নিজের পায়ে দাঁড়ানোর গল্প

বাংলাদেশের অর্থনীতি বদলে গেছে। স্বাধীনতার পরের প্রায় দু্ই দশক দেশের অর্থনীতি বিদেশি সাহায্যনির্ভর ছিল। বিদেশি সহায়তা ছাড়া উন্নয়ন বাজেট করা যেত না। দাতাগোষ্ঠীর অর্থ ছাড়া উন্নয়ন প্রকল্প নেওয়া কঠিন ছিল। গত ৫০ বছরে সেই চিত্র প্রায় পুরোটাই পাল্টে গেছে। বাংলাদেশ এখন বাণিজ্যনির্ভর অর্থনীতির দেশ হয়েছে। বাণিজ্যনির্ভর অর্থনীতির কারণে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে অর্থ জোগানের ক্ষমতা বেড়েছে বহু গুণ। নব্বইয়ের দশকে অর্থনীতি উদারীকরণের সুফল মিলছে। বাণিজ্যনির্ভর অর্থনীতির দেশে রূপান্তরের পেছনে এ দেশের উদ্যোক্তারাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন।

পরিবর্তন কেমন হলো, এর একটি তুলনা দেওয়া যেতে পারে। সাধারণত উন্নয়ন প্রকল্পের খরচের জন্য দাতা দেশ ও সংস্থাগুলো ঋণ দেয়। ১৯৭২-৭৩ সালের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) আকার ছিল ৫০১ কোটি টাকা। এডিপির ৭৫ শতাংশ অর্থ দিয়েছিল দাতারা। পাঁচ দশক পরে এডিপিতে বিদেশি সহায়তার পরিমাণ কমে দাঁড়ায় ৩৩ শতাংশ।

এবার দেখা যাক, গত পাঁচ দশকে দেশে উদ্যোক্তা কত বেড়েছে। ১৯৭৩ সালের জুন মাসে দেশে শিল্পকারখানা ছিল মাত্র ৩১৩টি। পাঁচ দশকে কলকারখানার চিত্রই পাল্টে গেছে। বড় ও ভারী শিল্পকারখানা আছে তিন হাজারের বেশি। মাঝারি কারখানার সংখ্যাও আরও তিন হাজার। দেশজুড়ে ৩৯ হাজার কুটির ও ছোট কারখানা আছে। অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি প্রতিবছর চার হাজার কোটি টাকার পণ্য রপ্তানি হয় এসব কারখানা থেকেই। কলকারখানা হওয়ায় সরকারের রাজস্ব সংগ্রহেও বড় ভূমিকা পালন করছে।

সত্তর ও আশির দশকে দাতাদের টাকার ওপর ভরসা করে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) নেওয়া হতো। তখন দাতাদের টাকায় এডিপির ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ খরচ মেটানো হতো। এর বাইরে বিপুল পরিমাণ খাদ্যসহায়তাও দিত দাতারা। এডিপিতে এখন এই নির্ভরতা কমে ৩৩ শতাংশ হয়েছে।

বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীবিদ জাহিদ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, গত পাঁচ দশকের উন্নয়ন অবশ্যই ঈর্ষণীয়। বিদেশি সহায়তানির্ভরতা কাটানোর পেছনে অন্যতম কারণ হলো অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে অর্থ জোগানের সক্ষমতা বেড়েছে। সত্তরের দশকে উন্নয়নের বাজেটের সিংহভাগই পূরণ করা হতো বিদেশিদের টাকায়। অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে খরচ মেটানোর বড় সংস্কার ১৯৯১ সালের ভ্যাট আইন। এর ফলে স্থানীয়ভাবে সম্পদের জোগান বাড়ে।

একই সঙ্গে নব্বইয়ের দশকে অনেকগুলো ব্যাংক হয়েছে। ফলে বেসরকারি খাতের বিনিয়োগের সুযোগ বেড়েছে, যা পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষ কর বাড়াতে সহায়তা করেছে। এ ছাড়া সত্তরের দশকে অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান এসবই মূল লক্ষ্য। অর্থনীতির উন্নয়নের সঙ্গে মানুষের আয় বেড়েছে, জাতীয় সঞ্চয় বাড়িয়েছে। ফলে সরকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি করে অর্থায়নের সুযোগ বাড়িয়েছে।

প্যারিস কনসোর্টিয়াম থেকে ‘উন্নয়ন আড্ডা’

১৯৭১ সাল থেকেই বাংলাদেশকে ‘বাস্কেট কেস’ বা তলাবিহীন ঝুড়ি হিসেবে আখ্যায়িত করা হতো। তলাবিহীন ঝুড়ি বলার কারণ হিসেবে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় মনে করত, বাংলাদেশের অর্থনীতি নিজের পায়ে চলতে পারবে না। সব সময়ই দাতাদের সাহায্য–সহায়তায় চলতে হবে। সত্তর ও আশির দশকে বিদেশি সহায়তায় বাজেট তৈরি করতে হতো। ১৯৮১-৮২ সালে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) সর্বোচ্চ ১৩ দশমিক ৭ শতাংশের সমান বিদেশি সহায়তা নিতে হয়েছিল। বিদেশি সহায়তার নির্ভরশীলতা কমে বর্তমানে জিডিপির ২ শতাংশে নেমে এসেছে।

১৯৭১ সাল থেকেই বাংলাদেশকে ‘বাস্কেট কেস’ বা তলাবিহীন ঝুড়ি হিসেবে আখ্যায়িত করা হতো। তলাবিহীন ঝুড়ি বলার কারণ হিসেবে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় মনে করত, বাংলাদেশের অর্থনীতি নিজের পায়ে চলতে পারবে না।

একসময় বাংলাদেশকে বছরে কত সহায়তা দেওয়া হবে, তা নিয়ে দাতারা বছরে একবার বৈঠক করত। যা প্যারিস কনসোর্টিয়াম নামে পরিচিত। ১৯৭৪ সালে ফ্রান্সের প্যারিসে প্রথম বৈঠক হয়। এরপর প্রতিবছর বাজেটের আগে এপ্রিল ও মে মাসে এই বৈঠক অনুষ্ঠিত হতো। বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রীরা চাহিদার ফর্দ নিয়ে ওই সব বৈঠকে যোগ দিতেন। দাতাদের কাছ থেকে নানা শর্ত আসত। প্রতিবছর এসব শর্ত কতটা মানা হয়েছে, তার জবাবও দিতে হতো অর্থমন্ত্রীকে। এসব শর্ত মেনেই টাকা নিতে হতো।

২০০০ সালের পর থেকেই পরিস্থিতি ঘুরতে শুরু করে। দাতারা সিদ্ধান্ত নেয়, প্রতি দুইবছর অন্তর ঢাকায় বাংলাদেশ উন্নয়ন ফোরাম বা বিডিএফ নামে বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে। ২০০৩ সালে প্রথম বিডিএফ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। অর্থনীতির গতি বাড়তে থাকে। ধীরে ধীরে বিদেশি সহায়তার নির্ভরশীলতাও কমতে শুরু করে। ২০১০ সালে ২৯ সেপ্টেম্বর ওয়াল স্ট্রিট জার্নালে বাংলাদেশ নিয়ে এক প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল— ‘বাংলাদেশ ‘‘বাস্কেট কেস’, নো মোর’।

সর্বশেষ বিডিএফে বৈঠকে তো দাতারা সহায়তা দেওয়ার এই বৈঠকের নামই পাল্টে ফেলেছে। ২০২০ সালের ৩০ জানুয়ারি সমাপনী অধিবেশনে স্থানীয় পরামর্শক গোষ্ঠীর (এলসিজি) সমন্বয়ক ও ইউএনডিপির আবাসিক প্রতিনিধি মিয়া সেপ্পো বিডিএফ বৈঠককে ‘উন্নয়ন আড্ডা’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন। দুই দিনের ওই বৈঠকে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক অগ্রযাত্রার নানা দিক আলোচনা হয়েছে, তাই তিনি বিডিএফকে এই নতুন নাম দেন।

আরও পড়ুন

ঘুরে দাঁড়ানোর গল্প

১৯৭৩ সালের নভেম্বর মাসে পরিকল্পনা কমিশনের ভাইস চেয়ারম্যান নুরুল ইসলামের নেতৃত্বে বাংলাদেশের প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা চূড়ান্ত করা হয়। ওই পরিকল্পনায় বলা হয়েছে, স্বাধীনতার আগে ১৯৬৮-৬৯ সালে সারা দেশে ৩ হাজার ১৩০টি শিল্পকারখানা ছিল। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের সময় শিল্পকারখানার ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। ১৯৭৩ সালে দেশে মাত্র ৩১৩টি কারখানা চালু করা সম্ভব হয়। নব্বইয়ের দশকের আগপর্যন্ত শিল্পকারখানা তেমন একটা গড়ে ওঠেনি।

এরশাদ সরকারের পতনের নব্বইয়ের শুরুতে অর্থনীতি উন্মুক্ত করা শুরু হয়। বেসরকারি বিনিয়োগ সহজ করতে নানা উদ্যোগ নিলে উদ্যোক্তারা এগিয়ে আসেন। নতুন নতুন শিল্পকারখানা হতে শুরু করে। পোশাকশিল্পের দ্রুত বিকাশ হয়। এ ছাড়া রড-সিমেন্ট, ওষুধসহ ভোগ্যপণ্যের ব্যবসায় নামেন এ দেশের ব্যবসায়ীরা। স্থানীয় শিল্পের বিকাশের ফলে বিশাল জনগোষ্ঠীর অভ্যন্তরীণ বাজারে বিভিন্ন পণ্যের চাহিদা পূরণ করা সম্ভব হয়। আবার বিদেশি রপ্তানিও বাড়তে থাকে। দেশের রপ্তানি চার হাজার কোটি ডলার ছাড়িয়ে যায়। পোশাক রপ্তানিও প্রায় সাড়ে তিন হাজার কোটি ডলার হয়।

২০১৯ সালের কলকারখানা নিয়ে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) উৎপাদন খাতের জরিপ করে। সেই প্রতিবেদন অনুযায়ী, সারা দেশে ৪৬ হাজার ২৯১টি কলকারখানা আছে।

মূলত কর অবকাশ সুবিধাসহ নানা কর সুবিধা; ব্যাংকঋণ সহজ করা; রপ্তানিতে নগদ প্রণোদনাসহ নানা কারণে এ দেশে গত তিন দশকে একটি উদ্যোক্তা শ্রেণি গড়ে উঠেছে, যা লাখ লাখ অদক্ষ ও আধা দক্ষ নারী-পুরুষের কর্মসংস্থানে ভূমিকা রেখেছে। এর পাশাপাশি গত তিন দশকে মোবাইল ফোন, পরিবহন, স্বাস্থ্যসহ বিভিন্ন সেবা খাতের বিকাশ ঘটেছে। বিভিন্ন বহুজাতিক কোম্পানিও দেশে বিনিয়োগ করেছে।

স্থানীয় শিল্প ও সেবা খাতের বিকাশের সরকারের রাজস্ব আদায় বেড়েছে। ফলে প্রতিবছর বাজেটে অর্থের জোগান দেওয়া যাচ্ছে। বর্তমানে বাজেটের দুই-তৃতীয়াংশ অর্থের জোগান দেয় জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। করোনার কারণে সবকিছু তিন মাস বন্ধ থাকার পরও সর্বশেষ অর্থবছরে ২ লাখ ১৮ হাজার কোটি টাকার জোগান দিয়েছে এনবিআর।

১৯৭২-৭৩ অর্থবছরের বাজেটের আকার ছিল ৭৮৬ কোটি টাকা। ওই বছর এনবিআর জোগান দিয়েছে ১৬৬ কোটি টাকা, যা বাজেটের পাঁচ ভাগের এক ভাগ।

পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের (জিইডি) সদস্য শামসুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, বৈদেশিক সহায়তানির্ভরতা থেকে বাণিজ্যনির্ভর অর্থনীতির রূপান্তরে বেশ কয়েকটি বিষয় অনুঘটক হিসেবে কাজ করেছে। এ দেশের জনগণের সক্রিয়তা ও ভাগ্য পরিবর্তনের অদম্য ইচ্ছা প্রবল। আবার নব্বইয়ের দশকের শুরুতে খোলাবাজার নীতির কারণে বাণিজ্যনির্ভর অর্থনীতির দিকে অগ্রসর হয়। সরকারের নানা ধরনের নীতি সমর্থনের কারণে এ দেশে সেই সময়ে পরিপক্ব ব্যবসায়ী শ্রেণি গড়ে ওঠে। প্রবাসীরাও এ দেশে বিপুল অর্থ পাঠিয়েছেন, যা গ্রাম এলাকায় ভোগের চাহিদা বাড়িয়েছে। এসব কারণে দিন দিন বাণিজ্যনির্ভর অর্থনীতিতে পরিণত হয়েছে।

এ দেশের জনগণের সক্রিয়তা ও ভাগ্য পরিবর্তনের অদম্য ইচ্ছা প্রবল।
শামসুল আলম, সদস্য পরিকল্পনা কমিশন

দাতা থেকে উন্নয়ন সহযোগী

সত্তর ও আশির দশকে বিশ্বব্যাংক, এডিবি, সাহায্য সংস্থাসহ দাতা দেশ ও সংস্থাগুলো দুইভাবে বাংলাদেশকে সহায়তা করত। এগুলো হলো সরাসরি অর্থসহায়তা ও খাদ্যসহায়তা। আবার অর্থসহায়তার মধ্যে কিছু আসত অনুদান হিসেবে। গরিব দেশ বলে বাকিটা সহজ শর্তের ঋণ মিলত।

স্বাধীনতার পরপর বিপুল পরিমাণ চাল, গমসহ নানা ধরনের খাদ্যসহায়তা দিতো দাতা সংস্থা ও দেশগুলো। প্রথম বছরেই ১৩ কোটি ডলারের খাদ্যসহায়তা পেয়েছিল। ১৯৭৪-৭৫ অর্থবছরের সবচেয়ে বেশি ৩৮ কোটি ডলারের খাদ্যসহায়তা পায় বাংলাদেশ। আশির দশকের পর থেকে ধীরে ধীরে খাদ্যসহায়তা আসা কমতে শুরু করে। এখন ইউনিসেফ, ইউএনডিপিসহ কিছু সাহায্য সংস্থার মাধ্যমে খাদ্যসহায়তা আসে। সর্বশেষ ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ১ কোটি ডলারের খাদ্যসহায়তা এসেছে।
দাতাদের নগদ অর্থে এডিপি তৈরি করা হয়। স্বাধীনতার পরপর ঋণের চেয়ে অনুদানই বেশি দিত দাতারা। এই ঋণ ও অনুদানের অর্থ দিয়েই এডিপি তৈরি করা হতো।

১৯৭২-৭৩ সালে দাতারা অনুদান দিয়েছে সাড়ে ৪৮ কোটি ডলার, আর ঋণ সাড়ে ছয় কোটি ডলার। ঋণ ও অনুদান সব মিলিয়ে ৫৫ কোটি ডলার পেয়েছিল বাংলাদেশ। এটি ছিল ওই বছর যে এডিপি নেওয়া হয়েছিল, এর ৭৫ শতাংশই বিদেশি সহায়তানির্ভর ছিল। পুরো সত্তরের দশকজুড়েই এডিপির ৭০-৮০ শতাংশ খরচ মেটানো হতো বিদেশি সহায়তা দিয়ে। আশির দশকের শেষ দিকে এই নির্ভরশীলতা বেশি ছিল। ৯০ শতাংশের বেশি বিদেশিদের টাকার ভরসা করে ১৯৮৭-৮৮ থেকে ১৯৯০-৯১ অর্থবছরের এডিপি তৈরি করা হয়েছিল।

নব্বইয়ের দশক থেকেই ধীরে ধীরে বিদেশি সহায়তানির্ভর এডিপি বানানোর প্রবণতা কমে যায়। ১০ বছর ধরে প্রতিবছর এডিপির এক-তৃতীয়াংশই খরচ মেটানো হয় বিদেশি সহায়তায়। এখন উপায়ান্তর না দেখে অর্থ নেওয়ার পরিবর্তে কৌশলগত কারণে বিদেশি সহায়তা নেওয়া হয়। বিদেশি ঋণের অর্থ তুলনামূলক কম সুদের এবং বিদেশি সহায়তাপুষ্ট প্রকল্পে বিদেশি পরামর্শকেরা কাজ করেন। এতে কাজের মান ভালো হয়। এ ছাড়া দেশে উন্নত প্রযুক্তিও আসে।