ত্রিমুখী আক্রমণের শিকার মধ্যবিত্ত

নাগরিক প্ল্যাটফর্ম বলছে, মধ্যবিত্তরা এখন বৈষম্যমূলক বাজেটীয় পদক্ষেপ, আন্তর্জাতিক বাজারের প্রভাব ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের আক্রমণের মুখে রয়েছে।

এসডিজি বাস্তবায়নে নাগরিক প্ল্যাটফর্ম আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য দেন প্ল্যাটফর্মের আহ্বায়ক ও সিপিডির বিশেষ ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। গতকাল রাজধানীর ব্র্যাক সেন্টার ইনে
ছবি: প্রথম আলো

মধ্যবিত্তরা এখন ত্রিমুখী আক্রমণের শিকার। এগুলো হলো বৈষম্যমূলক বাজেটীয় পদক্ষেপ, আন্তর্জাতিক বাজারের প্রভাব ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ। এসব আক্রমণে মধ্যবিত্তের জীবন কঠিন হয়ে পড়েছে।

এসডিজি বাস্তবায়নে নাগরিক প্ল্যাটফর্মের আহ্বায়ক ও অর্থনীতিবিদ দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য গতকাল রোববার এক সংবাদ সম্মেলন এ কথা বলেন। তাঁর মতে, বাজেটে ধনীদের বেশি সুযোগ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু মধ্যবিত্তের জন্য তেমন কিছু নেই। আন্তর্জাতিক বাজার পরিস্থিতির কারণে মধ্যবিত্তরাই বেশি চাপে পড়েছে। সর্বশেষ বন্যার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগে মধ্যবিত্ত ও গরিবেরাই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তিনি বলেন, প্রস্তাবিত বাজেটে মধ্যবিত্তের প্রতি মনোযোগ দেওয়া হয়নি। কারণ, মধ্যবিত্তের মধ্যে রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্ব নেই। বাজেটে তাদের অবহেলা করা হয়েছে। বরং অর্থমন্ত্রী বাজেট বক্তৃতায় মধ্যবিত্তদের কর ফাঁকিবাজ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।

বাজেট থেকে গরিব মানুষ কিছু পায়নি, বরং বিদেশে বেনামে সম্পদধারীদের সুযোগ দেওয়া হয়েছে।
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য, আহ্বায়ক, নাগরিক প্ল্যাটফর্ম

প্রস্তাবিত বাজেট নিয়ে রাজধানীর ব্র্যাক সেন্টারে নাগরিক প্ল্যাটফর্ম এই সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে। এতে দেশের সামষ্টিক অর্থনীতির বিভিন্ন দিকসহ বাজেটের মাধ্যমে কোন শ্রেণির মানুষ বেশি সুবিধা পেল, তা তুলে ধরা হয়েছে।

দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য আরও বলেন, এবার সংকটপূর্ণ অর্থবছরের বাজেট দেওয়া হয়েছে। মধ্যবিত্তদের গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। আগামী অর্থবছরেও সংকট আরও বাড়তে পারে। গত ১০-১৫ বছরে অর্থনীতিতে এমন চাপ দেখা যায়নি।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ও নাগরিক প্ল্যাটফর্মের কোর গ্রুপ সদস্য ইফতেখারুজ্জামান অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন। এতে আরও বক্তব্য দেন নাগরিক প্ল্যাটফর্মের সমন্বয়ক আনিসাতুল ফাতেমা ইউসুফ, সেভ দ্য চিলড্রেনের পরিচালক রিফাত বিন সাত্তার, বাংলাদেশ গার্মেন্ট শ্রমিক সংহতির সভাপ্রধান তাসলিমা আখতার, প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের পরিচালক কাশফিয়া ফিরোজ ও অভিযানের নির্বাহী পরিচালক বনানী বিশ্বাস।

যাঁরা টাকা পাচার করে ফেলেছেন, তাঁরা আবার এই টাকা দেশে আনবেন। এটি দিবাস্বপ্নের মতো। এর আগে একাধিকবার কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া হলেও তেমন সাড়া মেলেনি।
ইফতেখারুজ্জামান, নির্বাহী পরিচালক, টিআইবি

‘দিবাস্বপ্ন’ ও ‘অলীক কল্পনা’

বিদেশে পাচার হওয়া টাকা দেশে ফিরিয়ে আনার সুযোগ দেওয়ায় এর তীব্র সমালোচনা করে দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, এই বাজেট ‘ছিনতাই’ হয়ে গেছে। তিনি মনে করেন, নতুন বাজেট থেকে গরিব মানুষ কিছু পায়নি, বরং বিদেশে বেনামে সম্পদধারীদের সুযোগ দেওয়া হয়েছে।

দেশ থেকে পাচার করা টাকা ফেরত আনার সুযোগ দেওয়ার বিষয়ে দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ‘এটি সম্পূর্ণ অনৈতিক। এটি রাজনৈতিকভাবে হঠকারী এবং অর্থনৈতিকভাবে অনুপযোগী। একজন একবার চুরি করল, আবার সেই টাকা চুরি করে বিদেশে পাঠিয়ে দিল। এই দুবার চুরির অপরাধীকে ৭ শতাংশ কর দিয়ে দেশে টাকা ফেরত আনার সুযোগ দেওয়া হলো। অথচ সৎ করদাতারা বছরের পর বছর ৩০-৩২ শতাংশ কর দিয়েছে। বিদেশ থেকে টাকা ফেরত আনা অলীক কল্পনা। এটি কার্যকর হবে না। এতে সরকারের বদনাম হলো। এ ধরনের একটি নীতি নেওয়ার ক্ষেত্রে সরকারের মধ্যেও আলোচনা হওয়ার কথা জানি না।’

দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য আরও বলেন, এ ধরনের হঠকারী সিদ্ধান্ত কীভাবে এল? বাজেটে গরিব মানুষের জন্য কিছু হলো না, কিন্তু বিদেশে বেনামে সম্পদধারীদের সুযোগ দেওয়া হলো। তাহলে এই বাজেট কার জন্য হলো? এটি কীভাবে ছিনতাই হয়ে গেছে, সেটিই আজকে দেখার বিষয়।

অন্যদিকে পাচার করা টাকা ফেরত আনার উদ্যোগকে ‘দিবাস্বপ্ন’ হিসেবে অভিহিত করেছেন নাগরিক প্ল্যাটফর্মের কোর গ্রুপ সদস্য ইফতেখারুজ্জামান। তিনি বলেন, যাঁরা টাকা পাচার করে ফেলেছেন, তাঁরা আবার এই টাকা দেশে আনবেন। এটি দিবাস্বপ্নের মতো। এর আগে একাধিকবার কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া হলেও তেমন সাড়া মেলেনি।

ইফতেখারুজ্জামান একটি উদাহরণ দিয়ে বলেন, ‘পি কে হালদার ধরা পড়েছেন। কিন্তু তাঁর টাকা ফিরিয়ে আনার বিষয়টি এখন আর পি কে হালদারের হাতেও নেই। তাঁর অর্থ ফেরত পাঠাতে ভারতের আপত্তি থাকতে পারে। দুই দেশের মধ্যে পারস্পরিক চুক্তি থাকতে হবে। অর্থ পাচার প্রতিরোধ আইন করে আমরা এগমন্ট গ্রুপের সদস্য হয়েছিলাম। এখন আমরা তাদের কাছে কী জবাব দিব?’

ছয় চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় উদ্যোগ নেই

এবারের বাজেট বক্তৃতায় অর্থনীতিতে ছয়টি চ্যালেঞ্জ চিহ্নিত করা হয়েছে। এগুলো হলো উচ্চ মূল্যস্ফীতি, ভর্তুকি ব্যবস্থাপনা, বৈদেশিক সহায়তা ও অগ্রাধিকার প্রকল্প বাস্তবায়ন, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতের প্রকল্প দ্রুত শেষ করা, স্থানীয় পর্যায়ে রাজস্ব আহরণ বৃদ্ধি এবং মুদ্রা বিনিময় হার স্থিতিশীল রাখা। এ প্রসঙ্গে নাগরিক প্ল্যাটফর্মের বক্তব্য হলো, সমস্যা যথাযথভাবে চিহ্নিত করা হয়েছে। কিন্তু সমাধানে পর্যাপ্ত উদ্যোগ নেই।

দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) কাছ থেকে বাজেটের অর্থসহায়তা নেওয়া যায় কি না, তা বিবেচনা করার সময় এসেছে।