কে পাবেন ৫০ লাখ টাকা, মাধবী দাস নাকি অহনা

করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন চিকিৎসক জীবেশ কুমার প্রামাণিক

সরকারি ঘোষণা অনুযায়ী করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মৃত চিকিৎসক জীবেশ কুমার প্রামাণিকের পরিবার ক্ষতিপূরণের ৫০ লাখ টাকা পাওয়ার কথা। কিন্তু টাকার দাবিদার এখন দুটি পক্ষ। তাই প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, কে পাবেন এই টাকা? এক পক্ষে রয়েছেন জীবেশ কুমার প্রামাণিকের বর্তমান বিধবা স্ত্রী মাধবী দাস, অন্যদিকে আছেন তাঁর প্রথম পক্ষের কন্যা নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী অহনা অরুণিমা। অহনা অরুণিমার মা শাওলী বিশ্বাসও একজন চিকিৎসক। তিনি জীবেশ কুমার প্রামাণিকের প্রথম স্ত্রী।

স্ত্রী ও সন্তানের মধ্যকার উত্তরাধিকারজনিত জটিলতায় টাকা ছাড় করতে পারছে না অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ। অথচ অর্থ বিভাগের জারি করা পরিপত্র অনুযায়ী, সরকারি কোষাগার থেকে এ টাকা পাওয়ার কথা মৃতের স্ত্রী ও সন্তান। অর্থ বিভাগ গত ১৬ মে মাধবী দাসের অনুকূলে ৫০ লাখ টাকার ক্ষতিপূরণ মঞ্জুরি হয়েছে বলে প্রধান হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা এবং স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিবকে চিঠি দিয়ে জানিয়েছে। চিঠিতে অর্থ বিভাগের যুগ্ম সচিব মোহাম্মদ আবু ইউসুফের স্বাক্ষর রয়েছে। অর্থ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, চেকও প্রস্তুত। কিন্তু বিভ্রান্তিতে পড়ে শেষ পর্যন্ত চেক আটকে রাখা হয়েছে।

অর্থ বিভাগের দায়িত্বশীল পর্যায়ের কেউ অবশ্য এ ব্যাপারে কথা বলতে চাননি। এদিকে অর্থসচিব আবদুর রউফ তালুকদারের কাছে ৫০ লাখ টাকার চেক চেয়ে বারবার আবেদন করছেন মাধবী দাস। সর্বশেষ আবেদনটি করেছেন গত ৩০ জুন।

বগুড়ার শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজে কর্মরত অবস্থায় চিকিৎসক জীবেশ কুমার প্রামাণিক করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হন গত বছরের ১৬ নভেম্বর। অবস্থার অবনতি ঘটলে এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে করে বগুড়া থেকে এনে তাঁকে ঢাকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ) ভর্তি করা হয়েছিল গত ২১ নভেম্বর। দেড় মাস চিকিৎসাধীন থেকে গত ৬ জানুয়ারি মারা যান জীবেশ কুমার প্রামাণিক।

ক্ষতিপূরণের টাকা না পাওয়ার পেছনে জীবেশ কুমার প্রামাণিকের প্রথম স্ত্রী শাওলী বিশ্বাস (তিনিও চিকিৎসক) ও তাঁর কন্যা অহনা অরুণিমার প্রভাব রয়েছে বলে মনে করেন মাধবী দাস। অর্থ মন্ত্রণালয়ে করা আবেদনে মাধবী দাস বলেছেন, ‘অহনা অরুণিমা একটি কুচক্রী মহলের মিথ্যা প্রলোভনে মন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন অফিসে আমাকে হয়রানি করার জন্য নিজেকে ওয়ারিশ দাবি করে আসছে।’

মাধবী দাস আবেদনে আরও জানান, ‘শাওলী বিশ্বাসের সঙ্গে বিবাহবিচ্ছেদের সময় কন্যা অহনা অরুণিমার নামে ২০১৬ সালের ৪ আগস্ট ৪০ লাখ টাকা দিয়ে গেছেন জীবেশ কুমার প্রামাণিক। আর নিজস্ব বাড়ি না থাকায় বৃদ্ধা শাশুড়িকে নিয়ে আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে মানবেতর জীবন যাপন করছি আমি।’

উভয় মতামতেই বলা হয়েছে, হিন্দু দায়ভাগ আইন অনুযায়ী মৃত ব্যক্তির ওয়ারিশ হবেন ১.পুত্র, ২.পৌত্র, ৩.প্রপৌত্র, ৪.বিধবা স্ত্রী, ৫.কন্যা, ৬.দৌহিত্রসহ মোট ৫৩ জন। যেহেতু ১ থেকে ৩ নম্বর ক্রমিকের ওয়ারিশ বিদ্যমান নেই, ফলে ৪ নম্বর ওয়ারিশ মাধবী দাস সম্পত্তির ভাগীদার হবেন।

এ বিষয়ে কথা বলতে মাধবী দাসের মুঠোফোনে ছয়বার ফোন করেও তাঁকে না পেয়ে খুদে বার্তা পাঠানো হয়। পরে পাল্টা ফোন করে গত রোববার একজন ব্যক্তি নিজের পরিচয় না দিয়ে প্রথম আলোকে বলেন, মাধবী দাস এ ব্যাপারে কথা বলতে রাজি নন।
অর্থ বিভাগের পরিপত্র অনুযায়ী, করোনায় সংক্রমিত হয়ে স্বামী মারা গেলে স্ত্রী ও সন্তান পাবেন ক্ষতিপূরণের টাকা। আর হিন্দু দায়ভাগ আইন অনুযায়ী তা পাবেন মৃতের স্ত্রী। এ বিষয়ে নাটোর জেলা জজ কোর্টের আইনজীবী প্রসাদ কুমার তালুকদার এবং বগুড়া জজ কোর্টের আইনজীবী দেবাশীষ রায় আলাদাভাবে মতামত দিয়েছেন। অর্থসচিবের কাছে পাঠানো আবেদনে উভয় মতামতের কপি সংযুক্ত করেছেন মাধবী দাস।

উভয় মতামতেই বলা হয়েছে, হিন্দু দায়ভাগ আইন অনুযায়ী মৃত ব্যক্তির ওয়ারিশ হবেন ১.পুত্র, ২.পৌত্র, ৩.প্রপৌত্র, ৪.বিধবা স্ত্রী, ৫.কন্যা, ৬.দৌহিত্রসহ মোট ৫৩ জন। যেহেতু ১ থেকে ৩ নম্বর ক্রমিকের ওয়ারিশ বিদ্যমান নেই, ফলে ৪ নম্বর ওয়ারিশ মাধবী দাস সম্পত্তির ভাগীদার হবেন। ৫ নম্বর ক্রমিকধারী কন্যা অহনা অরুণিমা কোনো সম্পত্তি পাবেন না। আর সমঝোতার মাধ্যমে দাম্পত্য সম্পর্ক ছিন্ন করায় শাওলী বিশ্বাস কিছুই পাবেন না।

মুঠোফোনে যোগাযোগ করলে অহনা অরুণিমা গত রোববার প্রথম আলোকে বলেন, বাবার একমাত্র কন্যা হিসেবে তিনি ৫০ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণের একাংশের দাবিদার।
অহনার মা শাওলী বিশ্বাসও প্রথম আলোকে বলেন, হিন্দু দায়ভাগ আইন এখানে প্রযোজ্য হবে না। কারণ, অর্থ বিভাগের পরিপত্র অনুযায়ী আবেদনের ফরমেই বলা আছে ক্ষতিপূরণের টাকার ভাগ পাবে স্ত্রী ও সন্তান। দুই পক্ষের মধ্যে কোনো সমঝোতা হয়েছে কি না, জানতে চাইলে শাওলী বিশ্বাস বলেন, ‘হয়নি। ওই পক্ষ রাজি হচ্ছে না।’
এদিকে ভূমি মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে হিন্দু আইনে উত্তরাধিকার সম্পর্কে মিতাক্ষরা ও দায়ভাগ নামে দুটি মতবাদের কথা উল্লেখ রয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের জন্য প্রযোজ্য হচ্ছে দায়ভাগ মতবাদ। দায়ভাগ মতে সপিণ্ড, সাকুল্য, সমানোদক—এই তিন শ্রেণির উত্তরাধিকারীরা ক্রমান্বয়ে উত্তরাধিকারযোগ্য। আরও বলা হয়েছে, সপিন্ড হচ্ছে প্রথম শ্রেণির ওয়ারিশ। দুই ব্যক্তির মধ্যে একজন অপরজন থেকে পিণ্ডদান বা গ্রহণের অধিকারী হলে ওই ব্যক্তি বা ব্যক্তিদের সপিন্ড বলা হয়। অর্থসচিবের কাছে করা আবেদনে এটিও সংযুক্ত করে দিয়েছেন মাধবী দাস।

এদিকে পুরো বিষয়টি তুলে ধরে জানতে চাইলে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ও বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রানা দাশ গুপ্ত ‍প্রথম আলোকে বলেন, ‘হিন্দু দায়ভাগ আইন অনুযায়ী ক্ষতিপূরণের টাকার অর্ধেক পাবে স্ত্রী, বাকি অর্ধেক পাবে কন্যা। ইউনিয়ন পরিষদ থেকে উত্তরাধিকার সনদ নিয়ে উভয় পক্ষ মন্ত্রণালয়ে আবেদন করলেই এ ঘটনার সুরাহা হয়ে যাবে।’