চিৎকার দিয়ে ওঠে ছেলেটা, ‘বাবা, কী আনছ?’

সনাতন ঋষি

বাংলাদেশ সচিবালয়ে ঢোকার দুটি ফটক। একটি ওসমানী মিলনায়তনের উল্টো দিকে। এটিই প্রধান প্রবেশপথ। আরেকটি পথ জাতীয় প্রেসক্লাবের বিপরীতে। এ পথের সামনে জাতীয় প্রেসক্লাবের এক কোনায় বসে জুতা পালিশের কাজ করেন সনাতন ঋষি (৪০)। পাশেই অগ্রণী ব্যাংকের একটি শাখা।

সনাতন ঋষির গ্রামের বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিশ্বরোড এলাকায়। অভাবের তাড়নায় ঢাকায় এসেছিলেন ২৫ বছর আগে। সেই থেকে জীবনযুদ্ধ করে যাচ্ছেন। একই জায়গায় বসছেন, একই কাজ করছেন। ফাঁকে বিয়ে করেছেন। হয়েছেন তিন মেয়ে ও এক ছেলের বাবা। বিয়েও দিয়েছেন বড় মেয়েকে। দিন ভালোই চলে যাচ্ছিল।

কিন্তু এখন আর চলছে না তাঁর। করোনা আসার পর থেকে কাজ পাচ্ছেন না। জুতা সেলাই করতে কেউ আসছেন না, কালি করতেও না। গতকাল রোববার তাঁর সঙ্গে কথা হয়। বলছিলেন, ‘আমি মানুষের জুতার দিকে চেয়ে থাকি। কারও পায়ে ছেঁড়া জুতা দেখলে মনে মনে খুশি হই। ধুলো পড়া জুতা দেখলেই মনে হয় এই বুঝি কালি করতে বলবেন। আমি দুটো পয়সা পাব। কিন্তু লোকই তো নেই এখন।’

গত বছরের মার্চে যখন করোনা প্রথম এল, কাজ বন্ধ হয়ে যায় সনাতনের। দোকান খুলতে পারেননি অনেক দিন। আস্তে আস্তে পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে এলে সনাতনেরও দিন ফিরছিল। চলতি মাস থেকে আবার খারাপ সময়। সবকিছু বন্ধ। সনাতনের ভাষায়, ‘রাস্তায় মানুষ থাকলে তো পায়ে জুতা থাকবে! মানুষই তো নেই! এখন আর জুতার খোঁজ করি না। আগে দেখি মানুষ আছে কি না।’

সনাতনের অভাবের সংসার। স্ত্রী বাসন্তী ঋষি গৃহিণী। কষ্ট করেও দুই মেয়ে শিমলা ঋষি ও সীমা ঋষি এবং ছেলে গৌরাঙ্গ ঋষিকে স্কুলে পড়াচ্ছেন। ভাগ্য ভালো যে স্কুল এখন বন্ধ। বাড়তি খরচ লাগছে না। সনাতন বলেন, ‘আমি গরিব হলেও পোলাপাইন তো আর মানে না। স্কুলে যাওয়ার সময় টিফিনের টাকা দিতেই হতো।’

ঢাকার কিল্লার মোড়ের বাঁশপট্টিতে পাঁচ হাজার টাকার ভাড়া বাড়িতে সনাতন ঋষির জীবন কাটছে। দুই মাসের ভাড়া বাকি। তিন বেলা খেতেই পারছেন না, ভাড়া দেবেন কোত্থেকে? মানুষ ও মানুষের পায়ের জুতার আশায় প্রতিদিন সকালে হেঁটে প্রেসক্লাবের সামনে সচিবালয়ের গেটে আসেন সনাতন। চাল-ডালের পয়সা রোজগারের আশায় থেকে দিন ফুরিয়ে সন্ধ্যা আসে তাঁর। আবার হেঁটে ঘরে ফেরা। ফেরার সময় তাঁর ভয় শুধু ছেলে গৌরাঙ্গকে। দূর থেকে দেখলেই চিৎকার দিয়ে ওঠে ছেলেটা, ‘বাবা, কী আনছ?’ বলতে বলতে সনাতন ঋষির হাত উঠে যায় ওপরে। চোখের পানি মুছছিলেন তিনি।