চকবাজারের ব্যবসায় গতি

চকবাজারে যে শুধু ঢাকার বাইরের ব্যবসায়ীরা পণ্য কিনতে আসেন, তা নয়। মফস্বল থেকে অনেক কুটির ও ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা পণ্য বিক্রি করতেও আসেন।

চকবাজারে নানা ধরনের খেলনা, প্রসাধনী, ইমিটেশন জুয়েলারিসহ বিভিন্ন পণ্য পাওয়া যায়। গত মঙ্গলবার পুরান ঢাকার এই পাইকারি বাজারে ঈদ উপলক্ষে জমজমাট বেচাবিক্রির চিত্র দেখা গেছেছবি: দিপু মালাকার

চকবাজারের ‘নিউ ভাই ভাই কালেকশন’ প্রতিষ্ঠানের স্বত্বাধিকারী জাকির হোসেন। এবারের ঈদে এই পাইকারি ব্যবসায়ীর উদ্দেশ্য কোটি টাকার ইমিটেশন জুয়েলারিকসমেটিকস বিক্রি। সেই অনুযায়ী করেছেন বিনিয়োগ। ১০ রোজা পার না হতেই লক্ষ্যমাত্রার তিন-চতুর্থাংশ পণ্য বিক্রি শেষ। করোনার কারণে গত দুই বছর ভালো ব্যবসা না করতে পারলেও এবার অনেকটা নির্ভার এই ব্যবসায়ী।

জাকির হোসেন বললেন, ‘আমাদের পণ্যের চাহিদা গ্রামগঞ্জে বেশি। রাজধানীর নিউমার্কেট বা গাউছিয়ার মতো বিপণিবিতানে এসব পণ্যের চাহিদা বর্তমানে কম। ঈদসহ অন্য উৎসব এলেই মফস্বলে চাহিদা বাড়ে। আমরাও সেভাবে প্রস্তুতি নিয়ে থাকি। করোনার বিধিনিষেধ না থাকায় শবে বরাতের পর থেকে মফস্বলের ব্যবসায়ীরা চকবাজারে আসতে শুরু করেন। রোজা শুরুর আগেই ৭০ লাখ টাকার ব্যবসা করে ফেলেছি। এখন আবার বেচাবিক্রির গতি কিছুটা কম। আশা করছি, শেষটা সুন্দর হবে।’

গত মঙ্গলবার পুরান ঢাকার চকবাজারের বিভিন্ন মার্কেট ঘুরে দেখা গেল, ঘিঞ্জি এলাকায় সারি সারি দোকান। সেখানকার দোকানে বিভিন্ন ধরনের পণ্য সাজিয়ে বসেছেন পাইকারি বিক্রেতারা। দোকানে থরে থরে সাজানো আছে মাথার ক্লিপ, ব্যান্ড, ব্যাগ, টুথব্রাশ, সাবান, শ্যাম্পু; প্লাস্টিকের খেলনা—তীর-ধনুক, রবারের ক্রিকেট বল, রঙিন চশমা, জুতা, ফিতা, তালা-চাবি ও প্লাস্টিকের ছোট ছোট পণ্য। এ ছাড়া পাইকারিতে বিক্রি হচ্ছে মেয়েদের গলার হার, কানের দুল, হাতের চুড়ি, নাকের নথ, পায়েল, ব্রেসলেটসহ বিভিন্ন ধরনের ইমিটেশন জুয়েলারি। রাস্তার পাশের দোকানগুলোতে ঝুলছে বেলুন, বাঁশি, পিস্তল, বন্দুকসহ নানা রকমের খেলনা। লাটিম, গুলতি ও মার্বেলের মতো ঐতিহ্যবাহী গ্রামীণ খেলনারও দেখা মিলল কয়েকটি দোকানে।

গত দুই বছরের তুলনায় এবার বেচাকেনা ভালো। তবে ব্যবসা কেমন হলো সেটা ২০ রোজা শেষে বলা যাবে
মো. ফয়েজুদ্দিন, সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ মনিহারি বণিক সমিতি

কয়েকজন পাইকারি ব্যবসায়ী জানান, মফস্বলে খুচরা পর্যায়ে বেচাবিক্রি জমে উঠলেও ব্যবসায়ীরা এখনো সশরীর কেনাকাটা করতে চকবাজারে আসছেন। তবে মফস্বলের ক্রেতার বড় অংশই যানজটের কারণে বারবার চকবাজারের আসতে চান না। তাঁরা মুঠোফোনে ক্রয়াদেশ দেন। সে অনুযায়ী কুরিয়ার সার্ভিসে পণ্য পাঠানো হয়। বর্তমানে অধিকাংশ দোকানিই কুরিয়ারে জেলা-উপজেলার পাইকারদের কাছে পণ্য পাঠাতে ব্যস্ত সময় পার করছেন।

সেদিন চকবাজারে পণ্য কিনতে আসেন শরীয়তপুরের খুচরা ব্যবসায়ী নাজিমুদ্দিন। তিনি প্রথম আলোকে বললেন, ‘আমরা মূলত ঈদবাজার বা বিভিন্ন মেলাকেন্দ্রিক ব্যবসা করে থাকি। ঈদের সময় খেলনা আইটেমের বাজার ভালো থাকে। তাই চকবাজারে খেলনা কিনতে এসেছি। কারণ, এখানকার পণ্যে অর্ধেকের বেশি লাভ করা যায়।’

চকবাজারে যে শুধু ঢাকার বাইরের ব্যবসায়ীরা পণ্য কিনতে আসেন, তা নয়। মফস্বল থেকে অনেক কুটির ও ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা পণ্য বিক্রি করতেও আসেন। তারা মূলত চকবাজারের ব্যবসায়ীদের কাছে পাইকারি দামে পণ্য বিক্রি করেন। অনেকে আবার বিক্রি হওয়ার পর অর্থ পাবেন, এমন শর্তেও পণ্য দিয়ে যান।

নাটোর থেকে আসা সাদ্দাম হোসেনকে দেখা গেল দোকানে দোকানে ঘুরে মাটি, বাঁশ ও কাগজ দিয়ে তৈরি গ্রামীণ খেলনা বিক্রি করছেন। তিনি বলেন, ‘আমরা সারা দেশেই খেলনা বিক্রি করি। তবে চকবাজারে এলে পণ্য দ্রুত বিক্রি হয়ে যায়। আজই ৩৫ প্যাকেট (৩ হাজার ৫০০টি) বিক্রি করেছি। বাকি যে খেলনা আছে তার সবই ঈদের আগে চকবাজারে বিক্রি করতে পারবেন বলে জানান তিনি।

চকবাজারে নানা ধরনের খেলনা, প্রসাধনী, ইমিটেশন জুয়েলারিসহ বিভিন্ন পণ্য পাওয়া যায়। গত মঙ্গলবার পুরান ঢাকার এই পাইকারি বাজারে ঈদ উপলক্ষে জমজমাট বেচাবিক্রির চিত্র দেখা গেছে
ছবি: দিপু মালাকার

অবশ্য গ্রামীণ খেলনার চেয়ে প্লাস্টিকের খেলনাই বেশি বিক্রি হয়। ভাই ভাই স্টোরের বিক্রয়কর্মী সালাউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘আমাদের এখানে পাঁচ টাকা থেকে এক হাজার টাকা দামের খেলনা পাবেন। মফস্বলের ক্রেতারাই বেশি আসেন। তাঁরা কম দামের প্লাস্টিকের খেলনা চান। তাই আমরা এবার বেলুন বাঁশি, ফুঁ পাখি, ক্যারকিরি, পাখা চরকি, বাবল, প্লাস্টিকের ঢোল-তবলা ও ম্যাজিক বলের মতো খেলনা আইটেম উঠিয়েছি। বিক্রি হচ্ছে মোটামুটি। আরেকটু ভালো আশা করেছিলাম।’

ঢাকায় ইমিটেশন জুয়েলারি ও কসমেটিকসের বড় পাইকারি বাজার হচ্ছে চকবাজার। পাশের মৌলভীবাজারের কয়েকটি মার্কেটেও এসব দোকান ছড়িয়ে পড়েছে। যদিও অনেক পণ্যের মান নিয়েও আছে প্রশ্ন। তবে বিক্রিবাট্টা ভালোই হচ্ছে। বিসমিল্লাহ স্টোরের জাহাঙ্গীর আলম বলেন, এবার টিউব মেহেদি, নেইল পলিশ, লিপস্টিকের বাজার বেশ ভালো। ঈদের আগ পর্যন্ত আমাদের বেচাকেনা চলবে। তবে ২০ রোজা পর্যন্ত ক্রেতা বেশি থাকে।

মনিহারি পণ্যের পাশাপাশি চকবাজারে আতর, সুরমা, টুপি, তসবি, মেসওয়াক, জায়নামাজ ও পাগড়ি পাইকারি বিক্রি হয়। কয়েক ব্যবসায়ী জানান, এখন পর্যন্ত এসব পণ্য বিক্রির গতি তুলনামূলক কম।

সুন্নতি আতর অ্যান্ড ক্যাপ হাউসের মালিক দুলাল সরকার বলেন, আতর শৌখিন পণ্য। সব সময় বিক্রি হয় না। তবে রোজার মাসে বিক্রি বাড়ে। এবার সেটি হয়নি। করোনার পরে এবার ব্যবসায়ীরা ক্ষতি পুষিয়ে উঠতে চাচ্ছিলেন। কিন্তু পণ্যের চাহিদা কম থাকায় সেটি হয়তো হবে না। তবে ঈদের আগে এক দফা বিক্রি হবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি। পাশের রেজাউল আতর অ্যান্ড ক্যাপ হাউসের মালিক রেজাউল ইসলামও একই কথা বলেন।

চকবাজারের ব্যবসা কেমন চলছে জানতে চাইলে বাংলাদেশ মনিহারি বণিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. ফয়েজুদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, গত দুই বছরের তুলনায় এবার বেচাকেনা ভালো। তবে ব্যবসা কেমন হলো সেটা ২০ রোজা শেষে বলা যাবে।