দাম কমে খেজুরের ‘রাজা’ ভ্যানে

সামনে রোজা। তাই দেশে খেজুরের আমদানি বাড়ছে। অন্যদিকে সবচেয়ে দামি খেজুর আজোয়ার দাম এখন পড়তি। তাতে বড় বাজারের দোকানের পাশাপাশি রাস্তার ভ্যানেও বিক্রি হচ্ছে এ খেজুর। সম্প্রতি চট্টগ্রাম নগরীর রেয়াজউদ্দিন বাজারের একটি খেজুরের দোকানে
ছবি: প্রথম আলো

বিশ্বের দামি খেজুরের অন্যতম আজোয়া। বছরখানেক আগেও সুপারশপ বা অভিজাত দোকান ছাড়া পাওয়া যেত না। সৌদি আরবের মদিনায় উৎপাদিত এই খেজুরের দাম কমে এখন সাধারণ মানুষের নাগালে। অভিজাত দোকান ছাড়া পাওয়া যাচ্ছে ফুটপাতের ভ্যানেও।

গত বছরও সুপারশপে প্যাকেটজাত আজোয়া বিক্রি হয়েছে প্রতি কেজি ২ হাজার ৮০০ টাকা পর্যন্ত। আর খুচরা বাজারে বিক্রি হয়েছিল ১ হাজার ৬০০ থেকে ১ হাজার ৮০০ টাকা। সেই আজোয়া এখন খুচরায় বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি ৫০০ থেকে ৬০০ টাকায়।

আজোয়া খেজুরের এমন দরপতনের নেপথ্যে আছে করোনার প্রভাব। করোনার কারণে গত বছর সীমিত পরিসরে হজ ও ওমরাহ পালিত হয়েছে। প্রতিবছর হজ ও ওমরাহ পালন শেষে ফেরার সময় আজোয়া কিনে ফেরেন মুসল্লিরা। কিন্তু করোনার কারণে সেই চাহিদা ছিল না। তাতে আজোয়া খেজুরের ব্যাপক দরপতন হয়। স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে দাম অর্ধেকের বেশি কমে গেছে। সাত হাজার মার্কিন ডলার বা প্রায় ছয় লাখ টাকার সাধারণ মানের প্রতি টন আজোয়ার রপ্তানিমূল্য এখন তিন হাজার ডলার বা আড়াই লাখ টাকা।

চট্টগ্রামের আসাদগঞ্জের খেজুর আমদানিকারক ফারুক আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, আজোয়া খেজুরের রাজা হিসেবে পরিচিত। এটি রপ্তানির চেয়ে বেশি কিনতেন হজ ও ওমরাহ পালন করতে যাওয়া মুসল্লিরা। করোনায় সীমিত আকারে হজ ও ওমরাহ পালন হওয়ায় এ খেজুর খুব বেশি বিক্রি হয়নি। দাম কমে যাওয়ার এটি অন্যতম কারণ।

বিখ্যাত এ খেজুরের উৎপাদন হয় সৌদি আরবের মদিনায়। এটি দেখতে চকচকে কালো-বাদামি রঙের। আকারে মাঝারি। লম্বায় তিন সেন্টিমিটার। মুখে নিলে মিলবে মধু, দারুচিনি ও আঠালো মিঠাইয়ের মতো মিষ্টি স্বাদ।

চট্টগ্রামের ষোলোশহর দুই নম্বর গেট এলাকায় সম্প্রতি তিনটি ভ্যানগাড়িতে আজোয়া খেজুর বিক্রি হতে দেখা যায়। ভ্যানগাড়িতে করে খেজুর বিক্রেতা আবদুর রহিম প্রথম আলোকে বলেন, দাম কমে যাওয়ায় এখন সাধারণ খেজুরের পাশাপাশি আজোয়া বিক্রি করছেন। প্রতি কেজি ৫০০ টাকায় বিক্রি করছেন এ খেজুর।

বিশ্বের সবচেয়ে দামি খেজুরের একটি আজোয়া। করোনায় এ খেজুরের দাম কমেছে উল্লেখযোগ্য হারে
ছবি: প্রথম আলো

গুণগত মান এবং ধর্মীয় দিক থেকে জনপ্রিয়তার শীর্ষে আজোয়া খেজুর। জনপ্রিয়তার বিবেচনায় সংযুক্ত আরব আমিরাতের ইংরেজি দৈনিক দ্য ন্যাশনাল-এর ২০১৭ সালের এক প্রতিবেদনে এ খেজুরকে খেজুরের ‘রাজা’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়।

বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি খেজুর আমদানি হয় সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে। খেজুর উৎপাদনে দেশটি বিশ্বে নবম অবস্থানে। তবে নিজেদের উৎপাদিত খেজুরের পাশাপাশি ইরাক, ইরান, সৌদি আরবসহ কয়েকটি দেশের উৎপাদিত খেজুর এনে তারা বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করে।

আজোয়া খেজুর বিখ্যাত হলেও দাম বেশি থাকায় এত দিন খুব কম পরিমাণে আমদানি হতো। মূলত হজ ও ওমরাহ যাত্রীদের মাধ্যমেই দেশে এই খেজুরের পরিচিতি বেড়েছে। সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে না থাকায় গুটিকয়েক আমদানিকারক এই খেজুর আমদানি করতেন। এবার দাম কমায় আমদানি অন্য সময়ের তুলনায় বেড়েছে বলে ব্যবসায়ীরা জানান। আমদানিকারক, পাইকারি ও খুচরা বাজারে হাত বাড়ালেই মিলছে এই খেজুর।

জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বের ৪০টি দেশে খেজুর উৎপাদিত হয়। ২০১৯ সালে এসব দেশে ৯২ লাখ টন খেজুর উৎপাদিত হয়েছে। উৎপাদনের দিক থেকে শীর্ষ পাঁচটি দেশ হলো মিসর, সৌদি আরব, ইরান, আলজেরিয়া ও ইরাক। বিশ্বের মোট উৎপাদনের ৬৭ শতাংশই আসে এই পাঁচ দেশ থেকে।

এফএওর তথ্য অনুযায়ী, খেজুর উৎপাদনে দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা সৌদি আরবে ২০১৯ সালে খেজুরের উৎপাদন হয়েছে ১৫ লাখ ৩৯ হাজার টন। এ খেজুর বিক্রি হওয়ার আগেই করোনা শুরু হয়। এর মধ্যে যুক্ত হয়েছে ২০২০ সালে করোনার মধ্যে উৎপাদিত খেজুরও। ফলে সরবরাহ অনেক বেড়ে যায়। চাহিদা কমে যাওয়ায় কম দামে এখন খেজুর বিক্রি করে দিচ্ছেন রপ্তানিকারকেরা।

দাম অনেক কমে যাওয়ায় বাংলাদেশে এখন বিপুল পরিমাণে খেজুর আমদানি হচ্ছে। চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে (জুলাই-জানুয়ারি) আমদানি হয়েছে ৪৯ হাজার ৫৪১ টন, যা গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে দ্বিগুণের বেশি। আমদানি বেড়ে যাওয়ায় বাজারে কম-বেশি সব ধরনের খেজুরের দাম কমেছে। তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি কমেছে খেজুরের রাজাখ্যাত আজোয়ার। দাম কমে যাওয়ায় দেশে এ খেজুরের বিক্রিও বাড়ছে। তাতেই সৌদি আরবের জেদ্দা বন্দর থেকে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কনটেইনারে করে ৭ হাজার ২৮২ কিলোমিটার সমুদ্রপথ পাড়ি দিয়ে এটি চলে আসছে চট্টগ্রাম বন্দরে। বন্দর থেকে ছাড় হওয়ার পর তা সুপারশপ বা অভিজাত দোকানের পাশাপাশি ফুটপাতের ভ্যান হয়ে পৌঁছে যাচ্ছে ভোক্তার ঘরে।