কালোটাকার উৎস সম্পর্কে প্রশ্ন করা নিষেধ

কালোটাকা সাদা করার সুযোগ আছে, নাকি নেই—এ নিয়ে বাজেট ঘোষণার পর থেকে আলোচনা চলছে। ৩০ জুন জমি-ফ্ল্যাট কেনার পাশাপাশি শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করে কালোটাকা সাদা করার সুযোগ শেষ হচ্ছে। এমনকি নগদ টাকা ও ব্যাংকে রাখা টাকা সাদা করার সুযোগের মেয়াদও শেষ হচ্ছে। তাহলে কালোটাকা সাদা করার সুযোগ থাকল কীভাবে? এর উত্তর সহজ—আয়কর অধ্যাদেশের একাধিক ধারায় অনির্দিষ্টকালের জন্য কালোটাকা সাদা করার সুযোগ রয়েছে।

আয়কর অধ্যাদেশের পাঁচ ধারায় কালোটাকা সাদা করার সুযোগ আছে। এই ধারাগুলো হলো ১৯এএএএ, ১৯এএএএএ, ১৯বিবিবিবিবি, ১৯ডিডি এবং ১৯ই। এর মধ্যে ১৯এএএএ ধারায় শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ এবং ১৯এএএএএ ধারায় জমি-ফ্ল্যাট ও নগদ বা ব্যাংকে রাখা কালোটাকা বিনা প্রশ্নে সাদা করার সুযোগ আছে। যার মেয়াদ ৩০ জুন শেষ হচ্ছে।

আবার ১৯বিবিবিবিবি ধারায়ও আয়তনভেদে কর দিয়ে অনির্দিষ্টকালের জন্য ফ্ল্যাট কিনে টাকা সাদা করার সুযোগ রাখা হয়েছে। ১৯ই ধারায় ২৫ শতাংশ কর দিয়ে এবং করের ওপর ১০ শতাংশ জরিমানা দিয়ে অপ্রদর্শিত আয় ঘোষণা দেওয়ার স্থায়ী সুযোগ আছে। ১৯বিবিবিবিবি এবং ১৯ই ধারায় কালোটাকা সাদা করলে প্রশ্ন করা হবে কি না, তা স্পষ্ট করা হয়নি। অর্থমন্ত্রী এবার সেখানেও সদয় হচ্ছেন। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) সূত্রে জানা গেছে, বাজেটের অর্থবিল পাসের সময় ওই দুটি ধারায় কালোটাকা সাদা করা হলে কোনো প্রশ্ন করা হবে না, এমন সংশোধনী আনা হচ্ছে।

যে সুবিধা বাতিল হচ্ছে

গত বছরের জুন মাসে চলতি ২০২০–২১ অর্থবছরের বাজেট ঘোষণার সময়ে ঢালাও কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। আয়কর অধ্যাদেশে ১৯এএএএ এবং ১৯এএএএএ এই দুটি ধারা সংযোজন করা হয়। ১৯এএএএ ধারায় কালোটাকা ১০ শতাংশ কর দিয়ে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। এ জন্য এক বছরের লক ইন বা বিক্রি নিষেধাজ্ঞার শর্ত দেওয়া হয়। আর ১৯এএএএএ ধারায় নগদ টাকা, ব্যাংকে গচ্ছিত টাকা, সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগকৃত টাকা সাদা করার সুযোগ রয়েছে। এ ছাড়া ওই একই ধারায় আয়তনভেদে ও এলাকাভেদে নির্দিষ্ট পরিমাণ কর দিয়ে জমি–ফ্ল্যাট কিনে কালোটাকা সাদা করার সুযোগ আছে। এই সুযোগটির মেয়াদ ৩০ জুন শেষ হচ্ছে।

যে সুবিধা থাকছে

২০১৯-২০ অর্থবছরের অর্থ আইনে দেখা গেছে, ১৯বিবিবিবিবি নামে একটি ধারা সংযোজন করা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, এই অধ্যাদেশে যা–ই থাকুক না কেন, এলাকাভেদে ও আয়তনভেদে নির্দিষ্ট পরিমাণ কর দিয়ে ফ্ল্যাট কিনলে ওই বিনিয়োগ সম্পন্ন হয়েছে বলে ধরে নেবে এনবিআর। পরোক্ষভাবে এ ধারায় অপ্রদর্শিত টাকায় ফ্ল্যাট কেনার সুযোগ রাখা হয়েছে। এটিকে বিশেষ কর–সুবিধা হিসেবে বলা হয়েছে। এই সুযোগটির কোনো সময়সীমা নেই। এত দিন শর্ত ছিল—অপরাধ কার্যক্রমের মাধ্যমে এবং অবৈধ উৎস থেকে অর্জিত অর্থ সাদা করা যাবে না। এখন সেই শর্ত শিথিল করা হচ্ছে। আগামী অর্থবছরের বাজেটের অর্থ বিল পাস করার সময় এই ধারার সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে আয়ের উৎস সম্পর্কে এনবিআর কিংবা কোনো সংস্থা প্রশ্ন করবে না।

এর মানে, আপনি যেখান থেকেই টাকা আনেন না কেন, টাকার উৎস সম্পর্কে প্রশ্ন করা হবে না।

আয়কর অধ্যাদেশে ১৯ডিডি ধারায় শিল্প খাতে কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। হাইটেক পার্ক ও অর্থনৈতিক অঞ্চলে ১০ শতাংশ কর দিয়ে কালোটাকা সাদা করার সুযোগ ২০২৪ সাল পর্যন্ত রয়েছে। অর্থের উৎস সম্পর্কে কোনো প্রশ্ন করবে না এনবিআর।

স্বেচ্ছায় ঘোষণা

কয়েক বছর আগে আয়কর অধ্যাদেশে ১৯ই নামে একটি ধারা যুক্ত করা হয়। সেখানে বলা হয়, কোনো করদাতা স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হয়ে অপ্রদর্শিত আয় ঘোষণায় আনতে পারবেন। এ জন্য অপ্রদর্শিত অর্থের ওপর ২৫ শতাংশ কর (ওই বছরের সর্বোচ্চ করহার) এবং ওই করের ওপর ১০ শতাংশ জরিমানা অর্থাৎ সাড়ে ২৭ শতাংশ কর দিয়ে ঘোষণায় আনা যাবে। এত দিন ধরে এই টাকার উৎস জানতে চাওয়া হবে কি না, তা স্পষ্ট করা হয়নি। এবার পরিষ্কার করে বলা হতে পারে, এই প্রক্রিয়ায় টাকা সাদা করলে এনবিআর বা অন্য কোনো সংস্থা টাকার উৎস সম্পর্কে প্রশ্ন করবে না।

১৯ই ধারার শেষের দিকে বলা হয়েছে, অপ্রদর্শিত অর্থ দিয়ে আয়বর্ধক খাতে যেমন শিল্পকারখানা, ব্যবসা-বাণিজ্য, জমি, ফ্ল্যাট, শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করা থাকে, তা–ও দেখানো যাবে। এর মানে, শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করা কালোটাকার ওপর সাড়ে ২৭ শতাংশ কর দিলেই সাদা হবে। শেয়ারবাজারে কালোটাকা সাদা করার সুযোগে তেমন সাড়া মেলে না। যেমন মাত্র ১০ শতাংশ কর দিয়ে চলতি অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে মাত্র ৩৪১ জন শেয়ারবাজারে কালোটাকা সাদা করেছেন। এখন প্রশ্ন হলো সাড়ে ২৭ শতাংশ কর দিয়ে শেয়ারবাজারে টাকা সাদা করায় কত বিনিয়োগকারী উৎসাহী হবেন? আবার কালোটাকা কেনায় জমি-ফ্ল্যাটেও সাড়ে ২৭ শতাংশ কর দিলে দায়মুক্তি মিলবে।

এক দশকে সবচেয়ে বেশি কালোটাকা সাদা

প্রায় প্রতিবছর কালোটাকা সাদা করার সুযোগ থাকলেও গত এক দশকের মধ্যে এবারই বেশি কালোটাকা সাদা হয়েছে। নগদ টাকা সাদা করায় বেশি আগ্রহ করদাতাদের। চলতি অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে সব মিলিয়ে ১০ হাজার ৩৪ জন করদাতা কালোটাকা সাদা করেছেন। সব মিলিয়ে প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকা সাদা হয়েছে। শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করে কালোটাকা সাদা করার সুযোগ তেমন একটা নেননি করদাতারা। গত জুলাই থেকে মার্চ মাস পর্যন্ত মাত্র ৩৪১ জন শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করে এই সুযোগ নিয়েছেন। জমি কিনেও খুব একটা কালোটাকা সাদা হয়নি।