দেশে গরিব বেশি কুড়িগ্রামে, কম নারায়ণগঞ্জে

  • সরকার এখন আয়ের ভিত্তিতে দারিদ্র্যের পরিমাপ করে। শিগগিরই আয়ের পরিবর্তে বহুমাত্রিক দারিদ্র্য সূচক দিয়ে দারিদ্র্য পরিমাপ করবে।

  • প্রথমবারের মতো ধর্ম ও জাতি ভিত্তিতে ধনী-গরিবের হার নির্ণয়।

  • সম্পদে সবচেয়ে পিছিয়ে সুনামগঞ্জ, আয়ে পিছিয়ে কুড়িগ্রাম।

  • আয়বৈষম্য সবচেয়ে বেশি খুলনায়, সবচেয়ে কম কক্সবাজারে।

  • সবচেয়ে গরিব উপজেলা বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি ও আলীকদম।

দেশে এখন সবচেয়ে কম হতদরিদ্র মানুষ নারায়ণগঞ্জে। এ জেলার বেশির ভাগ মানুষের বাস দারিদ্র্যসীমার ওপরে। কিন্তু অবাক করা বিষয় হলো, হতদরিদ্র কম থাকলেও শিক্ষায় সবচেয়ে পিছিয়ে আছে ঢাকার পাশের এই জেলা। অন্যদিকে দেশের সবচেয়ে গরিব জেলা কুড়িগ্রাম, আর সম্পদে সব জেলার পেছনে রয়েছে সুনামগঞ্জ।

সরকারের এক সমীক্ষায় এমন তথ্য উঠে এসেছে। এই সমীক্ষাতেই দেশে প্রথমবারের মতো ধর্মভিত্তিক ধনী-গরিবের হার কত, তা বের করা হয়েছে। একই সঙ্গে তুলে আনা হয়েছে জাতিগত ক্ষুদ্র জাতিসত্তাগুলোর মধ্যকার দারিদ্র্যের হারও।

পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগ (জিইডি) বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস) ও যুক্তরাজ্যের বাথ বিশ্ববিদ্যালয়কে দিয়ে সমীক্ষাটি করিয়েছে।

ধর্ম ও জাতিগত ক্ষুদ্র জাতিসত্তাভিত্তিক দারিদ্র্যের বর্তমান অবস্থা নির্ণয়ের কারণ হিসেবে বিআইডিএস বলছে, জাতিসংঘ–ঘোষিত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রায় (এসডিজি) কাউকে পিছিয়ে না রেখে সবাইকে নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। তাতে সব দেশ অনুস্বাক্ষর করেছে, যাতে দারিদ্র্যকে শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনা যায়।

সমীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশে এখন হতদরিদ্রের সংখ্যা সবচেয়ে কম নারায়ণগঞ্জে, যা শতকরা হিসাবে মাত্র ১ শতাংশের নিচে। অথচ এই জেলাতেই কিনা ৬ থেকে ১৫ বছর বয়সী শিশুদের মধ্যে ১৮ দশমিক ৪২ শতাংশই স্কুলে যাচ্ছে না। অর্থাৎ জেলাটিতে স্কুলে যাওয়ার মতো প্রতি ১০০ শিশুর মধ্যে ১৮ জনই পড়াশোনার মধ্যে নেই। স্কুলে যায় ৮১ দশমিক ৫৮ শতাংশ শিশু।

আয়ের দিক থেকে প্রথম স্থানে থাকা নারায়ণগঞ্জের পেছনেই রয়েছে প্রবাসী অধ্যুষিত জেলা মাদারীপুর। আয়ে তৃতীয় অবস্থানে আছে নারায়ণগঞ্জের প্রতিবেশী মুন্সিগঞ্জ। তবে মাদারীপুর ও মুন্সিগঞ্জে শিক্ষার হার নারায়ণগঞ্জের চেয়ে বেশি।

নারায়ণগঞ্জ আয়ে সবার শীর্ষে, অথচ শিক্ষায় সবচেয়ে পিছিয়ে—কেন এমন হয়েছে জানতে চাইলে সমীক্ষার সঙ্গে সম্পৃক্ত বিআইডিএসের জ্যেষ্ঠ গবেষক জুলফিকার আলী বলেন, এটি একটি শিল্প এলাকা, যেখানে রয়েছে নানা ধরনের কলকারখানা। ফলে সেখানে আয়ের উৎস বেশি। কিন্তু আয় বেশি হলেই যে অভিভাবকেরা শিক্ষায় গুরুত্ব দেবেন, তা না-ও হতে পারে। কাজের প্রচুর সুযোগ থাকায় অনেক পরিবারই তাদের সন্তানদের কাজে নামিয়ে দিচ্ছে।

আয়ের দিক থেকে ধর্ম ভিত্তিতে মুসলমানদের মধ্যে হতদরিদ্রের হার ১১ শতাংশ। এ হার হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে ১৪ শতাংশ। এ ছাড়া খ্রিষ্টধর্মের ২১ শতাংশ ও বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের ২২ শতাংশ মানুষ হতদরিদ্র।

সমীক্ষামতে, দেশের সবচেয়ে গরিব জেলা কুড়িগ্রাম। এই জেলার ৫৪ শতাংশ মানুষই হতদরিদ্র। এ ক্ষেত্রে দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থানে আছে যথাক্রমে বান্দরবান (৫০ শতাংশ) ও দিনাজপুর (৪৫ শতাংশ)। অন্যদিকে সম্পদে সবচেয়ে পিছিয়ে সুনামগঞ্জ জেলা, যেখানে ৬৭ দশমিক ৪৯ শতাংশ মানুষের একটির বেশি সম্পদ নেই। সম্পদ কমের দিক থেকে দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থানে আছে যথাক্রমে কক্সবাজার (৫৯ শতাংশ) ও বান্দরবান (৫৬ শতাংশ)।

এ বিষয়ে জুলফিকার আলী প্রথম আলোকে বলেন, আয়ের সঙ্গে সম্পদের সম্পর্ক খুব একটা শক্তিশালী নয়। আয় বেশি হলেই যে সম্পদ বেশি থাকবে, এমনটা নয়। এমনও দেখা গেছে, অনেকের প্রচুর সম্পদ আছে, কিন্তু আয় নেই। আবার অনেকের ভালো আয় হচ্ছে, কিন্তু সম্পদ করার মতো অবস্থা নেই।

সমীক্ষায় দেখা গেছে, দেশে আয়বৈষম্য সবচেয়ে বেশি খুলনা জেলায়। আয়বৈষম্যে খুলনার পেছনে রয়েছে যথাক্রমে পিরোজপুর, কুষ্টিয়া ও নওগাঁ জেলা। অন্যদিকে সবচেয়ে কম আয়বৈষম্যের জেলা হচ্ছে কক্সবাজার। এরপরে আছে যথাক্রমে সিরাজগঞ্জ ও ময়মনসিংহ।

উপজেলা ভিত্তিতে দেশে সবচেয়ে গরিব হলো বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি ও আলীকদম এবং কুড়িগ্রামের রাজীবপুর।

আয়ের দিক থেকে ধর্ম ভিত্তিতে মুসলমানদের মধ্যে হতদরিদ্রের হার ১১ শতাংশ। এ হার হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে ১৪ শতাংশ। এ ছাড়া খ্রিষ্টধর্মের ২১ শতাংশ ও বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের ২২ শতাংশ মানুষ হতদরিদ্র।

জাতিগত ক্ষুদ্র জাতিসত্তাগুলোর মধ্যে চাকমাদের ৭১ শতাংশ, সাঁওতালদের ৪৮ দশমিক ৮ শতাংশ, মারমাদের ৬৫ শতাংশ, ত্রিপুরাদের ৭৭ শতাংশ, গারোদের ৪৭ শতাংশ, ম্রোদের ৯৮ শতাংশ, খাসিয়াদের ১৭ শতাংশ ও মণিপুরিদের ৮ শতাংশ হতদরিদ্র।
ধর্ম ও ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীভিত্তিক আলাদা সমীক্ষা করার কারণ সম্পর্কে বিআইডিএসের জ্যেষ্ঠ গবেষক জুলফিকার আলী বলেন, ‘ধর্মভিত্তিক এবং ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মধ্যে দরিদ্রের হার কত, তা আমরা দেখতে চেয়েছি। কে মুসলমান, কে হিন্দু এসব না দেখে সবাইকে নিয়েই যাতে উন্নয়ন হয়। এ সমীক্ষার ফলে সরকারের যেকোনো নীতিকৌশল প্রণয়ন সহজ হবে। সবার দিকেই সরকারের সমান নজর যাবে।’

সমীক্ষাটি করার কারণ হিসেবে পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী শামসুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, ‘জাতিসংঘ–ঘোষিত ১৫ বছরমেয়াদি (২০১৫-৩০) টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অনুযায়ী সব দেশ বহুমাত্রিক দারিদ্র্য সূচক (মাল্টিডাইমেনশনাল পোভার্টি ইনডেক্স) ব্যবহার করে দারিদ্র্যের হার বের করতে সম্মত হয়েছে। ভারত, পাকিস্তান, নেপালসহ অনেক দেশ এরই মধ্যে আয়ের ভিত্তিতে দারিদ্র্য পরিমাপ বাদ দিয়ে বহুমাত্রিক পদ্ধতিতে দারিদ্র্যের হার বের করছে। বাংলাদেশ এখনো শুরু করেনি। এ সমীক্ষার মাধ্যমে জানা গেল, আমাদের অবস্থানটা ঠিক কোথায়। তাই বাংলাদেশও আয়ের ভিত্তি বাদ দিয়ে বহুমাত্রিক দারিদ্র্য সূচক দিয়ে দারিদ্র্য পরিমাপ করবে।’
দুইভাবে দারিদ্র্য নির্ণয় করা হয়। প্রথমত, আয় দিয়ে। দ্বিতীয়ত, বহুমাত্রিক দারিদ্র্যসূচক দিয়ে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পুষ্টি, বিদ্যুৎসহ মোট ১০টি সূচক দিয়ে বহুমাত্রিক দারিদ্র্য সূচক ব্যবহার করা হয়।