এই পরিসংখ্যান জাতির জন্য বুমেরাং হচ্ছে

দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য

দেশের মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপি প্রবৃদ্ধির সরকারি পরিসংখ্যানের সঙ্গে বাস্তবতার মিল নেই—এটা নতুন কিছু নয়। আগেও এই অভিযোগ আমরা করেছি। এ প্রসঙ্গে তাই আমার পুরোনো এক কথার পুনরাবৃত্তি করতে চাই: প্রবৃদ্ধি এখন সুতাকাটা ঘুড়ির মতো। কাটা সুতার সঙ্গে যেমন ঘুড়ির সম্পর্ক থাকে না, তেমনি বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধির সঙ্গে অর্থনীতির বাস্তব অবস্থার সম্পর্ক পাওয়া যাচ্ছে না।

২০২১-২২ অর্থবছরের প্রবৃদ্ধি ও মাথাপিছু আয়ের সাময়িক হিসাব প্রকাশ করা হলো, তা কী তথ্য, উপাত্ত ও অনুমানের ভিত্তিতে হিসাব করা হয়েছে, তার বিস্তারিত প্রকাশের দাবি জানাই। একই সঙ্গে প্রবৃদ্ধির এই হিসাবের সত্যতা বিশেষজ্ঞদের দ্বারা প্রতিপন্ন করা হয়েছে কি না, তা–ও জানতে চাই।

বিষয়টি হচ্ছে, জিডিপি প্রবৃদ্ধির এই উচ্চ হার অন্যান্য সহগ ও সূচকের দ্বারা সমর্থিত নয়। যেমন বেসরকারি বিনিয়োগের কথাই বলা যায়, কয়েক বছর ধরে এর হার ২৩ শতাংশের আশপাশে ঘুরপাক খাচ্ছে। সেই সঙ্গে এডিপি বাস্তবায়ন, ব্যক্তি খাতে ঋণপ্রবাহ, পুঁজি পণ্যের আমদানি, জ্বালানির ব্যবহার ইত্যাদি সূচকের সঙ্গে জিডিপি প্রবৃদ্ধির উচ্চ হার মেলে না।

গত অর্থ বছরে দেশের প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৬ দশমিক ৯৪ শতাংশ। সেবার বিনিয়োগ হয়েছিল জিডিপির ৩১ দশমিক ০২ শতাংশ। আর এবার বলা হচ্ছে, প্রবৃদ্ধির হার দাঁড়াবে ৭ দশমিক ২৫ শতাংশ। সে ক্ষেত্রে ধরে নিতে হবে যে এবার বিনিয়োগ অনেকটা বেড়েছে, কিন্তু তার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। আবার বিনিয়োগ না বাড়লে ধরে নিতে হবে, এই মহামারি উত্তর সময়ে আমাদের প্রযুক্তিগত সক্ষমতা এতটা বেড়েছে যে বিনিয়োগ না বাড়লেও আমাদের উৎপাদনশীলতা বেড়েছে। কিন্তু বিদ্যমান বাস্তবতায় সেটাও বুদ্ধিগ্রাহ্য মনে হয় না। ফলে প্রবৃদ্ধির এই হার কীভাবে অর্জিত হলো, তার ব্যাখ্যা লাগবে।

সে জন্য আমি প্রাসঙ্গিক তথ্য-উপাত্ত ও জিডিপি পরিমাপের পূর্ণাঙ্গ পদ্ধতি প্রকাশের দাবি করছি।

আর উচ্চ মাথাপিছু আয়ের যে পরিসংখ্যান প্রকাশ করা হচ্ছে, তা আগামী দিনের বিচারে দেশের জন্য বুমেরাং হয়ে যাচ্ছে। আমরা এখন এলডিসি উত্তরণের পর সাশ্রয়ী ঋণ, বাজারসুবিধাসহ বেশ কিছু ক্ষেত্রে ছাড় পাওয়ার লক্ষ্যে দেনদরবার করে যাচ্ছি। কিন্তু যে দেশের মানুষের মাথাপিছু আয় এলডিসি থেকে বের হওয়ার মাত্রার প্রায় দ্বিগুণ, সে দেশে এত বিশেষ সুবিধা লাগবে কেন—এই প্রশ্ন উন্নয়ন–সহযোগীরা তুলছেন। ফলে যাঁরা মনে করছেন, এই ফোলানো-ফাঁপানো পরিসংখ্যান দিয়ে জাতির মঙ্গল হচ্ছে, তাঁরা ভুল করছেন।

সবচেয়ে বড় কথা, প্রবৃদ্ধির হার বা মাথাপিছু আয়ের হিসাব দিয়ে প্রান্তিক মানুষের জীবনমানের পরিস্থিতি বোঝা যায় না। আর খানা আয়–ব্যয় জরিপের ফলাফল ছয় বছরের বেশি সময় ধরে প্রকাশ করা হচ্ছে না। এই পরিস্থিতিতে দেশের বিভাজিত পর্যায়ে জীবনমানের কী পরিবর্তন হলো, তা বোঝার উপায় নেই। ‍তখন থাকে শুধু বাস্তব জীবনের অভিজ্ঞতা।

দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য, বিশেষ ফেলো, সিপিডি