থাকছে বিশাল ভর্তুকি ও প্রণোদনা

আগামী অর্থবছরে ভর্তুকি, প্রণোদনা ও ঋণবাবদ ৪৯ হাজার কোটি টাকা রাখা হচ্ছে। তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, ভর্তুকি খাতে সংস্কার আনা দরকার।

আগামী ২০২১-২২ অর্থবছরের জাতীয় বাজেটে ভর্তুকি, প্রণোদনা ও বিভিন্ন সংস্থাকে ঋণ দেওয়ার জন্য ৪৯ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হচ্ছে। এই বরাদ্দ বাজেটের প্রায় ৮ শতাংশের সমান। এতে বরাবরের মতো সর্বোচ্চ বরাদ্দ থাকছে কৃষি খাতে। এরপরই রয়েছে বিদ্যুৎ ও তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) খাত।

সরকার কৃষকদের সার, বিদ্যুৎ, কৃষি উপকরণ ও উন্নতমানের বীজ কেনাবাবদ ভর্তুকি দেয়। আর প্রণোদনা বেশি দেওয়া হয় পাট ও পোশাক রপ্তানি খাতে। নগদ ঋণ দেওয়া হয়ে থাকে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি), বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) ইত্যাদি সংস্থাকে।

তবে চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরের তুলনায় আগামী ২০২১-২২ অর্থবছরে ভর্তুকি খুব বেশি বাড়ছে না। দেড় হাজার কোটি টাকার মতো বাড়বে। তাও দেশে বৈধ পথে প্রবাসী আয় (রেমিট্যান্স) আনায় জোর দেওয়ার কারণে। প্রবাসী আয় আনতে প্রণোদনা বর্তমান ২ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৩ শতাংশ করা হতে পারে।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, কৃষি খাতে আগামী অর্থবছরে সর্বোচ্চ ৯ হাজার ৫০০ কোটি টাকা ভর্তুকি দেওয়া হচ্ছে। চলতি অর্থবছরেও একই পরিমাণ ভর্তুকি রাখা হয়েছিল। অর্থ বিভাগ কয়েক দিন আগে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়কে জানিয়েছে, গত এপ্রিল পর্যন্ত ১০ মাসে কৃষি ভর্তুকিবাবদ খরচ হয়েছে ৩ হাজার ৪৬৩ কোটি টাকা। মে ও জুনে কত খরচ হবে, তা যোগ করে করা হবে এ ভর্তুকির চূড়ান্ত হিসাব।

ভর্তুকিতে দ্বিতীয় অবস্থানে আছে বিদ্যুৎ খাত। এই খাতে চলতি অর্থবছরের মতো আগামী অর্থবছরেও ভর্তুকি বরাদ্দ থাকছে ৯ হাজার কোটি টাকা। এলএনজি খাতেও ভর্তুকি রাখা হচ্ছে চলতি অর্থবছরের মতোই ৮ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। প্রকৃত দামের চেয়ে কম দামে এলএনজি বিক্রি করতে হবে বলে এ ভর্তুকি লাগবে। সরকার হিসাব করে দেখেছে, যে দামে এলএনজি আমদানি করা হচ্ছে, সেই দামে ব্যবসায়ী-শিল্পপতিদের কাছে বিক্রি করলে তাঁদের পণ্য উৎপাদন খরচ বেশি পড়বে। তাই গ্যাস ব্যবহারকারী ব্যবসায়ী-শিল্পপতিদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতেই সরকার এখানে ভর্তুকি দিতে যাচ্ছে।

আগামী অর্থবছরে খাদ্যে ভর্তুকি রাখা হচ্ছে ৬ হাজার কোটি টাকা। খাদ্যে বরাবরই এ রকম ভর্তুকি থাকে। কোভিড-১৯ আসার পর বিনা মূল্যে খাদ্যসামগ্রী বিতরণ, ১০ টাকা কেজি দরে চাল বিক্রি—এসব কারণে তা এবার আরও যৌক্তিক।

সূত্রগুলো জানায়, প্রবাসী আয়ের বিপরীতে প্রণোদনা বাবদ ৪ হাজার ৫০০ কোটি টাকা ভর্তুকি রাখা হচ্ছে, যা চলতি অর্থবছরে ছিল ৩ হাজার ২০০ কোটি টাকার মতো। দেশে বৈধ পথে প্রবাসী আয় আনার বিষয়টি উৎসাহিত করতে ২ শতাংশ প্রণোদনা দেওয়া হচ্ছিল।

তিন থেকে চার হাজার কোটি টাকা খরচ করে প্রবাসী আয় আনার সিদ্ধান্তটি ভুল পদক্ষেপ বলে মনে করেন বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর। তিনি বলেন, কোভিডের কারণে চিকিৎসা, শিক্ষা ও ভ্রমণ ব্যয় কমে যাওয়ায় এই অর্থ প্রবাস থেকে এমনিতেই দেশে আসত।

সরকারঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়নে ঋণের সুদ পরিশোধে ভর্তুকি দেওয়া হচ্ছে। চলতি অর্থবছরে এ জন্য দুই হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছিল। আগামী অর্থবছরেও একই পরিমাণ ভর্তুকি থাকছে। পাট ও পাটজাত পণ্যে সরকার বেশ কয়েক বছর ধরেই ৫০০ কোটি টাকা ভর্তুকি দিয়ে আসছে। আগামী অর্থবছরেও থাকছে এই ভর্তুকি।

রপ্তানি খাতে নতুন অর্থবছরে প্রণোদনা থাকছে ১০ হাজার ৩৮৫ কোটি টাকা। এর বাইরে অন্য সব খাত মিলিয়ে ১ হাজার ৬০ কোটি টাকা বরাদ্দ থাকছে ভর্তুকি ও প্রণোদনা বাবদ।

বেসরকারি খাত থেকে বেশি দামে বিদ্যুৎ কিনে কম দামে বিক্রি করার জন্য পিডিবিকে ঋণ দেয় সরকার। ফলে বিপিসি ও পিডিবিকে দেওয়া ঋণও একধরনের ভর্তুকিই। কারণ, এসব ঋণ সরকার ফেরত পায় না এবং পরে পুরো ঋণই ভর্তুকিতে রূপান্তরিত হয়।

ভর্তুকির টাকা সরাসরি জনগণের দেওয়া করের টাকা। এই ভর্তুকি দিতে না হলে সরকারের জন্য ভালো। তখন এই টাকা সরকার অন্য কাজে ব্যয় করতে পারে। ভর্তুকি নিয়ে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) পাশাপাশি দেশের অনেক অর্থনীতিবিদও সমালোচনা করে থাকেন।

তবে সরকারের পাল্টা যুক্তিও রয়েছে। ভর্তুকি না দিলে কৃষিপণ্য ও বিদ্যুতের দাম বাড়বে। আর প্রতিযোগী দেশগুলো ভর্তুকি দিলে বাংলাদেশ যদি না দেয়, তাহলে চূড়ান্ত বিচারে ক্ষতির শিকার হবে দেশ ও দেশের জনগণ।

অর্থ বিভাগের বাজেট প্রণয়নের সঙ্গে যুক্ত কেউই নাম প্রকাশ করে ভর্তুকি নিয়ে কথা বলতে রাজি হননি। তবে শীর্ষ পর্যায়ের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বলেন, অর্থনীতি এখনো ওই পর্যায়ে উন্নীত হয়নি যে ভর্তুকি তুলে দিতে হবে।

পিআরআইর নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর প্রথম আলোকে বলেন, ‘ভর্তুকি ব্যবস্থাপনায় সংস্কার দরকার। দরকার খাতভিত্তিক গবেষণা। পোশাক খাতকে এখনো কেন টাকা দিতে হবে? বিদ্যুৎ খাতও কত দিন পাবে, তা বিশ্লেষণযোগ্য। তবে কৃষিতে ভর্তুকি থাকা চাই।’