‘আসুন, কালোটাকা দেখানোর ‘উৎসবে’ আমন্ত্রণ’

চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরে মাত্র ১০ শতাংশ কর দিয়ে কালোটাকা সাদা করার অবাধ সুযোগ দেওয়া হয়েছে। তাতে সেগুনবাগিচা এলাকায় বিভিন্ন কর কার্যালয়ে যেন কালোটাকা সাদা করার হিড়িক পড়েছে।

সেগুনবাগিচা এলাকায় কালোটাকা সাদা করার ‘উৎসব’ চলছে। যাবেন নাকি সেই উৎসবে? এই উৎসবে যোগ দিতে হলে আপনাকে অসৎ হতে হবে। আপনার পকেটে ঘুষ-দুর্নীতি, চুরি-ডাকাতির টাকাপয়সা থাকতে হবে। নগদ টাকা হোক আর কালোটাকায় কেনা ফ্ল্যাট-জমি হোক, আপনি টাকা সাদা করতে পারবেন। আর একটু ব্যবসায়ী মনোভাব থাকলে শেয়ারবাজারে যেতে পারেন। কর মাত্র ১০ শতাংশ। অবশ্য আপনি যদি ভুলে আপনার কষ্টের উপার্জনের টাকা বার্ষিক কর নথিতে ভুলে না দেখান, তবু আপনি ওই উৎসবে আমন্ত্রিত। কালোটাকা সাদা করার জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) এমন ঢালাও সুযোগ সচরাচর দেখা যায় না। এনবিআরের ভাবখানা এমন, আসুন, কালোটাকা সাদা করুন। নিজের ভাবমূর্তি কাচের মতো স্বচ্ছ বানিয়ে ফেলুন।

চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেট ঘোষণার সময় এক বছরের জন্য ঢালাওভাবে কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। এ জন্য ১০ শতাংশ কর দিতে হবে।

বাজেটে দেওয়া অবারিত সুযোগে বালিশের নিচে লুকিয়ে রাখা টাকাও সাদা করা যাবে। ঘুষ বা অবৈধভাবে উপার্জিত ‘বান্ডিল বান্ডিল’ টাকা যাঁরা বাসায় রাখেন; টাকার উৎস দেখাতে পারেন না, তাঁদের জন্য এ বছর ‘বিরাট সুযোগ’। আবার অবৈধভাবে উপার্জিত টাকা অনেকে নগদে রাখতে চান না। নামে-বেনামে ব্যাংকে রাখেন। আবার অনেকে অবৈধ টাকা দিয়ে সঞ্চয়পত্র কিনে রাখেন। আয়ের উৎস দেখাতে পারেন না বলে তা করনথিতে গোপন রাখা হয়। এবার তাঁরাও বঞ্চিত হননি। এমন টাকাও বৈধ হবে ১০ শতাংশ করে।

এবার আসি, ফ্ল্যাট-জমিতে। কালোটাকা দিয়ে ফ্ল্যাট কেনার সুযোগ কয়েক বছর ধরে থাকলেও চলতি অর্থবছরে জমি কেনার ক্ষেত্রেও এ সুযোগ দেওয়া হয়েছে। শুধু তা-ই নয়, অতীতে কেউ যদি ঘুষ-দুর্নীতির টাকা দিয়ে জমি ও ফ্ল্যাট কিনে থাকেন, কিন্তু আয়ের সঙ্গে সংগতি না থাকায় এত দিন বার্ষিক আয়কর বিবরণীতে তা দেখানো সম্ভব হয়নি, এমন জমি-ফ্ল্যাটের মালিকেরা এই সুযোগ পেয়েছেন। এলাকাভেদে বর্গমিটারপ্রতি নির্দিষ্ট পরিমাণ কর দিলেই ওই সম্পদ বৈধ করে দেবে এনবিআর।

বাণিজ্যিক ভবন বা স্পেস কেনায় কালোটাকা সাদা করার সুযোগ রয়েছে। তবে এখন যাঁরা এই ফ্ল্যাট-জমি কিনবেন, তাঁরা আগামী অর্থবছরে বার্ষিক করনথিতে তা দেখাবেন। কারণ, গত ডিসেম্বর মাসেই এ বছরের রিটার্ন জমার সময় শেষ হয়ে গেছে। আর নগদ অর্থ বা ব্যাংকে রাখা টাকা সাদা করলে সংশোধিত রিটার্ন জমা দিতে হবে।
এনবিআর সূত্রে জানা গেছে, গত বছরের জুলাই থেকে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত আট মাসে ৯ হাজার ৬২৩ জন কালোটাকা সাদা করার সুযোগ নিয়েছেন।

শেয়ারবাজারে অবাধ সুযোগ

শেয়ারবাজারে এ বছর কালোটাকা সাদা করার অবাধ সুযোগ দেওয়া হয়েছে। এখন শেয়ার কিনে যেমন কালোটাকা সাদা করা যাবে, তেমনি অতীতে অর্থাৎ কয়েক বছর আগে কালোটাকায় শেয়ার কেনা থাকলেও তা সাদা করা যাবে।

সেপ্টেম্বর মাসে আরেক প্রজ্ঞাপনে শেয়ারবাজারে কালোটাকা সাদা করার আরও বিস্তৃত সুযোগের কথা জানা গেছে। পরিপত্রের একটি অংশে উদাহরণসহ বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি যদি অতীতে কালোটাকায় শেয়ার কেনেন, তা ১০ শতাংশ কর দিলেই সাদা হয়ে যাবে।

বাজেট ঘোষণার পর প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছিল, ১০ শতাংশ হারে কর দিয়ে শেয়ারবাজারে কালোটাকা বিনিয়োগ করা যাবে। যে শেয়ার কেনা হবে, তা এক বছর বিক্রি করা যাবে না। গত ১ জুলাই থেকে আগামী ৩০ জুনের মধ্যে বিনিয়োগ করতে হবে। কালোটাকায় শেয়ার কেনার পর এক মাসের মধ্যে এনবিআরের নির্দিষ্ট ফরমে শেয়ারের যাবতীয় তথ্য দিতে হবে। পরে সেপ্টেম্বর মাসে আরেক প্রজ্ঞাপনে শেয়ারবাজারে কালোটাকা সাদা করার আরও বিস্তৃত সুযোগের কথা জানা গেছে। পরিপত্রের একটি অংশে উদাহরণসহ বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি যদি অতীতে কালোটাকায় শেয়ার কেনেন, তা ১০ শতাংশ কর দিলেই সাদা হয়ে যাবে। তবে লক ইন বা এক বছর বিক্রির ওপর নিষেধাজ্ঞা সম্পর্কে কিছু বলা হয়নি।

গত আট মাসে (জুলাই-ফেব্রুয়ারি) ৩১১ জন বিনিয়োগকারী এই সুযোগ নিয়ে ৪৩০ কোটি টাকা শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করেছেন।

এবার বলা হয়েছে, আয়কর কর্তৃপক্ষসহ অন্য কোনো কর্তৃপক্ষও প্রশ্ন করবে না। এর মানে, দুর্নীতি দমন কমিশনও (দুদক) কীভাবে কালোটাকার মালিক হলেন, তা প্রশ্ন করতে পারবে না। আপনি নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন। কেউ জানতে চাইবে না, সম্মান রক্ষা হবে।

নিশ্চিন্ত থাকুন, কেউ জানতে চাইবে না

সব সরকারের আমলেই কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। কখনো বিনিয়োগ করতে বলা হয়েছে, কখনো জমি-ফ্ল্যাট কেনার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। আবার শেয়ারবাজারে বিনিয়োগেও কালোটাকা সাদা করার সুযোগ মিলেছে। কখনো কখনো নগদ টাকা সাদা করার সুযোগও এসেছে। কিন্তু এবারই প্রথম সব সুযোগ একসঙ্গে দেওয়া হলো। এত দিন শুধু বলা হতো, এনবিআর আয়ের উৎস সম্পর্কে কোনো প্রশ্ন করবে না। এবার বলা হয়েছে, আয়কর কর্তৃপক্ষসহ অন্য কোনো কর্তৃপক্ষও প্রশ্ন করবে না। এর মানে, দুর্নীতি দমন কমিশনও (দুদক) কীভাবে কালোটাকার মালিক হলেন, তা প্রশ্ন করতে পারবে না। আপনি নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন। কেউ জানতে চাইবে না, সম্মান রক্ষা হবে।