করোনার টিকা ক্রয় চুক্তি বিশ্বব্যাংকের নজরে

টিকা ক্রয়ে অর্থ পাওয়ার ক্ষেত্রে বিশ্বব্যাংকের অগ্রাধিকারের তালিকায় রয়েছে বাংলাদেশসহ ১২টি দেশ।

করোনার টিকা কিনতে বিশ্বব্যাংকের কাছ থেকে বাংলাদেশ ৫০ কোটি ডলার ঋণ পেতে যাচ্ছে। এই অর্থ দেশীয় মুদ্রায় ৪ হাজার ২৫০ কোটি টাকার মতো (প্রতি ডলার ৮৫ টাকা ধরে)। এ নিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে বোঝাপড়া শেষ। এখন শুধু বিশ্বব্যাংকের বোর্ড বা পর্ষদে অনুমোদন হওয়ার অপেক্ষা। সেটিও চলতি মাসেই হয়ে যেতে পারে।

টিকা ক্রয়ে ঋণ পাওয়ার ক্ষেত্রে বিশ্বব্যাংকের প্রথম পর্যায়ের অগ্রাধিকার তালিকায় বাংলাদেশসহ ১২টি দেশের নাম রয়েছে। তবে টিকা নিয়ে প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে এসব দেশের যেসব চুক্তি হয়েছে, তা নজরে রাখবে বিশ্বব্যাংক। তার মানে, কতটা ন্যায্যতা ও স্বচ্ছতার ভিত্তিতে চুক্তি হয়েছে, তা নজরে রাখবে সংস্থাটি। বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট ডেভিড মালপাস সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে এসব কথা বলেন। তিনি জানান, সদস্যদেশগুলোকে ভ্যাকসিন বা টিকা কেনায় সহায়তা করতে সব মিলিয়ে ১ হাজার ২০০ কোটি ডলারের ঋণ কর্মসূচি নিয়েছে বিশ্বব্যাংক।

আন্তর্জাতিক বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে গত ১৯ ফেব্রুয়ারি দেওয়া ওই সাক্ষাৎকারে বিশ্বব্যাংক প্রেসিডেন্ট ডেভিড মালপাস বলেন, ধনী-গরিবনির্বিশেষে প্রায় সব দেশের মধ্যে করোনার টিকা পাওয়া নিয়ে প্রতিযোগিতা চলছে। এমন অবস্থায় টিকা প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে ওই সব দেশের টিকা কেনার চুক্তি গুণে-মানে কতটা ঠিক আছে, তা নিয়ে কাজ করছে বিশ্বব্যাংক। এ ছাড়া চুক্তির তথ্য-উপাত্ত নিয়ে টিকা প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানগুলোকে আরও বেশি খোলামেলা হওয়ার জন্য চাপ সৃষ্টি করছে বিশ্বব্যাংক।

ডেভিড মালপাস আরও বলেন, ভ্যাকসিন বা টিকা কেনার জন্য ১২টি দেশের নামে মার্চ মাসের মধ্যে ১৬০ কোটি ডলার ঋণ অনুমোদন হবে বলে আশা করা হচ্ছে। এই দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো বাংলাদেশ, ফিলিপাইন, তিউনিসিয়া ও ইথিওপিয়া। ঋণ পাওয়ার তালিকায় পরের ধাপে আরও ৩০টি দেশ আছে।

ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউটের কাছ থেকে অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা কিনেছে বাংলাদেশ। টিকা ইতিমধ্যে দেশে এসে গেছে এবং টিকাদানও বেশ কদিন আগে শুরু হয়েছে।

টিকা কেনার বিষয়টি বিশ্বব্যাংকের নজরদারিতে রাখা প্রসঙ্গে এ দেশের অর্থনীতিবিদ ও বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, বাংলাদেশের মতো দেশে জরুরি ভিত্তিতে কেনাকাটায় নানা ধরনের অস্বচ্ছতা থাকে। যেহেতু বিশ্বব্যাংক টাকা দেবে, তাই সংস্থাটি টিকা কেনার পুরো বিষয়টি পর্যবেক্ষণে রাখতে চায়। কোথা থেকে, কত দামে টিকা কেনা হলো, তা দেখতে চায়। বিশ্বব্যাংকের মতো সংস্থা এই ধরনের কেনাকাটার প্রকল্পে নিবিড়ভাবে জড়িত থাকলে দুর্নীতির সুযোগ কমে যায়। তিনি আরও বলেন, উন্নত দেশগুলো টিকা কেনার বায়না করে রেখেছে। অনেক দেশ জনসংখ্যার দ্বিগুণ, তিন গুণ টিকার বায়নাও করেছে। এ ধরনের মজুতদারির জন্য গরিব দেশগুলো যেন বঞ্চিত না হয়, সে জন্য উন্নত দেশগুলোকে চাপ দেবে বিশ্বব্যাংক।

অবশ্য টিকাপ্রাপ্তির ক্ষেত্রে বৈষম্যের চিত্রও আছে। বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, কোভিড-১৯ টিকা দেওয়ায় এখন পর্যন্ত সবচেয়ে এগিয়ে আছে ইসরায়েল। দেশটির প্রতি ১০০ জনের মধ্যে ৮২ জনকে টিকা দেওয়া হয়ে গেছে। অন্যদিকে বাংলাদেশ ও ভারতে প্রতি ১০০ জনে ১ জনও টিকা পাননি। এ ছাড়া আফ্রিকার বহু দেশে এখনো টিকা পৌঁছায়নি।

রয়টার্সকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট জানান, তৃণমূল পর্যায়ে করোনার টিকা দেওয়ার ক্ষেত্রে কতটা সক্ষমতা রয়েছে, কোথায় কোথায় দুর্বলতা আছে, তা চিহ্নিত করতে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর সরকারসমূহের সঙ্গে কাজ করছে বিশ্বব্যাংক। এ ছাড়া টিকা প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে সরকারসমূহের চুক্তির গুণগত মান কেমন, তা খতিয়ে দেখা হবে।

এদিকে বিশ্বব্যাংকের সহযোগী প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল ফিন্যান্স করপোরেশনও (আইএফসি) টিকার উৎপাদন সক্ষমতা বৃদ্ধি করতে বিভিন্ন দেশে ৪০০ কোটি ডলার বিনিয়োগ করবে। এ সম্পর্কে বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট বলেন, ‘টিকা প্রস্তুত করার সক্ষমতা বাড়ানোর জন্য বিনিয়োগ করতে ভীষণ আগ্রহী। কিন্তু আমরা জানি না প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানগুলোর টিকা বানানোর সক্ষমতা কত?’

বাংলাদেশের টিকা কেনার প্রকল্প

টিকা কেনার জন্য প্রায় সাত হাজার কোটি টাকার ‘কোভিড-১৯ ইমার্জেন্সি রেসপন্স অ্যান্ড প্যানডেমিক প্রিপেয়ার্ডনেস’ শীর্ষক একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছে বাংলাদেশ। এই প্রকল্পে বিশ্বব্যাংক দিচ্ছে ৫০ কোটি ডলার (৪ হাজার ২৫০ কোটি টাকা)।
বিশ্বব্যাংকের কাছে গত অক্টোবর মাসে ৫০ কোটি ডলার চেয়েছে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি)। এ নিয়ে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে চার মাস ধরে সরকারের আলোচনা চলেছে। শেষ পর্যন্ত বিশ্বব্যাংক টাকা দিতে রাজি হয়েছে। দায়িত্বশীল সূত্রগুলো বলছে, ঋণ প্রস্তাবটি অনুমোদনের জন্য চলতি মাসে বিশ্বব্যাংকের বোর্ডে বা পর্ষদে উঠতে পারে। অনুমোদন হয়ে গেলে সপ্তাহ দুয়েকের মধ্যেই বাংলাদেশের ঋণ পাওয়ার প্রবল সম্ভাবনা রয়েছে।