আর বিব্রত হতে চায় না সরকার

গৃহহীনদের তালিকা হতে হবে স্বচ্ছ, এক টাকাও নেওয়া যাবে না। নির্মাণকাজের গুণগত মান নিশ্চিত করতে হবে। মাঠ প্রশাসনে কড়া বার্তা।

সারা দেশে দরিদ্র মানুষদের জন্য প্রধানমন্ত্রীর উপহার হিসেবে ঘর দেওয়া কর্মসূচি প্রশংসা কুড়ালেও বেশ কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনায় বিব্রত হতে হয়েছে সরকারকে। কোথাও ঘর বুঝিয়ে দেওয়ার মাত্র দেড় সপ্তাহের মাথায় দেয়াল ভেঙে পড়েছে। কোথাও গৃহহীনদের কাছ থেকে টাকা নেওয়ার অভিযোগও উঠেছে। প্রথম দফার এসব অপরাধের পুনরাবৃত্তি চায় না সরকার। দ্বিতীয় দফায় যাতে উল্লিখিত ভুল না হয়, সে জন্য মাঠ প্রশাসনকে কড়া বার্তা দিয়েছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়।

প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে দেশের সব জেলা প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) কাছে সম্প্রতি পাঠানো চিঠিতে বলা হয়েছে, কোনো অবস্থাতেই উপকারভোগীর কাছ থেকে কোনো ধরনের খরচের টাকা নেওয়া যাবে না। এমনকি পরিবহন বাবদ যদি কোনো টাকা খরচ হয়, সেই টাকাও নেওয়া যাবে না। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সচিব তোফাজ্জল হোসেন মিয়া স্বাক্ষরিত চিঠিতে সাফ জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, ঘর নির্মাণের সময়ে গুণগত মান নিশ্চিত করতে কোনো আপস করা যাবে না। কাঠ, টিন, ইট, বালু, সিমেন্টের গুণগত মান নিশ্চিত করে ঘর নির্মাণে ব্যবহার করতে হবে। জমির মালিকানা রয়েছে, এমন কেউ চলমান গৃহ প্রদান কার্যক্রমের আওতায় যাতে না ঢুকতে পারে, সে জন্য কঠোর নজরদারির কথা বলা হয়েছে।

প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে পাওয়া তথ্য বলছে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে সারা দেশে ভূমি ও গৃহহীন ৮ লাখ ৮২ হাজার ৩৩টি পরিবারকে ঘর ও জমি দেওয়ার কর্মসূচির ঘোষণা দেয় সরকার। এর মধ্যে প্রথম দফায় গত ২৩ জানুয়ারি ৬৬ হাজার ১৮৯টি ঘরের মালিকানা বুঝিয়ে দেওয়া হয়। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের আওতাধীন আশ্রয়ণ প্রকল্প ২-এর আওতায় গৃহহীনদের ঘর দেওয়া হচ্ছে।

কিন্তু প্রথম দফায় দরিদ্র মানুষদের ঘর বুঝিয়ে দেওয়ার পর দেশের কয়েকটি স্থানে ঘর ভেঙে পড়ার ঘটনা ঘটেছে। ৫ ফেব্রুয়ারি বরগুনার তালতলী উপজেলার করইবাড়িয়া ইউনিয়নে বেহেলা গ্রামে ঊর্মিলার ঘরটি ভেঙে যায়। প্রধানমন্ত্রীর উপহার পাওয়ার মাত্র দুই সপ্তাহের মধ্যেই সেই ঘরের একটি দেয়ালের অংশ ভেঙে পড়ে। একই ঘটনা ঘটেছে জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জ উপজেলায়। দরিদ্র মমতাজ বেগমকে ঘর বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু উদ্বোধনের আগেই ৩ জানুয়ারি নির্মাণাধীন ঘরের দেয়াল ধসে পড়ে। এ সময় মমতাজ বেগম দেয়ালচাপা পড়লে তাঁকে উদ্ধার করে স্থানীয় উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেওয়া হয়। শুধু ঘর ভেঙে যাওয়াই নয়, প্রধানমন্ত্রীর উপহার দেওয়ার কথা বলে সাতক্ষীরার তালা উপজেলায় গৃহহীনদের কাছ থেকে ২০ হাজার থেকে ৩০ হাজার টাকা করে নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে স্থানীয় এক চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে। তা ছাড়া যাঁদের ঘর পাওয়ার কথা নয়, তাঁরাও পেয়েছেন।

* প্রথম দফায় ঘর দেওয়া হয়েছে ৬৬ হাজার ১৮৯টি। * ঘর ভেঙে পড়েছে জামালপুর, বরগুনায়। * টাকা নেওয়ার অভিযোগ সাতক্ষীরায়। * যাঁদের ঘর পাওয়ার কথা নয়, তাঁরাও পেয়েছেন। * ভিক্ষুক, প্রতিবন্ধী, বিধবা, ষাটোর্ধ্ব প্রবীণ ব্যক্তিদের অগ্রাধিকার দিতে হবে। * চলতি বছরের শেষের দিকে দ্বিতীয় দফায় ৫০ হাজার ঘর বুঝিয়ে দেওয়া হবে।

এমন পরিস্থিতিতে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে পাঠানো চিঠিতে বলা হয়েছে, যাচাই-বাছাই করে গৃহহীনদের তালিকা করতে হবে। ভিক্ষুক, প্রতিবন্ধী, বিধবা, ষাটোর্ধ্ব প্রবীণ ব্যক্তিদের অগ্রাধিকার দিতে হবে। যাঁরা যোগ্য নন, তাঁরা যাতে তালিকায় ঢুকতে না পারেন। নির্মাণকাজ চলাকালে বালু ও সিমেন্টের মিশ্রণ অনুপাত সঠিকভাবে করতে হবে। জমির মালিকানা রয়েছে, এমন কেউ চলমান গৃহ প্রদান কার্যক্রমের আওতায় আসবে না। সংশোধিত নকশা অবশ্যই মানতে হবে। প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির (পিআইসি) সব সদস্যকে নির্মাণকাজ তদারকিতে থাকতে হবে।

জানতে চাইলে আশ্রয়ণ প্রকল্প ২-এর প্রকল্প পরিচালক মাহবুব হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, প্রথম দফায় বেশ কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটেছে, এটা সত্য। তবে বিগত কাজের চেয়ে আরও ভালো কাজ যাতে করা যায়, সে জন্য প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে মাঠ পর্যায়ে চিঠি দেওয়া হয়েছে। তিনি জানান, দ্বিতীয় পর্যায়ে আগামী এপ্রিলে ৫০ হাজার গৃহহীনকে ঘর দেওয়ার কথা থাকলেও সেটা সম্ভব হয়ে উঠবে না। কিছুটা সময় লাগবে।

প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের চিঠি সম্পর্কে জানতে চাইলে এই প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা হয় অন্তত পাঁচজন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার সঙ্গে। তাঁরা সবাই চিঠিটি পেয়েছেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক ইউএনও প্রথম আলোকে জানিয়েছেন, প্রথম দফায় তাড়াহুড়া করে ঘর নির্মাণ করতে গিয়ে কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটেছে। তা ছাড়া ঘর নির্মাণের কাজটি কোনো ধরনের দরপত্র ছাড়াই নির্মাণ করা হয়েছে। পুরো কাজের তত্ত্বাবধান করেছেন ইউএনও। এ ধরনের কাজে খুব একটা অভ্যস্ত নয় মাঠ প্রশাসন। অভিজ্ঞতার অভাবে সারা দেশে কিছু ভুলত্রুটি হয়েছে। তবে দ্বিতীয় দফায় কাজ করতে যাওয়ার আগে তাঁরা খুবই সতর্ক।

চলতি বছরের শেষের দিকে দ্বিতীয় দফায় ৫০ হাজার ঘর বুঝিয়ে দেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন প্রকল্প পরিচালক মাহবুব হোসেন।