কালোটাকার মালিকদের জন্য কোন সরকারের কত ভালোবাসা

কালো টাকা সাদা করা নিয়ে সাবেক অর্থমন্ত্রীর বক্তব্য ধরে ফাইল কার্টুন

বাংলাদেশে কালোটাকা সাদা করার আগ্রহ সব সরকারেরই। সারা কম, তারপরও সুযোগ দেওয়ার ক্ষেত্রে উৎসাহের অভাব ছিল না সরকারগুলোর। দেখা গেছে, সুযোগ থাকলেও খুব কম টাকাই বৈধ হয়েছে। বরং কালোটাকা পাচার হয়েছে বেশি। সুযোগ দিতে সরকারের উদ্যোগ যতটা, কালোটাকার মালিকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ায় ক্ষেত্রে নেই ততটা তৎপরতা।

জিয়া ও এরশাদ আমলের চিত্র

জিয়াউর রহমান


এরপর ১৯৮১-৮২ অর্থবছরের বাজেটে একটু ভিন্নভাবে কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া হয়। সে সময় অর্থমন্ত্রী এম সাইফুর রহমান বলেছিলেন, এক লাখ টাকা পর্যন্ত ব্যবসায়ে পুঁজি বিনিয়োগকারী নতুন করদাতারা যদি তাঁদের পুঁজির কমপক্ষে এক-চতুর্থাংশ নিট আয় দেখান, তাহলে এ পুঁজি বিনিয়োগের উৎস নিয়ে প্রশ্ন করা হবে না।

এরপর আবার সামরিক আইন। ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ সামরিক আইন জারি করেন লে. জেনারেল এরশাদ। সামরিক আইনের ৫ নং ধারায় ১৫ শতাংশ কর দিয়ে কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া হয়। এই সুযোগ ছিল টানা ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত।

এরশাদের আমলেই ১৯৮৭-৮৮ অর্থবছরের বাজেটে সে সময়কার অর্থমন্ত্রী এম সাইদুজ্জামান ঘোষণা দিয়েছিলেন, ‘কোম্পানি ছাড়া অন্যান্য করদাতা ৮৭-৮৮ কর নির্ধারণী বছরের আয়কর রিটার্নে অন্যান্য সূত্র থেকে প্রাপ্ত আয় খাতে যেকোনো অঙ্কের আয় দেখিয়ে শতকরা ২০ ভাগ হারে আয়কর প্রদান করলে কোনো প্রশ্ন করা ছাড়াই তা গ্রহণ করা হবে।’ এ সময় ২০০ কোটি কালোটাকা সাদা হয় এবং তাতে সরকার রাজস্ব পায় ৪০ কোটি টাকা।

হুসেইন মোহাম্মদ এরশাদ

এর পরও এরশাদ সরকার পরপর দুই অর্থবছরে একই সুযোগ রেখে দিয়েছিল। তবে নিয়মকানুন আরও সহজ করে দেওয়া হয়েছিল। বাজেটেই ঘোষণা দেওয়া হয়, ১০ শতাংশ কর দিয়ে শিল্পে বিনিয়োগ করলে বিনা প্রশ্নে তা মেনে নেওয়া হবে। এই সুযোগ নিয়ে ১৯৮৮-৮৯ অর্থবছরে ২৫০ কোটি টাকা সাদা হয় এবং সরকার আয় করে ২৫ কোটি টাকা। ১৯৮৯-৯০ অর্থবছরেও একই সুযোগ বহাল রাখা হয়। এই অর্থবছরেই বরং তুলনামূলকভাবে বেশি অর্থ সাদা হয়। এ সময় সব মিলিয়ে ৪০০ কোটি টাকা সাদা হয় আর তাতে সরকার কর পায় ৪০ কোটি টাকা।

বিরল পাঁচ বছর

আন্দোলনের মুখে ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর এরশাদের পতনের পর নির্বাচন শেষে সরকার গঠন করে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)। নতুন সরকারের প্রথম বাজেট ছিল ১৯৯১-৯২ অর্থবছরের বাজেট। বাজেটে নতুন অর্থমন্ত্রী এম সাইফুর রহমান বলেছিলেন, ‘বিগত বছরগুলোতে কালোটাকা বৈধ করার যে ধরনের বৈষম্যমূলক কর দায়মুক্তির সুবিধা দেওয়া হয়েছে, আমি দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে ঘোষণা করছি যে এ ধরনের গণতান্ত্রিক ও গোষ্ঠী স্বার্থপ্রসূত বৈষম্যমূলক করনীতি আমাদের এ গণতান্ত্রিক সরকার সম্পূর্ণ পরিহার করবে।’ সে কথা তিনি রেখেছিলেন, পাঁচ বছরে আর এ ধরনের সুযোগ দেওয়া হয়নি।

আবার সেই পুরোনো ধারা

এরপর আওয়ামী লীগের সময় প্রায় প্রতিবছরই নানাভাবে কালোটাকা সাদা করার সুযোগ বহাল থাকে। নতুন অর্থমন্ত্রী শাহ এ এম এস কিবরিয়ার সময়ে দুভাবে কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া হয়েছিল। যেমন ১৯৯৭-৯৮ অর্থবছরের বাজেটে বলা হয়েছিল, ‘১৯৯৭ সালের ১ জুন থেকে ১৯৯৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত কেউ নতুন শিল্পে বিনিয়োগ করলে কোনো প্রশ্ন করা হবে না। তবে সাড়ে ৭ শতাংশ হারে কর দিলে তাঁকে কর অবকাশসুবিধা দেওয়া হবে। এ ছাড়া ২৫ লাখ টাকা পর্যন্ত পুঁজি বিনিয়োগকারী নতুন করদাতারা যদি তাঁদের পুঁজির কমপক্ষে এক-চতুর্থাংশ আয় দেখান, তাহলেও এর উৎস নিয়ে প্রশ্ন করা হবে না।’

তবে ১৯৯৮-৯৯ অর্থবছরের বাজেটে শাহ এ এম এস কিবরিয়া স্বীকার করে নেন যে কালোটাকা সাদা করার এই সুযোগ দিলেও এতে তেমন কোনো কাজ হয়নি। তিনি বলেন, ‘বিনিয়োগের ক্ষেত্র কেবল নতুন শিল্পতে সীমিত রাখার কারণে করদাতাদের নিকট হতে তেমন আশাব্যঞ্জক সাড়া পাওয়া যায়নি। বিনিয়োগের পরিধি সম্প্রসারিত হলে কর অনারোপিত অর্থ বিনিয়োগে অনুকূল সাড়া পাওয়া যাবে বলে আশা করা যায়। এ প্রেক্ষিতে বিদ্যমান শিল্প ইউনিটের বিএমআরই এবং শিল্প ঋণ পরিশোধের ক্ষেত্রেও বিনিয়োজিত অর্থের ওপর ৭.৫ শতাংশ হারে কর প্রদান সাপেক্ষে এ বিধান প্রযোজ্য করার প্রস্তাব করছি।’ এ ছাড়া এই অর্থবছরের বাজেটেই ১৯৯৯ সালের ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে ৭.৫ শতাংশ হারে কর দিলে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করা অর্থ বিনা প্রশ্নে মেনে নেওয়ার কথাও বলা হয়।

শাহ এ এম এস কিবরিয়া

১৯৯৯-২০০০ অর্থবছরের বাজেটে অবশ্য অভিনব কিছু উপায়ে কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া হয়েছিল। বলা যায়, বিলাসবহুল গাড়ি কেনার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় উৎসাহ প্রদান এ সময় থেকেই ঘোষণা দিয়ে শুরু। যেমন ২০০০ সিসির ওপরে বিলাসবহুল গাড়ি এবং ৩০০০ সিসির ওপরে জিপ নিবন্ধনের সময় গাড়ির মূল্যের ৫ শতাংশ অথবা ৫০ হাজার টাকা (দুয়ের মধ্যে যেটি বেশি) আয়কর দিলে তা বিনা প্রশ্নে মেনে নেওয়া হবে। এ ছাড়া বাড়ি ও অ্যাপার্টমেন্ট কিনে প্রতি বর্গমিটার অনুযায়ী আয়কর দিলে তাও বিনা প্রশ্নে মেনে নেওয়ার কথা বলা হয়েছিল বাজেটে। একই ভাবে যাত্রীবাহী নৌযান, তাপানুকূল বিলাসবহুল বাসসহ সব ধরনের নতুন যানবাহনের ক্ষেত্রেও নির্দিষ্ট হারে কর দিয়ে কালোটাকা সাদা করার সুযোগ রাখা হয়।

২০০০-২০০১ সালের বাজেটেও আয়করের পরিমাণ সামান্য সংশোধন করে এসব সুবিধা অব্যাহত রাখা হয়। পাশাপাশি নতুন একটি ঘোষণা দেওয়া হয়। অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘দেশে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ অপ্রদর্শিত আয় বিদ্যমান আছে বলে ধারণা করা যায়। ইতিপূর্বে অপ্রদর্শিত আয় বিনিয়োগ করার সুযোগ দেওয়া হলেও ঘোষণার ক্ষেত্রে বিভিন্ন শর্ত রাখায় আশাব্যঞ্জক সাড়া পাওয়া যায়নি। বিষয়টি সার্বিক বিবেচনা করে ১ জুলাই ২০০০ হতে ৩০ জুন ২০০১ সময়বৃত্তে কোনো প্রকার শর্ত ব্যতিরেকে ১০ শতাংশ হারে আয়কর প্রদান সাপেক্ষে অপ্রদর্শিত আয় ঘোষণার সুযোগ দেওয়ার প্রস্তাব করা হলো। কর বিভাগ কোনো প্রশ্ন ব্যতিরেকে এরূপ ঘোষণা গ্রহণ করবে।’ এই ঘোষণায় সে সময়ে সব মিলিয়ে ১০০০ কোটি টাকা সাদা হয়েছিল। আর ১০% হারে সরকার রাজস্ব পায় ১০০ কোটি টাকা।

অবশেষে তিনিও

এরপর আবার ক্ষমতার পালাবদলের পালা। আবার অর্থমন্ত্রী হন বিএনপির এম সাইফুর রহমান। আগেরবার যিনি কালোটাকা সাদা করা সুযোগকে ‘গণতান্ত্রিক ও গোষ্ঠী স্বার্থপ্রসূত বৈষম্যমূলক করনীতি’ বলে আখ্যা দিয়েছিলেন, এমনকি হারামও বলেছিলেন। সেই তিনিই সেবার অবাধে কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দেন।

তিনি ২০০২-০৩ অর্থবছরের বাজেট বক্তৃতায় বলেন, ‘আমাদের অর্থনীতিতে বিপুল অঙ্কের কর অনারোপিত আয় রয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এ ধরনের আয় বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বর্তমানে কোনো বিশেষ সুবিধা না থাকায় করদাতারা যেমন একদিকে এ আয় ঘোষণায় উৎসাহিত হচ্ছেন না এবং অন্যদিকে তা উৎপাদনশীল খাতেও বিনিয়োগ হচ্ছে না। যার ফলে শিল্পায়নসহ উৎপাদনশীল কর্মকাণ্ডে প্রত্যাশিত গতিশীলতা আসছে না। করনীতির অন্যতম উদ্দেশ্য হচ্ছে সামাজিক ও অর্থনৈতিক অগ্রাধিকারভিত্তিক খাতসমূহের দিকে বিনিয়োগকে প্রবাহিত করা। ইতিপূর্বে একাধিকবার কর অনারোপিত আয় ঘোষণার বেলায় যে আংশিক কর অব্যাহতি দেওয়া হয়েছিল, তাতে বিনিয়োগের কোনো দিকনির্দেশনা না থাকায় এতে কাঙ্ক্ষিত সাড়া পাওয়া যায়নি। তাই, আমি এ লক্ষ্যে ব্যক্তি, ফার্ম, ব্যক্তিসংঘ এবং প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানি কর্তৃক ১ জুলাই ২০০২ থেকে ৩০ জুন ২০০৫ পর্যন্ত কোনো পণ্য বা সেবা উৎপাদনে নিয়োজিত ব্যবসা, শিল্প ও বাণিজ্যিক উদ্যোগে যেকোনো অঙ্কের বিনিয়োগকে বিনা প্রশ্নে এবং শর্তহীনভাবে গ্রহণের বিধান রাখার প্রস্তাব করছি।’

এম সাইফুর রহমান
এম সাইফুর রহমান একবার কালোটাকা সাদা করা সুযোগকে ‘গণতান্ত্রিক ও গোষ্ঠী স্বার্থপ্রসূত বৈষম্যমূলক করনীতি’ বলে আখ্যা দিয়েছিলেন।

২০০৩-২০০৪ অর্থবছরে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগকেও বিনা প্রশ্নে গ্রহণ করার সুযোগ দেওয়া হয়। এই সুযোগ ২০০৫ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে বলেও জানানো হয়। আবার বাজেটে উল্লেখ না থাকলেও ২০০৪ সালের আগস্টে এনবিআর যে পরিপত্র জারি করে তাতে দেখা যায়, ২০০৪-০৫ সময়ের জন্য গাড়ি কিনলে কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। পরিপত্রে বলা হয়েছিল, ১৫০০ সিসি পর্যন্ত ক্ষমতার গাড়ির ক্রয়মূল্যের ওপর ৫ শতাংশ এবং ১৫০০ সিসির বেশি ক্ষমতার গাড়ির ক্ষেত্রে ক্রয়মূল্যের ৭.৫ শতাংশ হারে কর দিলে গাড়ি কেনার অর্থের উৎস জানতে চাওয়া হবে না। তবে বাংলাদেশে প্রথম নিবন্ধন ও ২০০৪-০৫ অর্থবছরের কেনা গাড়ির ক্ষেত্রে এই বিধান প্রযোজ্য হবে।

২০০২ সালের জুলাই থেকে ২০০৫ এর জুন পর্যন্ত সময়ে প্রায় ১ হাজার ৭৭৫ কোটি টাকা সাদা হয়। আর এই সুযোগ নিয়েছিলেন ১ হাজার ৭৭ জন। এ সময় কোনো করহার নির্ধারণ করে না দেওয়ায় সরকার একটি টাকাও আয় করতে পারেনি।

আগের ঘোষণা অনুযায়ী কালোটাকা সাদা করার মেয়াদ ২০০৫ সালের জুনেই শেষ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ২০০৫-০৬ অর্থবছরের বাজেটে আবার এই সুযোগ রাখেন এম সাইফুর রহমান। তিনি বলেন, ‘দেশে বিপুল পরিমাণ অপ্রদর্শিত আয় আছে বলে বিভিন্ন মহল থেকে বলা হচ্ছে। এ ধরনের অপ্রদর্শিত আয় কোনো ব্যাখ্যা ছাড়াই বিনিয়োগ করার যে সুবিধা দেওয়া হয়েছিল তা ৩০ জুন ২০০৫ শেষ হবে। ধারণা করা হচ্ছে, এখনো অনেকের নিকট অপ্রদর্শিত আয় রয়েছে কিন্তু তাঁরা বিদ্যমান সুযোগ কোনো না কোনো কারণে গ্রহণ করতে পারেননি।’ এ কথা বলে তিনি এই সুযোগ আরও এক বছরের জন্য বাড়ান। তবে এ জন্য ৭.৫ শতাংশ কর নির্ধারিত করে দেওয়া হয়।

এ ছাড়াও এ সময় পুনর্নির্ধারিত হারে কর দিয়ে বাড়ি বা ফ্ল্যাট নির্মাণে বিনিয়োগ বিনা ব্যাখ্যায় নেওয়ার সুবিধাও নতুন অর্থবছরে বহাল থাকছে বলে জানানো হয়। যেমন, (ক) ২০০ বর্গমিটার পর্যন্ত বাড়ি নির্মাণ বা অ্যাপার্টমেন্ট কেনার ক্ষেত্রে প্রতি বর্গমিটার ২০০ টাকা (খ) ২০০ বর্গমিটার বা এর অধিক পর্যন্ত বাড়ি নির্মাণ বা অ্যাপার্টমেন্ট কেনার ক্ষেত্রে প্রতি বর্গমিটার ৩০০ টাকা দিয়ে কালোটাকা সাদা করা যাবে।
৭.৫ শতাংশ হারে কর দিয়ে কালোটাকা সাদা করার এই সুযোগ নিয়েছিলেন ৭ হাজার ২৫২ জন। আর সাদা হওয়া অর্থের পরিমাণ ছিল ৪ হাজার ৬০৩ কোটি টাকা। আর এতে সরকার কর পায় ৩৪৫ কোটি টাকা।

ভয়ের সময়

২০০৭ সালে জরুরি অবস্থা জারির পর আবারও কালোটাকা বৈধ করার সুযোগ দেওয়া হয়। ৪ জুন এই সুযোগ দিয়ে বলা হয় আগামী ৩১ জুলাই পর্যন্ত অপ্রদর্শিত অর্থ বৈধ করা যাবে। এর মধ্যে সুযোগ না নিলে সর্বোচ্চ ২৫০ শতাংশ পর্যন্ত জরিমানা করার কথাও বলা হয়। পরে এই সময় ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বাড়ানো হয়। তবে সরকারিভাবে কালো টাকা না বলে সে সময়ে অপ্রদর্শিত অর্থ বলা হয়েছিল। কারা কারা সুযোগ পাবেন, তা-ও নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়েছিল। যেমন যাঁদের করযোগ্য আয় আছে অথচ আয়কর রিটার্ন দাখিল করেননি বা টিআইএনভুক্ত হননি; টিআইএনভুক্ত করদাতাদের মধ্যে যাঁরা আগের অর্থবছরের রিটার্ন দাখিল করেছেন কিন্তু ২০০৬-০৭ করবছরের কর নির্ধারণ সম্পন্ন হয়নি; এবং টিআইএনভুক্ত যাঁদের ২০০৬-০৭ করবছরের কর নির্ধারণ সম্পন্ন হয়ে গেছে তাঁরা। অন্যান্য বারের তুলনায় ব্যতিক্রম হচ্ছে সরকার বলে দিয়েছিল অবৈধ উপায়ে অর্জিত আয় বৈধ করা যাবে না।

সে সময় মানুষ মূলত ভয়েই এই সুযোগটি বেশি নেন। সরকার যখন শুরুতে এই সুযোগের ঘোষণা দিয়েছিল, তখন এক ধরনের ভীতিকর পরিস্থিতি ছিল দেশে। বড় বড় রাজনৈতিক নেতা ও ব্যবসায়ীদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছিল। ফলে যেকোনো ধরনের কালোটাকা থাকলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে—এ রকম একটি ধারণা অনেকের মধ্যেই ছিল। অপ্রদর্শিত অর্থ বৈধ করার সেই সুযোগ নেয় ৩২ হাজার ৫৫৮ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান। আর এতে বৈধ হয় ৩ হাজার ৭৭৫ কোটি টাকা এবং সরকার রাজস্ব পায় ৬৮৭ কোটি ৪৩ লাখ টাকা।

কালোটাকার মহোৎসব

নির্বাচিত হয়ে ২০০৯ সালে সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগ। নতুন সরকারও বাজেটের মাধ্যমে কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দেয়। ২০০৯ সালের ১২ জুন বাজেট-পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে নতুন অর্থমন্ত্রী এ এম এ মুহিত কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়ার পক্ষে যুক্তি তুলে ধরে বলেছিলেন, ‘কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া নৈতিকভাবে সমর্থনযোগ্য নয়। তারপরও এই সুযোগ দেওয়া হচ্ছে রাজনৈতিকভাবে সর্বোচ্চ সমঝোতা। কেননা, রাজনীতি হলো আপসের সবচেয়ে নিপুণ কৌশল। রাজনীতিতে সব ধরনের মানুষ ও সব ধরনের স্বার্থকে সমন্বয় করে চলতে হয়।’

২০০৯-১০ অর্থবছরের এই বাজেটে ১০ শতাংশ হারে কর দিয়ে পুঁজিবাজার, বেশ কিছু শিল্প ও ভৌত অবকাঠামো খাতে অপ্রদর্শিত আয় বিনিয়োগের সুযোগ রাখা হয়। একই সঙ্গে ফ্ল্যাট ক্রয় ও নিজের বাড়ি তৈরির ক্ষেত্রে আয়ের উৎস বিনা প্রশ্নে মেনে নেওয়ার কথা বলা হয়। এ ক্ষেত্রে ফ্ল্যাট ও বাড়ির পরিমাপের ভিত্তিতে কর দিতে হবে।

প্রথমে তিন অর্থবছরের জন্য এ সুযোগ দেওয়ার কথা বলা হলেও ব্যাপক সমালোচনার মুখে তা কমিয়ে এক অর্থবছর করা হয়। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বাজেট বক্তৃতায় বলেছিলেন, ‘আমরা সাধারণ মানুষের জন্য কর্মসংস্থানের সুযোগকে যেমন অবারিত করতে চাই, তেমনি ব্যাপক জনগণের কর্মসংস্থানের পাশাপাশি অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জন করতে চাই। এমন অনেক সম্ভাবনাময় খাত রয়েছে, যা আমাদের দিনবদলের প্রচেষ্টাকে এগিয়ে নিতে পারে। এ লক্ষ্যে কিছু নতুন শিল্প, ভৌত অবকাঠামো খাত ও পুঁজিবাজারে বিনিয়োগকৃত অপ্রদর্শিত অর্থের ওপর ১০ শতাংশ হারে কর প্রদান সাপেক্ষে বিনা প্রশ্নে মেনে নেওয়ার প্রস্তাব করছি।’

আবুল মাল আবদুল মুহিত
কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া হচ্ছে রাজনৈতিকভাবে সর্বোচ্চ সমঝোতা। কেননা, রাজনীতি হলো আপসের সবচেয়ে নিপুণ কৌশল।
আবুল মাল আবদুল মুহিত, সাবেক অর্থমন্ত্রী

১ হাজার ৯২৩ জন ব্যক্তি এই সুযোগ নিয়ে ৯২২ কোটি ৯৮ লাখ ৮ হাজার ৯৭২ টাকা বৈধ করেছিলেন। এর মধ্যে নতুন শিল্প ও ভৌত অবকাঠামো নির্মাণ খাতে বিনিয়োগ দেখিয়ে টাকা বৈধ করেন ১৬২ জন। সম্মিলিতভাবে তাঁদের প্রদর্শিত অর্থের পরিমাণ ছিল ২৩৯ কোটি ২ লাখ ৬১ হাজার ৮২১ টাকা। এ থেকে সরকারের রাজস্ব আয় হয়েছে ২৩ কোটি ৯০ লাখ টাকা। পুরোনো শিল্প পুনর্গঠন ও সম্প্রসারণে ১৪৫ জন ব্যক্তি ২৫৭ কোটি টাকা বিনিয়োগ দেখিয়ে কর দেন ২৪ কোটি ৭২ লাখ টাকা। পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করে অপ্রদর্শিত অর্থ বৈধ করেন ২৯৬ জন। তাঁরা ৪২৬ কোটি ৬৭ লাখ টাকা বিনিয়োগ করেন এবং এ থেকে সরকারের রাজস্ব আদায় হয়েছে ৪২ কোটি ৬৬ লাখ টাকা। ফ্ল্যাট বা বাড়ি কিনে টাকা বৈধ করার সুযোগ নেন ১ হাজার ৩২০ জন। আর এ খাত থেকে সরকার রাজস্ব পায় ২৮ কোটি ৯১ লাখ টাকা।

এরপর ২০১০-১১ অর্থবছরর বাজেটেও কালোটাকা বা অপ্রদর্শিত অর্থ বিনিয়োগের সুযোগ দেওয়া হয়েছে। ভৌত অবকাঠামো উন্নয়নের লক্ষ্যে ‘বাংলাদেশ অবকাঠামো বিনিয়োগ তহবিলের’ আওতায় ১০ শতাংশ হারে কর দিয়ে বিনিয়োগ করলে এ সুযোগ পাওয়া যাবে। আয়কর আইনের ১৯-সি নামে নতুন একটি ধারা যুক্ত করে দেওয়া এ সুবিধা ২০১২ সাল পর্যন্ত থাকবে।

আওয়ামী লীগ সরকারের প্রথম মেয়াদে (২০০৯-২০১৩) সব মিলিয়ে ১ হাজার ৮০৫ কোটি টাকা সাদা হয়েছে। ওই সময়ে একবার নগদ টাকার পাশাপাশি শেয়ারবাজারে বিনিয়োগের সুযোগ দেওয়া হয়েছিল। দ্বিতীয় মেয়াদে ২০১৪ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত ৪ হাজার ৮৫৬ কোটি টাকা সাদা হয়েছে। বেশ কিছু শিল্প খাতে কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া হয়। অর্থনৈতিক অঞ্চল ও হাইটেক পার্কে ২০২৪ সাল পর্যন্ত কালোটাকা বিনিয়োগ করার সুযোগ আছে। এ ছাড়া আওয়ামী লীগের ওই আমলে আবাসন খাতে কালো টাকার সুযোগ ছিল। আর অপ্রদর্শিত বৈধ আয় নিয়মিত করের সঙ্গে ১০ শতাংশ জরিমানা দিয়ে ঘোষণার সুযোগ দেওয়া হয়। আর ২০১৭ সালের পরে তিন বছরে (২০২০ সালের জুন মাস পর্যন্ত) ২২৩ জন ফ্ল্যাট কিনে কালোটাকা সাদা করেছেন।

আ হ ম মুস্তফা কামাল

আর এর পরের আট মাসে (জুলাই থেকে ফেব্রুয়ারি) শেয়ারবাজার, নগদ টাকা কিংবা জমি-ফ্ল্যাট কিনে সব মিলিয়ে ৯ হাজার ৯৩৪ জন কালোটাকা সাদা করেছেন। সব মিলিয়ে এনবিআর রাজস্ব পেয়েছে ১ হাজার ৩৮৬ কোটি টাকা। এতে ১২ হাজার কোটি টাকার বেশি নগদ বা ব্যাংক-সঞ্চয়পত্রে গচ্ছিত টাকা ঘোষণায় এসেছে। ঢালাও এই সুযোগ দিয়েছেন বর্তমান অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল

সংবিধানের ২০ (২) নম্বর অনুচ্ছেদে বলা আছে, ‘রাষ্ট্র এমন অবস্থা সৃষ্টির চেষ্টা করিবেন, যেখানে সাধারণ নীতি হিসাবে কোনো ব্যক্তি অনুপার্জিত আয় ভোগ করিতে সমর্থ হইবেন না।’

সুতরাং বলা যায়, প্রায় প্রতিটি সরকারই মহা উৎসাহে সংবিধান লঙ্ঘন করে চলছে।