্ত ব্যাপক অর্থনৈতিক সাফল্য অর্জন করেছে।

বাংলাদেশে উচ্চ প্রবৃদ্ধির কারণ জানতে চাইলে পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের (জিইডি) সদস্য শামসুল আলম বলেন, সত্তরের দশকে দেশের অর্থনীতিতে বেসরকারি খাতের অবদান ছিল মাত্র ১১ শতাংশ। বাকি ৮৯ শতাংশই ছিল সরকারি খাতের। কিন্তু নব্বইয়ের শুরুতে সরকারের নীতি-সমর্থনের সুবাদে দেশে বেসরকারি খাতে উদ্যোক্তা শ্রেণি গড়ে ওঠে। ফলে অর্থনীতিতে বেসরকারি খাতের অবদান বাড়তে থাকে। বেসরকারি খাতের অবদান বৃদ্ধির সঙ্গে অর্থনীতিতে নতুন নতুন খাত চালু হয়। কর্মসংস্থানেও গতি বাড়ে।

প্রবৃদ্ধির বিস্ময়

স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ ছিল একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ। সে জন্য দেশ পুনর্গঠনই তখন সরকারের পরিকল্পনায় প্রাধান্য পায়। পরিকল্পনা কমিশনের তৎকালীন ভাইস চেয়ারম্যান নুরুল ইসলামের নেতৃত্বে প্রণীত হয় প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা (১৯৭৩-১৯৭৭)। সেই পরিকল্পনা দলিল ঘেঁটে দেখা গেছে, ১৯৭২-৭৩ অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি হয়েছিল আড়াই শতাংশ। তখন অবশ্য জিডিপির আকার ছিল ৪ হাজার ২৯৪ কোটি টাকা। প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় প্রবৃদ্ধি ৫ শতাংশে উন্নীত করার লক্ষ্য ঠিক করা হয়। ওই পাঁচ বছরে ৪১ লাখ নতুন কর্মসংস্থানের লক্ষ্যও নির্ধারণ করা হয়।

পুরো সত্তরের দশকে গড়ে ৩ শতাংশ হারে প্রবৃদ্ধি হয়। আশির দশকেও এই পরিস্থিতির পরিবর্তন হয়নি। নব্বইয়ের দশকে বেসরকারি খাতের অংশগ্রহণ বৃদ্ধি পাওয়ায় প্রবৃদ্ধির চাকাও ঘুরতে শুরু করে। তবে ওই দশকে প্রবৃদ্ধি ৪-৫ শতাংশের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে। মূলত ২০০০ সালের পর থেকেই জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৫ শতাংশ পেরিয়ে ৬ শতাংশের পথে হাটে। ২০১০-১১ অর্থবছরে প্রথমবারের মতো জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৬ শতাংশ ছাড়িয়ে যায় (৬.৪৬%)। ঠিক পাঁচ বছর পর তা ৭ শতাংশ ছাড়িয়ে যায়। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি দাঁড়ায় ৭ দশমিক ১১ শতাংশ। তিন বছরের মাথায় তা ৮ শতাংশ ছাড়িয়ে যায়। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি হয় ৮ দশমিক ১৩ শতাংশ। তবে গত বছর করোনার কারণে ৫ দশমিক ২৪ শতাংশে নেমে আসে।

গত ৫০ বছরে জিডিপির আকারও ব্যাপকভাবে বেড়েছে। ১৯৭২-৭৩ অর্থবছরে জিডিপির আকার ছিল ৪ হাজার ২৯৪ কোটি টাকা। তখন দেশে পণ্য উৎপাদন ও সেবায় এই পরিমাণ মূল্য সংযোজন হতো। সর্বশেষ গত অর্থবছরে স্থিরমূল্যে জিডিপির আকার দাঁড়ায় ১১ লাখ ৬৩ হাজার ৭৩৯ কোটি টাকা। এর মানে, ৫০ বছরের ব্যবধানে দেশের অর্থনীতির ক্ষমতা বেড়েছে ২৭১ গুণ। চলতি বাজারমূল্যের হিসাবে বাংলাদেশ এখন বিশ্বের ৩৫তম বৃহৎ অর্থনীতি।

চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৬ দশমিক ৮ শতাংশ হবে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি), যা এশীয় দেশগুলোর মধ্যে চতুর্থ সর্বোচ্চ। অর্থনৈতিক উন্নতির সবচেয়ে বেশি সুফল পাওয়া গেছে দারিদ্র্য বিমোচনে।

মাথাপিছু আয় বেড়েছে ৩০১ গুণ

স্বাধীনতার পর ১৯৭২-৭৩ অর্থবছরে বাংলাদেশের মানুষের বার্ষিক গড় মাথাপিছু আয় ছিল মাত্র ৫৮০ টাকা, যা তখনকার ৯৪ মার্কিন ডলারের সমান। মাথাপিছু আয় ৫০০ ডলার ছাড়াতে ৩১ বছর সময় লাগে। ২০০৩-০৪ অর্থবছরে মাথাপিছু আয় ৫১০ ডলার হয়। এক হাজার ডলার পেরোতে স্বাধীনতার পর ৪০ বছর অপেক্ষা করতে হয়েছে। ২০১২-১৩ অর্থবছরে মাথাপিছু আয় ১ হাজার ৫৪ ডলার হয়। পরের সাত বছরেই তা দ্বিগুণ হয়ে যায়। সর্বশেষ ২০১৯-২০ অর্থবছরে মাথাপিছু আয় বেড়ে দাঁড়ায় ২ হাজার ৬৪ ডলার, যা দেশীয় মুদ্রায় প্রায় ১ লাখ ৭৪ হাজার ৮৮৮ টাকা। স্বাধীনতার পর মাথাপিছু আয় বেড়েছে প্রায় ৩০১ গুণ।