ঋণের যথাযথ ব্যবহার নিয়ে এখন বড় প্রশ্ন

যেকোনো সময় বাজার থেকে টাকা তুলে নেওয়ার ঘোষণা। প্রণোদনার টাকা নয়ছয় হওয়ার বিষয়টি খতিয়ে দেখা হবে। বেসরকারি খাতে ঋণ বাড়বে।

আগে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করে মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি অর্জনই ছিল বাংলাদেশ ব্যাংকের মুদ্রানীতির প্রধান লক্ষ্য। কিন্তু করোনাভাইরাসের কারণে মুদ্রানীতির লক্ষ্য হয়ে ওঠে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে গতি ফেরানো ও কম সুদে ব্যবসায়ীদের কাছে ঋণ পৌঁছানো। এ জন্য গত বছর করোনাভাইরাসের প্রকোপ শুরু হওয়ার পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ ব্যাংক নীতি ছাড়ের মাধ্যমে ব্যাংকগুলোতে বিপুল তারল্য জোগান দেয়। ডলার কিনেও ব্যাংকগুলোতে নগদ টাকা সরবরাহ করে। গ্রাহকেরাও ব্যাংকে আগের চেয়ে বেশি টাকা রাখেন।

বিপুল পরিমাণ অলস তারল্যের বোঝা ও বাংলাদেশ ব্যাংকের চাপ—এ দুইয়ে মিলে ব্যাংকগুলোকে প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা ঋণ দেওয়া হয়। অর্থনীতির গতি ফেরাতে বড় ও ছোট ব্যবসায়ীদের প্রায় অর্ধেক সুদে এই ঋণ দেওয়া হয়। তবে এই ঋণের যথাযথ ব্যবহার নিয়ে বড় প্রশ্ন উঠেছে। অভিযোগ আছে, ঋণ যাঁদের কাছে যাওয়ার কথা ছিল, তাঁরা কাঙ্ক্ষিত সেবা পাননি। এই ঋণের কারণেই শেয়ারবাজারে উল্লম্ফন ও ফ্ল্যাটের বিক্রি বাড়তে শুরু করেছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।

এ রকম অবস্থায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উচিত ছিল বাজার থেকে অপ্রয়োজনীয় টাকা তুলে আনার পদক্ষেপ নেওয়া। তবে সেদিকে না গিয়ে অর্থনীতির গতি ফেরাতে বেসরকারি খাতে ঋণ দেওয়ার লক্ষ্য বৃদ্ধি করে বাংলাদেশ ব্যাংক। যদিও বিদায়ী ২০২০-২১ অর্থবছরে লক্ষ্যের অনেক কম ঋণ নেন উদ্যোক্তারা।

এখন কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলছে, অতিরিক্ত তারল্য আর্থিক খাতে বুদ্‌বুদ পরিস্থিতি তৈরি করলে বাজার থেকে টাকা তুলে নেওয়া হবে। এ জন্য সময়মতো নীতি ঘোষণার পাশাপাশি ঋণের ব্যবহার খতিয়ে দেখা হবে। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, যেকোনো সময় টাকা তুলে নেওয়ার ঘোষণা দিতে হবে। শেয়ারবাজার ও আবাসন খাতে অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি ঠেকাতে এর কোনো বিকল্প নেই।

গতকাল বৃহস্পতিবার চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের জন্য ঘোষিত মুদ্রানীতিতে এসব ঘোষণা দেওয়া হয়। এতে বলা হয়েছে, অতিরিক্ত তারল্যের কারণে মূল্যবৃদ্ধি পেলে বা সম্পদের দাম বাড়লে কেন্দ্রীয় ব্যাংক নতুন নীতি গ্রহণে দ্বিধা করবে না।

নতুন মুদ্রানীতিতে চলতি অর্থবছরে বেসরকারি খাতে ঋণ বাড়ানোর লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে ১৪ দশমিক ৮০ শতাংশ। আর ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রথম ছয় মাসে ১১ শতাংশ। যদিও গত জুন পর্যন্ত বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি ছিল মাত্র ৮ দশমিক ৪ শতাংশ।

নতুন মুদ্রানীতিতে সরকারের ঋণ গ্রহণে ৩২ দশমিক ৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধি ঠিক করা হয়েছে। তবে সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে সার্বিক অভ্যন্তরীণ ঋণে প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে ১৭ দশমিক ৮০ শতাংশ। নতুন মুদ্রানীতিতে উৎপাদনশীল খাতে ঋণের জোগান বাড়ানোর কথা বলা হয়েছে।

মুদ্রানীতিতে বলা হয়েছে, করোনায় টাকা হাতবদল আগের চেয়ে কমেছে। তাই টাকার ব্যবহার বাড়াতে নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। গত জুন পর্যন্ত টাকা হাতবদল হয় ৪ দশমিক ৪৯ শতাংশ হারে, যা গত ডিসেম্বর পর্যন্ত ছিল ৪ দশমিক ৮৭।

গণমাধ্যমে পাঠানো লিখিত বক্তব্যে গভর্নর ফজলে কবির বলেন, সামষ্টিক অর্থনীতি এখনো প্রয়োজনীয় মাত্রায় ঘুরে দাঁড়ায়নি। অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার ও মানসম্মত নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে সহায়তা করতে সম্প্রসারণমূলক ও সংকুলানমুখী দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে মুদ্রানীতি প্রণয়ন করা হয়েছে।

করোনার প্রভাব মোকাবিলায় বাংলাদেশ ব্যাংক নিজেদের ও সরকারি প্রণোদনা প্যাকেজসমূহের সফল বাস্তবায়ন নিশ্চিতে কঠোর নজরদারি জোরদারের ঘোষণা দিয়েছে। গভর্নর বলেছেন, উদ্বৃত্ত তারল্য উৎপাদনশীল খাতের পরিবর্তে অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে অনুৎপাদনশীল খাতে ব্যবহৃত হয়ে মূল্য পরিস্থিতি ও আর্থিক স্থিতিশীলতায় যাতে বিঘ্ন সৃষ্টি না করে, সে ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংক সতর্ক রয়েছে। এ জন্য পরিস্থিতি বিবেচনায় যেকোনো সময়ই মুদ্রানীতিতে নীতিগত পরিবর্তন করা হবে।

প্রণোদনা ঋণের ব্যবহার প্রসঙ্গে গভর্নর বলেন, চলমান করোনা মহামারির পরিস্থিতিতে সরেজমিনে নিরীক্ষা কার্যক্রম অনেকটা শিথিল থাকায় প্রণোদনা প্যাকেজসমূহের কিছু অপব্যবহার নিয়ে ইতিমধ্যে গণমাধ্যম ও বিভিন্ন মহল উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। বর্তমানে করোনার কারণে সরেজমিন পরিদর্শন কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হলেও প্রযুক্তিনির্ভর অফ-সাইট নিরীক্ষা জোরদার করা হয়েছে। করোনা পরিস্থিতির কাঙ্ক্ষিত উন্নতির সঙ্গে সঙ্গেই ঋণের যথাযথ ব্যবহারের বিষয়টি পরিদর্শন করা হবে। এ ছাড়া আর্থিক খাতে দুর্নীতি প্রতিরোধ ও বিদেশে অর্থ পাচার রোধকল্পে বিএফআইইউ কর্তৃক আর্থিক গোয়েন্দা কার্যক্রম বাড়ানোর উদ্যোগ অব্যাহত রয়েছে।