দুশ্চিন্তার নাম মূল্যস্ফীতি ও বেসরকারি বিনিয়োগ

বাজেটে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। গতকাল ঘোষিত মুদ্রানীতিতে টাকার প্রবাহ কমাতে বেসরকারি ঋণ কমানোর উদ্যোগ।

উচ্চ মূল্যস্ফীতির শঙ্কা নিয়ে নতুন আরেকটি অর্থবছর শুরু হলো। এ সময়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণকেই সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়ার কথা বলেছে সরকার। যদিও বাজেটে গরিব মানুষের সুরক্ষায় তেমন বড় কোনো উদ্যোগ নেই। ছিল না মধ্যবিত্তের জন্য নতুন কোনো ঘোষণা।

অন্যদিকে, গতকাল বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ ব্যাংক নতুন যে মুদ্রানীতি ঘোষণা করেছে, তাতে মূল্যস্ফীতির লাগাম টেনে ধরতে বেসরকারি খাতে ঋণ সরবরাহ কমানোর কথা বলেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। কিন্তু নতুন অর্থবছরে সরকার ব্যাংক খাত থেকেও অনেক বেশি ঋণ নেওয়ার লক্ষ্য ঠিক করেছে। এতে বেসরকারি বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হবে। কর্মসংস্থানের গতি কমবে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগে বিনিয়োগে আরও ভাটা পড়তে পারে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীরা।

বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন এ বিষয়ে প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাজেট ও মুদ্রানীতি—দুই জায়গায় মূল্যস্ফীতিনিয়ন্ত্রণের কথা বলা হয়েছে, কিন্তু কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। মূল্যস্ফীতির চাপ বেশি পড়ে গরিব মানুষের ওপর। এবার সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে তেমন কোনো উদ্যোগ নেই। আবার মুদ্রানীতিতে রেপো হার বাড়ানোর উদ্যোগও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখবে না। বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ এমনিতেই বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।’ তিনি জানান, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সংকোচন বাজেটের পরিবর্তে সম্প্রসারণমূলক বাজেট হয়েছে। সংশোধিত বাজেটের তুলনায় এবার ঘাটতি বাজেট ২০ শতাংশ বেড়েছে। ঘাটতি বৃদ্ধি মানেই বেশি অর্থ খরচে আগ্রহী সরকার, যা মূল্যস্ফীতিকে আরও উসকে দেবে।

গতকাল বৃহস্পতিবার ২০২২-২৩ অর্থবছরের জন্য ৬ লাখ ৭৮ হাজার ৬৪ কোটি টাকার বাজেট পাস হয়েছে। স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সংসদ অধিবেশনে এ বাজেট কণ্ঠভোটে পাস হয়। আজ ১ জুলাই থেকে এ বাজেট কার্যকর হবে। নতুন অর্থবছরের জন্য মোট রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৪ লাখ ৩৩ হাজার কোটি টাকা।

সার্বিক বিষয়ে পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী শামসুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, এবারের বাজেটে জিডিপি প্রবৃদ্ধির চেয়ে মূল্যস্ফীতিকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এবারের বাজেটকে কেউ উচ্চাভিলাষী বলেনি। বাজেটের সঙ্গে সংগতি রেখে মুদ্রানীতিও সংকোচনমূলক করা হয়েছে। শুধু প্রয়োজনের নিরিখে যেন ঋণ দেওয়া হয়, সে জন্য বেসরকারি খাতের ঋণের প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য কমানো হয়েছে। তিনি বলেন, গরিব মানুষকে মূল্যস্ফীতির চাপ থেকে সুরক্ষা দিতে সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বরাদ্দ বাড়ানো হয়েছে। এখন সুবিধাভোগী বাড়ানো হবে

বর্তমান মুদ্রানীতি ব্যবস্থাপনায় জগাখিচুড়ি অবস্থা। রেপো হার বাড়ালেও ঋণের সুদের হার বাড়ানো হয়নি। তা আগের মতো ৯ শতাংশ রয়েছে।
জাহিদ হোসেন, অর্থনীতিবিদ

সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ

কয়েক মাস ধরেই অর্থনীতিতে চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে মূল্যস্ফীতি। চলতি বছরের শুরুতেই মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশ ছাড়িয়ে যায়। সর্বশেষ গত মে মাসে মূল্যস্ফীতি হয় ৭ দশমিক ৪২ শতাংশ, যা গত আট বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। গত বুধবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতীয় সংসদে বাজেটের ওপর বক্তৃতায় মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণকেই বাজেটে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়ার কথা বলেন। অর্থমন্ত্রীও বাজেট বক্তৃতায় একই কথা বলেন।

আন্তর্জাতিক ও স্থানীয় বাজারে নিত্যপণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় মূল্যস্ফীতি বেড়েছে। মূল্যস্ফীতি বাড়লে গরিব ও মধ্যবিত্তরা সবচেয়ে বেশি চাপে পড়েন। কিন্তু ১১৫টি সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির মধ্যে একটি কর্মসূচিতে অর্থাৎ প্রতিবন্ধীদের ভাতা ১০০ টাকা বাড়িয়ে ৮৫০ টাকা করা হয়েছে। সুবিধাভোগী বেড়েছে দুটোতে। এগুলো হলো প্রতিবন্ধী এবং মা ও শিশু কর্মসূচি।

মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ ও ডলারের চাহিদায় লাগাম টেনে ধরতে ফুল, ফল, আসবাব, প্রসাধন সামগ্রী, গাড়ি, ল্যাপটপসহ বিভিন্ন পণ্যে শুল্ক-কর বাড়ানো হয়েছে। এসব পণ্যের আমদানির পরিমাণ খুব বেশি কমানো যাবে না।

এদিকে এক কোটি পরিবারকে সুলভ মূল্যে চাল, ডাল, আলু, পেঁয়াজ, তেল, চিনিসহ নিত্যপণ্য দিতে ‘পরিবার কার্ড’ চালু করা হয়। কিন্তু সুবিধাভোগী চিহ্নিত করছেন স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা। ফলে প্রকৃত সুবিধাভোগীরা বাদ পড়তে পারেন। সুবিধাভোগী চিহ্নিত হতে পারে রাজনৈতিক বিবেচনায়।

বেসরকারি বিনিয়োগের কী হবে

জুলাই-ডিসেম্বর সময়ের জন্য ঘোষিত সংকোচনমূলক মুদ্রানীতিতে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বাজারে টাকার প্রবাহ কমাতে বাংলাদেশ ব্যাংক দুটি বিষয়কে প্রাধান্য দিচ্ছে। যেমন, চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরে বেসরকারি খাতে ঋণে প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে ১৪ দশমিক ১ শতাংশ, যা আগে ছিল ১৪ দশমিক ৮ শতাংশ। অন্যদিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে টাকা ধারের সুদ বা রেপো হার ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে সাড়ে ৫ শতাংশ করে দিয়েছে।

এখন বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ আরও কমতে পারে। বেসরকারি বিনিয়োগই দেশের কর্মসংস্থানের বড় উৎস। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাবে, বাংলাদেশে ছয় কোটির বেশি লোক কাজ করেন। এর মধ্যে মাত্র ২০ লাখের মতো সরকারি কর্মকর্তা–কর্মচারী ও শিক্ষক আছেন। বাকি সব কর্মসংস্থান বেসরকারি খাতের। প্রতিবছর ১৪ থেকে ১৫ লাখ লোকের কর্মসংস্থান হয়। এর মধ্যে ৯০ শতাংশের বেশি বেসরকারি খাতে। ফলে বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ শ্লথ হলে কর্মসংস্থান কমবে, মানুষের আয় কমবে। এর ফলে মূল্যস্ফীতির চাপ আরও বাড়তে পারে।

এ বিষয়ে জাহিদ হোসেন বলেন, বর্তমান মুদ্রানীতি ব্যবস্থাপনায় জগাখিচুড়ি অবস্থা। রেপো হার বাড়ালেও ঋণের সুদের হার বাড়ানো হয়নি। তা আগের মতো ৯ শতাংশ রয়েছে। এদিকে সরকারি ট্রেজারি বিলের সুদের হার ৭ থেকে ৮ শতাংশ। যা বিক্রি করে ব্যাংকের কাছ থেকে ঋণ নেয় সরকার। তাহলে ব্যাংক কেন ১ শতাংশ বাড়তি সুদের জন্য ঝুঁকি নিয়ে বেসরকারি খাতকে ঋণ দেবে?

বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ কমার আরও কারণ আছে। সরকার চলতি অর্থবছরে ব্যাংক খাত থেকে ১ লাখ ৬ হাজার ৩৩৪ কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার পরিকল্পনা করেছে। যা ২০২১-২২ অর্থবছরের তুলনায় ৩০ হাজার কোটি টাকা বেশি। এতে ব্যাংকগুলোর ওপর আরও চাপ বাড়বে।

এ বিষয়ে ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সভাপতি রিজওয়ান রাহমান প্রথম আলোকে বলেন, এমনিতেই ব্যবসা-বাণিজ্য ভালো নয়। করোনার ধাক্কা সামলে ব্যবসা-বাণিজ্যের পুনরুদ্ধারও ধীরগতিতে হচ্ছে। বিনিয়োগও কম হচ্ছে। মুদ্রানীতির কারণে বেসরকারি বিনিয়োগ আরও কমবে, কর্মসংস্থান কমবে, যা অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।