আশুলিয়ার তাজরীন ফ্যাশনসে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ১১১ জন পোশাকশ্রমিক পুড়ে মারা যান। কারখানাটির ফটক তালাবদ্ধ থাকায় বের হতে পারেননি শ্রমিকেরা। তাজরীনের ঘটনার আট বছর আট মাস পর নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের হাসেম ফুডসের কারখানায় একইভাবে পুড়ে মরলেন ৫২ জন শ্রমিক। ভবনটিতে আগুন শনাক্তের জন্য ফায়ার অ্যালার্ম ও জরুরি নিগর্মন সিঁড়ি ছিল না। জানালায় ছিল লোহার গ্রিল। এমনকি জীবন বাঁচাতে পাঁচতলা থেকে ছাদে উঠতে গিয়ে তালা ভাঙতে হয় শ্রমিকদের।
হাসেম ফুডসের অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার পর তদারকি সংস্থা হিসেবে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের (ডিআইএফই) দিকে ব্যর্থতার আঙুল উঠেছে। কারখানাটিতে যে ধরনের ত্রুটিবিচ্যুতি ছিল, তা শ্রম মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন অধিদপ্তরের পরিদর্শকদের পরিদর্শনেই ধরা পড়ার কথা। অথচ ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ার পরও কারখানাটি পরিদর্শন করে ব্যবস্থা নিতে পারেনি তারা।
বিভিন্ন খাতের একাধিক ব্যবসায়ী ও শ্রমিকনেতা অভিযোগ করেন, তাজরীনের অগ্নিকাণ্ড ও রানা প্লাজা ধসের পর রপ্তানিমুখী পোশাক কারখানার কর্মপরিবেশ উন্নয়নে বিশেষ জোর দেওয়া হলেও অন্যান্য শিল্পকারখানায় নজর দেওয়া হয়নি। ফলে পোশাকশিল্পের বাইরে একের পর এক দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি ঘটছে। অন্যদিকে পরিদর্শকদের কেউ কেউ আর্থিক সুবিধা নিয়ে যথাযথভাবে কারখানা পরিদর্শন ও ব্যবস্থা না নেওয়ায় কোনো সুফল মিলছে না। অবশ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, লোকবলসংকটই তাদের বড় দুর্বলতা। তা ছাড়া আইনে শাস্তির বিধান কম থাকায় পরিদর্শকদের ক্ষমতাও কম।
২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল সাভারের রানা প্লাজা ধসের পর কারখানা পরিদর্শনের দৈন্যদশার চিত্র নতুন করে আলোচনায় উঠে আসে। পোশাক কারখানার কর্মপরিবেশ নিয়েও দেশে-বিদেশে ব্যাপক সমালোচনা হয়। তখন পোশাকের ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে রপ্তানিমুখী খাতটির পরিদর্শনে নানামুখী উদ্যোগ নেওয়া হয়। এতে বিদেশি ক্রেতাদের দুই জোট অ্যাকর্ড ও অ্যালায়েন্সের পাশাপাশি সরকারের পরিদর্শন দপ্তরকেও যুক্ত করার সিদ্ধান্ত হয়। তাই পরের বছর লোকবল বাড়িয়ে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন পরিদপ্তরকে অধিদপ্তরে উন্নীত করা হয়। বর্তমানে অধিদপ্তরের অনুমোদিত ৯৯৩ জনবলের মধ্যে কর্মরত রয়েছেন প্রায় ৪০০। তার মধ্যে পরিদর্শক ৩১২ জন।
অধিদপ্তরে উন্নীত হওয়ার পর পোশাক কারখানা পরিদর্শনেই বেশি মনোযোগ দিতে পরিদর্শকদের কাজে লাগানো হয়। পরে অন্যান্য খাতে দুর্ঘটনা বাড়লে ধীরে ধীরে পোশাক খাতের বাইরের কারখানা, প্রতিষ্ঠান ও দোকান পরিদর্শন বাড়তে থাকে। পরিদর্শনের জন্যও রয়েছে আলাদা চেকলিস্ট। এই চেকলিস্টের মাধ্যমে কারখানায় শিশুশ্রম, দাহ্য পদার্থ, পর্যাপ্ত সিঁড়ি, জরুরি নির্গমন পথ, অগ্নিকাণ্ড হলে তা শনাক্ত ও নির্বাপণব্যবস্থা আছে কি না, তা তদারক করে ব্যবস্থা নিতে পারেন পরিদর্শকেরা।
হাসেম ফুডসের অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার পর তদারকি সংস্থা হিসেবে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের দিকে ব্যর্থতার আঙুল উঠেছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ডিআইএফইর একজন পরিদর্শক বলেন, তাঁদের প্রত্যেকের কারখানা পরিদর্শনে আলাদা টার্গেট রয়েছে। অল্প সময়ে সেটি পূরণ করার পাশাপাশি মামলা করে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া কঠিন। তা ছাড়া আইন অনুযায়ী ২৫ হাজার টাকার বেশি জরিমানা করা যায় না। প্রভাবশালী ব্যবসায়ীরাও পরিদর্শনের সময় নানাভাবে বাধা, এমনকি হুমকি দেন।
অবশ্য নারায়ণগঞ্জের দুজন ব্যবসায়ী অভিযোগ করে বলেন, কারখানার লাইসেন্স নবায়ন করতে গেলে বাড়তি অর্থ দিতে হয়। পরিদর্শন নিয়ে জটিলতা এড়াতে অনেক কারখানাই পরিদর্শকদের মাসিক ভিত্তিতে অর্থ দিয়ে থাকেন। সাধারণ সার্ভিস রুলস অনুমোদনের জন্যও নিয়মের বাইরে অর্থ দিতে হয়। অনেক সময় পরিদর্শন না করেই কারখানার কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে প্রতিবেদন তৈরি করে নিজেদের কার্যালয়ে জমা দেন পরিদর্শকেরা।
ডিআইএফইর যুগ্ম মহাপরিদর্শক মো. মোস্তাফিজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, রানা প্লাজা ধসের পর সক্ষমতা বাড়লেও ৯০ হাজার কারখানা ও প্রতিষ্ঠানের বিপরীতে ৩১২ জন পরিদর্শক খুবই অপ্রতুল। অধিদপ্তরের জনবল ১ হাজার ৭৯১ জনে উন্নীত করতে একটি প্রস্তাব মন্ত্রণালয়ে জমা দেওয়া আছে। সেটি অনুমোদন হলে সংকট কাটবে। পরিদর্শকদের বিরুদ্ধে অভিযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, একটা ঘটনা ঘটলে অনেক কথাই ওঠে।
অধিদপ্তরের এই উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা লোকবলের সংকটের কথা বললেও গত ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৩৭ হাজার ৩২৭টি কারখানা, দোকান ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন করেন পরিদর্শকেরা। তার মধ্যে পোশাক কারখানা ৩ হাজার ৮৮৭টি ও অন্যান্য কারখানা ১৪ হাজার ৮৩২টি। বিদায়ী ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে ১৬ হাজার ৯৬৪টি কারখানা পরিদর্শন হয়েছে। যদিও চেকলিস্ট অনুসারে ৬ হাজার ৪১৬টিতে নানা রকম ত্রুটিবিচ্যুতি পাওয়া যায়।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ লেবার কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক নাজমা আক্তার প্রথম আলোকে বলেন, ডিআইএফইর পরিদর্শকেরা ছোট ছোট কারখানাকে জরিমানা করলেও বড় কারখানায় সেভাবে পরিদর্শন করেন না। অনেক ক্ষেত্রে টাকাপয়সা দিয়ে পরিদর্শকদের ম্যানেজ করার ঘটনাও ঘটে। তিনি আরও বলেন, রূপগঞ্জের হাসেম ফুডসের কারখানা নির্মাণ ও পরিচালনায় কোনো মানদণ্ড মানেনি কর্তৃপক্ষ। একই সঙ্গে তদারকি সংস্থা ডিআইএফই ছাড়াও সরকারের যেসব সংস্থা কারখানাটির অনুমোদন দিয়েছিল, তাদেরও আইনের আওতায় আনতে হবে।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের (বিলস) তথ্যানুযায়ী, গত সাড়ে তিন বছরে ৯৯টি কারখানায় দুর্ঘটনায় ১৬৯ জন শ্রমিক মারা গেছেন।
শ্রম আইন বিশেষজ্ঞ জাফরুল হাসান প্রথম আলোকে বলেন, কারখানা পরিদর্শনের ক্ষেত্রে অভিযুক্ত ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে শ্রম আইনে শাস্তির মাত্রা কম। তার চেয়ে বড় দুর্বলতা হচ্ছে আইন বাস্তবায়নে। অধিদপ্তরের অধীনে বর্তমানে যতজন পরিদর্শক আছেন, তাঁদের দিয়েও আরও কার্যকরভাবে পরিদর্শন কাজ করা সম্ভব।