এত অনিয়ম তাহলে কি কেউ দেখেনি

কল্পনা আক্তার, সভাপতি, বাংলাদেশ গার্মেন্টস অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল ওয়ার্কার্স ফেডারেশন

পোশাক কারখানার বাইরে পণ্য উৎপাদনকারী কারখানাগুলোর অবস্থা যে ভালো নয়, সেটা কমবেশি আমরা সবাই জানি। কিন্তু এত দিন আমাদের সবার চোখ ছিল পোশাক খাতের কর্মপরিবেশের দিকে। দেশীয় শিল্পকারখানাকে উপেক্ষা করে গেছে সবাই। দেশে প্রতিনিয়ত উৎপাদনমুখী শিল্প বাড়ছে, শিল্পের বিকাশ ঘটছে। কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের দায়িত্ব হচ্ছে নজরদারি করা। যখন যে ধরনের পদক্ষেপ নেওয়ার প্রয়োজন, তাদের দায়িত্ব সেটা নেওয়া। কিন্তু উৎপাদনশীল কারখানায় কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করতে তারা কিছুই করতে পারেনি।

২০১৩ সালে রানা প্লাজায় ভবন ধসের পর এখন চলছে ২০২১ সাল। এত বছর পর এসেও সংস্থাটির শীর্ষ ব্যক্তিরা বলেন জনবল সংকটের কথা, পরিদর্শক কম। কিন্তু জনবল সংকটের দোহাই দিয়ে দিনের পর দিন তাঁরা দায় এড়াতে পারেন না।

কারাখানার মালিকেরা কেউ ধোয়া তুলসী পাতা নন। কারখানায় যে শিশুশ্রম বন্ধ, সব মালিক তা জানেন। কিন্তু অনৈতিকতা এমন জায়গায় চলে এসেছে, মালিকেরা নিজেদের এমন অবস্থানে ভাবতে শুরু করেছেন, যার কারণে তাঁরা এখন আইনকে তোয়াক্কাই করছেন না। দিনের পর দিন আইন ভঙ্গ করছেন। নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে সজীব গ্রুপের হাসেম ফুডস লিমিটেডের কারখানার কথা যদি বলি, সেখানে শিশু শ্রমিক ছিল। অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র ছিল না। শ্রমিকদের তালাবদ্ধ করে রাখা হয়েছে। কারখানার নিচতলায় গোডাউন ছিল। ভবন তৈরির ক্ষেত্রে বিল্ডিং কোড মানা হয়নি। কারখানায় দাহ্য পদার্থ রাখা ছিল। নানা অনিয়মের ঘটনা ঘটলেও কারখানা পরিদর্শন অধিদপ্তর কোনো পদক্ষেপই নেয়নি।

দেশে কোনো কারখানা স্থাপন করতে গেলে তার সঙ্গে সরকারের নয়টি বিভাগ জড়িত থাকে। হাসেমের কারখানার এত অনিয়ম তাহলে কি কেউ দেখেনি? আমাদের মালিকেরা ক্ষমতাকে এত অপব্যবহার করেন, তাঁরা মানুষকে মানুষ মনে করেন না। এখন পর্যন্ত যত অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে, তার কোনো বিচার হয়নি। কারও কোনো শাস্তি হয়নি। যদি শাস্তির একটি দৃষ্টান্তও থাকত, তবে যেকোনো মালিক শ্রমিকদের দিয়ে অনিরাপদ কারখানায় কাজ করাতে দশবার চিন্তা করতেন।

দুর্ঘটনায় একজন শ্রমিক মারা গেলে তাঁর পরিবারকে ক্ষতিপূরণ বাবদ দুই লাখ টাকা দেওয়া হয়। একজন শ্রমিকের জীবনের মূল্য কখনো দুই লাখ টাকা হতে পারে না। কোনো একজন সম্পদশালী মালিক যখন চিন্তা করেন একজন শ্রমিকের মৃত্যুর মূল্য দুই লাখ টাকা, তাঁর কাছে প্রাণের মূল্য থাকবে কীভাবে।

সরকার যদি পরিদর্শন অধিদপ্তরে সংস্কারকাজ শুরু না করে, তাহলে এমন দুর্ঘটনা আরও ঘটতে থাকবে। মানুষ মারা যাবে। কিন্তু কারও কিছু হবে না। আমরা আবার কথা বলব। ক্ষোভ ঝাড়ব। কিন্তু অবস্থার উন্নতি হবে না।

রূপগঞ্জের অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় আমাদের দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হবে। বাংলাদেশের শ্রমিকের অধিকার ও কর্মস্থল কতটা নিরাপদ, তা ক্রেতাদের ভাবাবে। অগ্নিকাণ্ডের পর হাসেম সাহেব কীভাবে বলতে পারেন যে আমি কেন দায় নেব। শ্রমিকের অবহেলায় আগুন লাগতে পারে। এটা কোনো কথা হতে পারে? দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হওয়ার কারণে মালিকেরা এসব কথা বলার সাহস পেয়েছেন।

উৎপাদনশীল কারখানার ক্ষেত্রেও অ্যাকর্ড মডেলকে কাজে লাগানো যেতে পারে। রাজধানীর এফ আর টাওয়ারে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় অনেক মানুষ মারা গেছেন। সেখানে যদি অ্যাকর্ডের মতো সংস্থা থাকত, তাহলে শ্রমিকের অধিকার নিশ্চিত করা যেত। এখন জরুরি হলো পরিদর্শন অধিদপ্তরকে সংস্কার করা।