কর কমল, করভার কি কমেছে

বেশির ভাগ কোম্পানি করপোরেট করহার কমানোর সুফল পাবে না। এ ছাড়া কর্মীদের মুনাফার ভাগের অংশ করযোগ্য হবে।

  • বাজেটে করপোরেট কর কমানো হয়েছে ২.৫ শতাংশ।

  • শ্রমিক অংশগ্রহণ তহবিলে কোম্পানির দেওয়া অনুদানকে ব্যয় হিসেবে দেখানোর সুযোগ বাতিল করা হয়েছে, যা করভার বাড়াবে।

  • কোম্পানির দায়িত্বপ্রাপ্ত যে ব্যক্তি উৎসে কর কাটতে ব্যর্থ হবেন, তিনিও দায়ী থাকবেন। জরিমানার পরিমাণ ১০ লাখ টাকা।

২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে করপোরেট কর কমানো হয়েছে। কিন্তু উৎসে করের হার না কমানো ও নতুন কিছু বিধানের কারণে করপোরেট কর কমানোর তেমন একটা সুফল পাওয়া যাবে না। ব্যবসায়ী ও সনদপ্রাপ্ত হিসাববিদেরা এমনটাই মনে করছেন।

কোথায় করভার বাড়বে, তার একটি উদাহরণ দেওয়া যাক। বাজেটে ওয়ার্কার্স প্রফিট পার্টিসিপেশন ফান্ড (ডব্লিউপিপিএফ) বা শ্রমিক অংশগ্রহণ তহবিলে কোম্পানির দেওয়া অনুদানকে ব্যয় হিসেবে দেখানোর সুযোগ বাতিল করা হয়েছে। এর মানে হলো, কোম্পানি এই তহবিলে যত অর্থ দেবে, সেটিকে করযোগ্য আয় হিসেবে দেখিয়ে আয়কর আদায় করবে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। তাতে কোম্পানির করভার বাড়বে। এমনকি এই তহবিলে অর্থ দেওয়া নিরুৎসাহিত হওয়ার আশঙ্কাও করছেন কেউ কেউ।

দেশের শ্রম আইন অনুযায়ী, কোম্পানির মোট মুনাফার ৫ শতাংশ আলাদা করে সেখান থেকে ৮০ শতাংশ সবাইকে ভাগ করে দিতে হয়। আর ১০ শতাংশ প্রতিষ্ঠানের শ্রমিক কল্যাণ তহবিলে ও বাকি ১০ শতাংশ শ্রম মন্ত্রণালয়ের শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশনে জমা করতে হয়। কোনো কোম্পানির পরিশোধিত মূলধন এক কোটি টাকা বা স্থায়ী সম্পদ দুই কোটি টাকা হলে এই নিয়ম প্রযোজ্য হয়।

যাহোক, বাজেটের আয়কর ও মূল্য সংযোজন কর (মূসক তথা ভ্যাট) অংশ বিশ্লেষণ করে এবং হিসাববিদদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এতে বেশ কিছু বিষয় রয়েছে, যা ব্যবসার ওপর চাপ কমাবে এবং ব্যবসা সহজ করবে। আবার অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের প্রস্তাবিত বাজেটের কিছু বিষয় পুনর্বিবেচনার দাবিও উঠেছে।

করপোরেট কর কমানো হলেও উৎসে কর তেমন একটা কমানো হয়নি। এতে বেশির ভাগ কোম্পানি তেমন একটা সুফল পাবে না। ‘সুপার প্রফিট’ করা কোম্পানিগুলো বেশি লাভবান হবে।
এম হুমায়ুন কবির, সাবেক সভাপতি, আইসিএবি

বাজেটের ভালো দিক কী কী, জানতে চাইলে দুজন ব্যবসায়ী ও দুজন সনদপ্রাপ্ত হিসাববিদ বলেন, তিন বছরে করপোরেট কর সাড়ে ৭ শতাংশ কমিয়ে ফেলা একটি সাহসের কাজ। ১০ শতাংশের বেশি শেয়ার পুঁজি বাজারে না ছাড়লে কর ছাড়ের সুবিধা না পাওয়ার বিধানটিও ভালো। মুঠোফোনে আর্থিক সেবার (এমএফএস) মাধ্যমে লেনদেনের চালানপত্রকে করব্যবস্থায় স্বীকৃতি দেওয়ার বিষয়টিও প্রশংসনীয়।

ব্যবসায়ী ও সনদপ্রাপ্ত হিসাববিদেরা বাজেটে কর আদায়ে বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তিকে (এডিআর) উৎসাহ দেওয়া, কর্মীকে দেওয়া ভাতার (পারকুইজিট) করমুক্ত সীমা বৃদ্ধি, গবেষণা ব্যয়কে খরচ হিসেবে দেখানোর সুযোগ, ভ্যাট সমন্বয়ের সময়সীমা দুই বছর থেকে বাড়িয়ে চার বছর করা, ভ্যাটের ক্ষেত্রে অস্পষ্টতা দূরীকরণ ও জরিমানা বাস্তবসম্মত করাসহ বাজেটের বিভিন্ন বিষয়কে ভালো দিক বলে উল্লেখ করেন।

মুনাফা বেশি হলে সুবিধা বেশি

এবারের বাজেটেও করপোরেট কর আড়াই শতাংশ কমানো হয়েছে। এ সম্পর্ক দ৵ ইনস্টিটিউট অব চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টস অব বাংলাদেশের (আইসিএবি) সাবেক সভাপতি এম হুমায়ুন কবির প্রথম আলোকে বলেন, এটা আসলে বাজেটের ‘প্রসাধন’। সরকার দেখাতে চায়, বাংলাদেশে করপোরেট করহার কম। আসলে করভার বেশি।

কীভাবে তার ব্যাখ্যাও দেন হুমায়ুন কবির। তিনি বলেন, দেশে কোনো কোম্পানি কাঁচামাল আমদানি করলে উৎসে আয়কর কেটে রাখা হয়। হারও বেশি। লাভ হোক, লোকসান হোক, সেই টাকা আর ফেরত পাওয়া যায় না। দেখা যায়, উৎসে কর কেটে রাখার ফলে কার্যকর করহার অনেক বেশি হয়। ফলে করপোরেট করহার কত কমানো হলো, তা কম মুনাফাকারী কোম্পানির ক্ষেত্রে খুব একটা ইতিবাচক হয় না।

হুমায়ুন কবির বলেন, নতুন বাজেটে করপোরেট কর কমানো হলেও উৎসে কর তেমন একটা কমানো হয়নি। এতে বেশির ভাগ কোম্পানি তেমন একটা সুফল পাবে না। ‘সুপার প্রফিট’ করা কোম্পানিগুলো বেশি লাভবান হবে।

করপোরেট কর কমানোর ক্ষেত্রে বাজেটে একটি শর্তের কথা বলা হয়েছে। সেটি হলো, লেনদেন করতে হবে ব্যাংকের মাধ্যমে। বছরে মাত্র ১২ লাখ টাকা লেনদেন নগদে করা যাবে। এই শর্তের কারণে সুফলটি অনেকে পাবেন না বলে উল্লেখ করেন সনদপ্রাপ্ত হিসাববিদ প্রতিষ্ঠান স্নেহাশিষ মাহমুদ অ্যান্ড কোম্পানির অংশীদার স্নেহাশিষ বড়ুয়া। তিনি বলেন, এই শর্ত মেনে চলা কঠিন। কিছু ‘কমপ্লায়েন্ট’ (সার্বিক মানসম্মত) প্রতিষ্ঠান এটা রক্ষা করে কর ছাড়ের সুফল পাবে। বাকিদের ক্ষেত্রে কঠিন হবে।

কারও কারও ‘ব্যবসা কমবে’

এতদিন শনাক্তকরণ নম্বর (টিআইএন) দাখিল করেই বিভিন্ন সেবা কর নেওয়া যেত। যেমন এনবিআরের ওয়েবসাইটে গিয়ে একটি ই-টিআইএন তৈরি করে অন্যান্য নথির সঙ্গে ব্যাংকে জমা দিলেই ক্রেডিট কার্ড পাওয়ার সুযোগ ছিল। এখন আর সেটা থাকবে না। ব্যাংককে দেখতে হবে, আপনি আয়কর রিটার্ন দিয়েছেন কি না।

দেশে এখন ৭৫ লাখ টিআইএনধারী আছেন। তাঁদের মধ্যে মাত্র ২৫ লাখের মতো রিটার্ন জমা দেন। মানে হলো, আয় থাকলে কর দেন। বাকিরা টিআইএন নিয়ে মূলত বিভিন্ন সেবা নিচ্ছেন। ৩৮ ধরনের সেবার জন্য রিটার্ন দেখানো বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এতে ওইসব সেবাদাতার ব্যবসা কমতে পারে।

ধরা যাক, ব্যাংক আপনাকে বলল ক্রেডিট কার্ড নিতে আয়কর রিটার্ন দেওয়া লাগবে। আপনি বললেন, আপনি ক্রেডিট কার্ডই নেবেন না। তাহলে ব্যাংকের ব্যবসা কমবে। আর ব্যাংক যদি নিয়ম না মেনে আপনাকে ক্রেডিট কার্ড দেয়, তাহলে তাদের জরিমানা হবে ১০ লাখ টাকা।

অবশ্য হিসাববিদেরা মানুষকে করজালে আনতে রিটার্ন দাখিলের প্রমাণ দেখানোর বিধানটিকে ভালো বলে উল্লেখ করেছেন।

কর কাটতে ব্যর্থ হলে জরিমানা

কোম্পানিগুলো সাধারণত প্রতিনিধি হিসেবে তার সরবরাহকারীর কাছ থেকে উৎসে আয়কর কেটে সরকারের কোষাগারে জমা দেয়। নতুন বিধান হলো, কোম্পানির দায়িত্বপ্রাপ্ত যে ব্যক্তি কর কাটতে ব্যর্থ হবেন, তিনিও দায়ী থাকবেন। জরিমানার পরিমাণ ১০ লাখ টাকা।

উৎসে কর কাটার বিষয়টি নিয়ে নিরীক্ষা করতে গেলে যদি কোম্পানি বাধা দেয়, তাহলে ৫০ লাখ টাকা জরিমানার সুযোগ থাকছে। কর দিতে ব্যর্থ হলে প্রতিষ্ঠানের গ্যাস ও বিদ্যুৎ–সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার সুযোগ কর আদায়কারীদের দেওয়ার বিষয়ে বাজেটে প্রস্তাব রেখেছেন অর্থমন্ত্রী।

বন্ধ কোম্পানির বকেয়া কর এর পরিচালকদের কাছ থেকে আদায় করার প্রস্তাব এবারের বাজেটে রেখেছেন অর্থমন্ত্রী। ফলে কোম্পানি বন্ধ করার আগে সরকারের কর পরিশোধের বিষয়টি ভাবতেই হবে।

দেশীয় শিল্প: সুরক্ষা ও কর বৃদ্ধি

বাজেটে দেশীয় কিছু শিল্পকে সুরক্ষা ও ছাড় দেওয়া হয়েছে। আবার কিছু শিল্প খাতের ওপর কর বাড়ানো হয়েছে। যেমন রেফ্রিজারেটর ও মুঠোফোন সেট উৎপাদনকারীদের ওপর থেকে ভ্যাট অব্যাহতি সুবিধা তুলে নেওয়া হয়েছে। আরোপ করা হয়েছে ৫ শতাংশ ভ্যাট।

করপোরেট কর সব রপ্তানিকারকের জন্য ১২ শতাংশে নির্ধারণ করে ‘বৈষম্য’ নিরসন করা হয়েছে। কিন্তু উৎসে আয়কর বাড়িয়ে ১ শতাংশ করা হয়েছে, যা এখন শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ।

অবশ্য রপ্তানি খাতে উৎসে আয়কর শেষ পর্যন্ত ১ শতাংশ থাকে কি না, সেটি দেখার বিষয়।কারণ, অতীতেও অর্থমন্ত্রীরা এই কর বাড়িয়ে পরে পিছু হটেছেন।