অর্থমন্ত্রী, পরিসংখ্যান উপেক্ষা করে লাভ হবে না

নতুন দরিদ্রের হিসাব স্বীকার করেন না অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের জরিপের ফল তিনি আমলে নিতে চান না। ভালো কথা, কিন্তু পরিসংখ্যান ব্যুরো এত বড় প্রতিষ্ঠান হয়েও গত দেড় বছরে দারিদ্র্য পরিস্থিতি নিয়ে কেন সমীক্ষা করল না, সেই প্রশ্ন এখন তোলা দরকার।

তবে কোভিডের অভিঘাতে দারিদ্র্য যে বেড়েছে এবং সরকার যে তা একভাবে মেনে নিয়েছে তার প্রমাণ হলো, পরপর দুই বছর দরিদ্রদের নগদ সহায়তা দেওয়া। কিন্তু দুঃখজনক ব্যাপার হলো, ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী একবারও ‘নতুন দরিদ্র’ শব্দবন্ধটি উচ্চারণ করেননি। এতে আবার সরকারের এক ধরনের অস্বীকৃতির মনোভাব পরিষ্কার হয়ে ওঠে।

অর্থনীতিবিদেরা মোটাদাগে আশা করেছিলেন, ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেটে দারিদ্র্য, কর্মসংস্থান ও বৈষম্য নিরসনে বিশেষ কর্মসূচি নেওয়া হবে। কিন্তু অর্থমন্ত্রী সেদিকে হাঁটেননি। যথারীতি ব্যবসাবান্ধব বাজেট দিয়েছেন। শানে নজুল হলো, ব্যবসা-বাণিজ্য বাড়লে মানুষের কর্মসংস্থান হবে, তাতে বাকি সব সমস্যার সমাধান হবে। কিন্তু এই চুইয়ে পড়ার নীতি উন্নত পুঁজিবাদী দেশগুলোও আর অনুসরণ করছে না। 

এ তো গেল নীতির বিষয়, আরেকটি ব্যাপার হলো, তথ্য-উপাত্তের অভাব। বাজেট বক্তৃতায় গত দেড় বছরের কোনো পরিসংখ্যান নেই। যার অর্থ দাঁড়ায়, সরকার মহামারির বাস্তবতা অস্বীকার করতে চায়। অথচ অর্থনীতি ও মানুষের জীবনযাত্রায় করোনাভাইরাসের অভিঘাত সঠিকভাবে বোঝার জন্য দরকার সময়োপযোগী তথ্য- উপাত্ত। বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলো বিভিন্ন জরিপের মাধ্যমে দেখেছে, করোনা মহামারির ফলে নতুন করে নিম্ন আয়ের অনেক মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে গেছেন—আড়াই থেকে সাড়ে তিন কোটি।

সংখ্যাগত দিক থেকে নতুন দরিদ্রের প্রকৃত সংখ্যা নিয়ে পার্থক্য থাকলেও এ ব্যাপারে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলো মোটাদাগে একই ধরনের তথ্য-উপাত্ত তুলে ধরেছে। দেশের বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোর এই উদ্যোগে যেখানে সরকারের সাধুবাদ জানানো উচিত ছিল, সেখানে তা অস্বীকার করে বাস্তবতাই ভুলে থাকতে চাইলেন অর্থমন্ত্রী।

বাস্তবতা হচ্ছে, যেসব দেশ মহামারির সময় সরাসরি জনগণকে নগদ সহায়তা করেছে, সেই সব দেশে বেকারত্ব কম ছিল। পুনরুদ্ধারেও তারা এগিয়ে আছে। যুক্তরাষ্ট্রের কথাই বলা যায়, দেশটিতে তিন দফায় ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানসহ নাগরিকদের যে নগদ সহায়তা দেওয়া হয়েছে, তার বদৌলতে চলতি বছরে দেশটির প্রবৃদ্ধির হার ৬ শতাংশ ছাড়িয়ে যাবে বলে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো পূর্বাভাস দিচ্ছে। যুক্তরাজ্যও ভালো করবে। চীন ইতিমধ্যে প্রাক-মহামারি পর্যায়ে চলে গেছে বলে গতকালই প্রতিবেদন করেছে বিবিসি।

সে জন্য যথাযথ নীতি প্রণয়ন জরুরি। আর সে জন্য দরকার তথ্য-উপাত্ত।

তথ্য-উপাত্তের প্রয়োজনীয়তা এখানেই যে সরকার ৫০ লাখ দরিদ্র পরিবারকে নগদ সহায়তা দিতে চাইলেও প্রয়োজনীয় তথ্য-উপাত্তের অভাবে শেষমেশ ৩৫ লাখ পরিবারকে দিতে পেরেছে। দেশে ভারতের মতো আধার কার্ড নেই। দরিদ্রদের তালিকা তৈরির কাজও এক দশকের বেশি সময় ধরে ঝুলে আছে। তবে এই যে ৩৫ লাখ মানুষের তথ্যভান্ডার তৈরি হলো, তা দিয়েই এই প্রক্রিয়া আরেকভাবে শুরু হলো বলা যায়। এখন কাজ হচ্ছে, এটাকে পূর্ণাঙ্গ জাতীয় তথ্যভান্ডারে রূপান্তরিত করা। এটা কোনো সাময়িক, মৌসুমি বা একটি কাজের জন্য হতে পারে না। এটা অত্যন্ত সম্ভাবনাময়। আজ হোক বা কাল, আমাদের একটি জাতীয় তথ্যভান্ডার দরকার। এই জাতীয় তথ্যভান্ডারে মানুষের আর্থসামাজিক অবস্থার বিবরণ থাকবে। সে অনুযায়ী সরকার বিভিন্ন ধরনের সমর্থন দেবে।

সায়েমা হক বলেন, জরুরি হচ্ছে, পরিসংখ্যান ব্যুরোর মাধ্যমে জাতীয় পর্যায়ে শুধু গুরুত্বপূর্ণ কিছু নির্দেশকের সাপেক্ষে একটি জরিপের ব্যবস্থা করা। পরিসংখ্যান ব্যুরোর তৃণমূল পর্যায়ে যে সক্ষমতা আছে, তার সঠিক ও সর্বাত্মক ব্যবহার করা হলে জাতীয় পর্যায়ে দ্রুতই জরিপ করা সম্ভব।

এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক সায়েমা হক বলেন, জরুরি হচ্ছে, পরিসংখ্যান ব্যুরোর মাধ্যমে জাতীয় পর্যায়ে শুধু গুরুত্বপূর্ণ কিছু নির্দেশকের সাপেক্ষে একটি জরিপের ব্যবস্থা করা। পরিসংখ্যান ব্যুরোর তৃণমূল পর্যায়ে যে সক্ষমতা আছে, তার সঠিক ও সর্বাত্মক ব্যবহার করা হলে জাতীয় পর্যায়ে দ্রুতই জরিপ করা সম্ভব। সংশ্লিষ্ট পরিসংখ্যান সঠিক সময়ে পাওয়া গেলে সরকারের নীতি নির্ধারণেও তা সহায়ক হবে। এ ছাড়া সময়ের সঙ্গে অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের মাধ্যমে দারিদ্র্যের পরিসংখ্যানে যে পরিবর্তন আসবে, তা-ও করোনার পর জানা প্রয়োজন।

ব্যাপারটা হলো, এই তথ্যভান্ডার থাকলে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে যে লিকেজ বা ফাঁকফোকর আছে, সেগুলো বন্ধ করা সম্ভব। এক মানুষ একাধিক কর্মসূচির সুবিধা পাচ্ছেন বা যাঁদের প্রয়োজন নেই, তাঁরাও সহায়তা পাচ্ছেন। সঠিক তথ্যভান্ডার থাকলে এ ধরনের পরিস্থিতি এড়ানো সম্ভব।

মহামারির কারণে যেসব মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে গেছেন, তাঁদের যত শিগগির সম্ভব আগের অবস্থায় ফেরানো জরুরি। সিংহভাগ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে গেলে অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার সম্ভব নয়। বড় বড় ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ভালো চললেই যে সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে, এই দৃষ্টিভঙ্গি এখনকার পুঁজিবাদী ঘরানাতেও অচল।

যুক্তরাষ্ট্রে বেকারদের সপ্তাহে ৬০০ ডলার করে দেওয়া হচ্ছে। ফ্রান্সে যাঁরা কাজ হারিয়েছেন, তাঁরাও সরকারি সহায়তা পাচ্ছেন। ইউরোপের কেন্দ্রীয় ব্যাংক রক্ষণশীল হিসেবে পরিচিত হলেও নোট ছাপতে শুরু করেছে। অর্থাৎ মূল ব্যাপার হলো, মানুষের হাতে টাকাটা পৌঁছানো। চুইয়ে পড়া নীতি যে কার্যকর নয়, উন্নত দেশগুলোর এসব পদক্ষেপেই তা পরিষ্কার।

আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, মহামারিতে যেসব দেশ জনগণকে বেশি সহায়তা করেছে, সেই সব দেশে বেকারত্বের হার কম। অর্থাৎ উন্নত দেশগুলোতে বেকারত্বের হার কম। অন্যদিকে মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে বেকারত্বের হার অনেক বেশি, বিশেষ করে তরুণদের বেকারত্ব।

আমাদের মতো দেশের সেই সামর্থ্য নেই। কিন্তু পরিস্থিতির স্বীকৃতি থাকা প্রয়োজন। তা না হলে যথাযথ নীতি করা সম্ভব হবে না। সে জন্য দরকার পূর্ণাঙ্গ তথ্যভান্ডার।