জিডিপির হিসাব হয়নি আট মাসেও

সাধারণত অর্থবছর শেষে তিন-চার মাসের মধ্যেই জিডিপির চূড়ান্ত হিসাব দেওয়া হয়। আট মাস হতে চলল, তবু চূড়ান্ত হিসাবের দেখা নেই।

  • সাময়িক হিসাবে করোনার প্রভাব প্রতিফলিত হয়নি। এতে প্রশ্ন উঠেছে।

  • করোনার মধ্যে পরিবহন, পর্যটন, নির্মাণ এবং আবাসন তৈরির কার্যক্রম কয়েক মাস বন্ধ ছিল। অথচ এসব খাতের অবদান বৃদ্ধির কথাও বলা হয়েছে!

প্রতীকী ছবি

২০১৯-২০ অর্থবছর শেষ হওয়ার পর প্রায় আট মাসেও মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) হিসাব চূড়ান্ত করতে পারেনি বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)। ফলে করোনার শুরুর কয়েক মাসে দেশের অর্থনীতিতে কী ধরনের প্রভাব পড়েছে—এর প্রকৃত চিত্র পাওয়া যাচ্ছে না।

গত অর্থবছর শেষ হওয়ার দেড় মাসের মাথায় গত আগস্ট মাসে একটি সাময়িক হিসাব দিয়ে বিবিএস বলেছিল, ৫ দশমিক ২৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে, যা নিয়ে তখনই প্রশ্ন তোলেন অর্থনীতিবিদেরা।

অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল ২০১৪ সালে পরিকল্পনামন্ত্রী হয়ে জিডিপি গণনার নতুন রুটিন চালু করেন। ২০১৫ সাল থেকে প্রতিবছর এপ্রিল-মে মাসের দিকে ওই অর্থবছরের আট-নয় মাসের তথ্য–উপাত্তের ভিত্তিতে জিডিপির একটি সাময়িক হিসাব তৈরি করে থাকে বিবিএস। পরে সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসের দিকে পুরো অর্থবছরের তথ্য-উপাত্ত হাতে পেয়ে জিডিপির চূড়ান্ত হিসাব করা হয়। কিন্তু গত অর্থবছরের জিডিপি গণনায় দুটির কোনোটিই করা হয়নি।

গত বছর জুন মাসে বাজেট ঘোষণার সময় বলা হয়, ৫ দশমিক ২৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হতে পারে। পরে আগস্টে সাময়িক হিসাবের বিস্তারিত প্রকাশ করে বিবিএস। ওই সময়ের মধ্যে রাজস্ব, রপ্তানি ও প্রবাসী আয় এবং আমদানি ব্যয়সহ অর্থনীতির প্রায় সব খাতের পুরো অর্থবছরের (জুলাই-জুন) তথ্য–উপাত্ত চূড়ান্ত হয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু বিবিএস আট-নয় মাসের তথ্য–উপাত্ত দিয়েই সাময়িক হিসাব প্রকাশ করে। তাতে করোনার প্রভাব ধরা হয়নি। এদিকে চলতি ২০২০–২১ অর্থবছরের আট মাস শেষ হতে চলছে, অথচ বিবিএস এখনো জিডিপির চূড়ান্ত হিসাব তৈরি করতে পারেনি। অন্যান্যবার এই সময়েই চলমান অর্থবছরের জিডিপির সাময়িক হিসাব তৈরির প্রস্তুতি চলে। কিন্তু এবার সেই কাজ শুরু করা যাচ্ছে না আগের বছরের জিডিপির চূড়ান্ত হিসাব না থাকায়।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে গত বুধবার বিবিএসের জাতীয় আয় শাখার পরিচালক জিয়াউদ্দীন আহমেদ বলেন, এবার করোনার কারণে জিডিপির চূড়ান্ত হিসাব যথাসময়ে শেষ করা সম্ভব হয়নি। এখন কাজ চলছে। শিগগিরই জিডিপির চূড়ান্ত হিসাব প্রকাশ করা হবে।

গত ডিসেম্বর মাসেও বিবিএসের জাতীয় আয় শাখার একাধিক কর্মকর্তা বলেছিলেন, কাজ চলছে। শিগগিরই জিডিপির হিসাব চূড়ান্ত করা হবে।

তবে এ সম্পর্কে ভিন্নমত দেন বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, বিবিএস জিডিপির যে সাময়িক হিসাব দিয়েছে, তা ছিল আট-নয় মাসের তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে। তাতে করোনার প্রভাব প্রতিফলিত হয়নি। পুরো বছরের প্রকৃত তথ্য-উপাত্ত ধরে হিসাব করলে প্রবৃদ্ধি আরও কমে যাওয়ার কথা। তাঁর মতে, প্রবৃদ্ধির সংখ্যা এখন রাজনৈতিক হয়ে গেছে। সরকার হয়তো দেখাতে চাইছে, এত বিপদ-আপদ সত্ত্বেও ভালো প্রবৃদ্ধি হয়েছে। আর বিতর্ক এড়াতে প্রবৃদ্ধির হিসাব চূড়ান্ত না করে নিরাপদ থাকতে চাইছে বিবিএস।

সাময়িক হিসাব নিয়ে প্রশ্ন

সাধারণত সাময়িক হিসাবে একটি খাতের আট-নয় মাসের প্রকৃত তথ্য-উপাত্তকে প্রবণতা হিসেবে ধরে পুরো বছরের চিত্র দেখানো হয়। কিন্তু গত ২০১৯–২০ অর্থবছরের সাময়িক প্রবৃদ্ধির হিসাবে কিছু খাত নিয়ে প্রশ্ন আছে। যেমন গত বছরের মার্চ মাসের মাঝামাঝি সময় থেকে বাংলাদেশে করোনার প্রকোপ শুরু হয়। এরপর এপ্রিল ও মে মাস বাস, ট্রাক, ট্রেন, ট্রলার, লঞ্চ, ব্যক্তিগত গাড়িসহ সব ধরনের যান চলাচল প্রায় বন্ধ ছিল। আকাশে ডানা মেলেনি বিমান। অর্থবছরের ৪ ভাগের ১ ভাগ সময় পরিবহন চলাচল বন্ধ থাকলেও পরিবহন খাত সব মিলিয়ে অর্থনীতিতে ৫ হাজার ৮৮ কোটি টাকার অবদান রেখেছে বলা হয়। করোনা শুরুর কয়েক মাস কক্সবাজারসহ দেশের পর্যটন স্পটগুলো প্রায় পর্যটকশূন্য ছিল। করোনার কারণে প্রথম তিন মাস পর্যটন এলাকার সব হোটেল-মোটেল–রেস্তোরাঁ বন্ধ ছিল। অথচ বিবিএসের হিসাবে বলা হয়, অর্থবছর শেষে জিডিপিতে হোটেল-রেস্তোরাঁর অবদান ৫০৯ কোটি টাকা বেড়েছে।

জিডিপিতে নির্মাণ খাতের অবদান প্রায় ৮ শতাংশ। গত ২০১৯–২০ অর্থবছরে এই খাতের অবদান ৮৮ হাজার ৪৯১ কোটি টাকা। নির্মাণ খাতের সিংহভাগ অবদান আসে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বাস্তবায়নের মাধ্যমে। গত অর্থবছরে এডিপির টাকা খরচ আগেরবারের চেয়ে ৫ হাজার ৩২৯ কোটি টাকা কমেছে। কিন্তু বিবিএস বলছে, ওই অর্থবছরে জিডিপিতে নির্মাণ খাতে মূল্য সংযোজন বেড়েছে ৭ হাজার ৩৫৩ কোটি টাকা।

করোনাকালে ফ্ল্যাট বিক্রি তেমন একটা হয়নি। কিন্তু বিবিএস বলছে, আবাসন খাতের অবদানও ৩ হাজার কোটি টাকার বেশি বেড়েছে।