পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির চাপে সাধারণ মানুষ

চাল–তেলের মতো আটা, চিনি, ব্রয়লার মুরগি, গরুর মাংস, গুঁড়া দুধ, রসুনসহ বেশ কিছু নিত্যপণ্যের দাম বৃদ্ধিতে চাপে পড়েছেন স্বল্প আয়ের মানুষ। ফেব্রুয়ারিতে বেড়েছে খাদ্য মূল্যস্ফীতিও। আবার পণ্যের বিশ্ববাজারও অস্থির। আগামী মাসেই শুরু হচ্ছে রমজান। এমন পরিস্থিতিতে সাধারণ মানুষকে স্বস্তি দেওয়ার উপায় কী? সরকারের প্রস্তুতিই–বা কেমন? এসব বিষয় নিয়ে এক পাতার বিশেষ আয়োজন

ঠিক এক বছর আগেও এক কেজি মোটা চাল ৩৪ থেকে ৪০ টাকায় কিনতে পেরেছে সাধারণ মানুষ। সেই চাল কিনতে এখন লাগছে ৪৪ থেকে ৫২ টাকা। এক বছরের ব্যবধানে চালের দাম বেড়েছে ২৯ শতাংশের বেশি। একইভাবে ৯৫ থেকে ১০৫ টাকা লিটারের সয়াবিন তেলের দাম বেড়েছে সাড়ে ৩৭ শতাংশ। প্রতি লিটার বোতলজাত সয়াবিন তেল এখন কিনতে হচ্ছে ১৩৫ থেকে ১৪০ টাকায়।

চাল-তেলের মতো আটা, চিনি, ব্রয়লার মুরগি, গরুর মাংস, গুঁড়া দুধ, রসুনসহ কয়েকটি নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধিতে স্বল্প আয়ের মানুষ চাপে পড়েছে। গত তিন মাসেই নিত্যপণ্যের দাম বেড়েছে বেশি। তার আট-নয় মাস আগে থেকেই করোনায় বিপর্যস্ত দেশ। অনেকে চাকরি হারিয়েছেন। বেতনও কমেছে অনেকের। নতুন চাকরির বাজারও নড়বড়ে। অন্যদিকে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরাও ক্ষতি পুষিয়ে উঠতে পারেননি। সব মিলিয়ে কঠিন সময় পার করছে স্বল্প আয়ের মানুষ।

করোনাকালের শুরুতে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ও চাকরি হারিয়ে স্বল্প আয়ের অনেক মানুষ রাজধানী ছেড়েছে। তখন অনেক বাড়ির মালিকই নতুন ভাড়াটে পাননি। গত বছরের শেষ দিকে করোনা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হলেও নতুন বছরে বাড়িভাড়া বাড়ানোর পথে হাঁটেননি অধিকাংশ বাড়ির মালিক। সরকারও নতুন করে গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানির মূল্য বৃদ্ধি করেনি। এখন নতুন করে আবার করোনা সংক্রমণ বাড়ছে। নিত্যপণ্যের দামেও ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা। অন্যান্য বছরের ধারাবাহিকতায় পবিত্র রমজান মাস ঘিরে আবারও নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির আশঙ্কায় আছে সাধারণ মানুষ।

একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন দিনাজপুরের আবদুল্লাহ রাকিব। মাসিক বেতন সাকল্যে ৩৫ হাজার টাকা হলেও করোনার কারণে গত এপ্রিলে বেতন পাননি। পরের ছয় মাস পূর্ণ বেতন পাননি। স্ত্রী-পুত্র নিয়ে বাড্ডায় বাসাভাড়া করে থাকেন রাকিব।

জানতে চাইলে আবদুল্লাহ রাকিব বলেন, মাস শেষে গ্যাস-বিদ্যুৎ বিলসহ বাসাভাড়া দিতে হয় ১৮ হাজার টাকা। করোনার কারণে বেতন অনিয়মিত হওয়ায় গ্রামের বাড়ি থেকে টাকা এনে সংসার চালাতে হয়েছে। এখন সবকিছুর দাম বাড়ছে। সঞ্চয় তো দূরে, কীভাবে সংসার চালাব, সেটি নিয়ে ভেবে কোনো কূল পাচ্ছি না।

নিত্যপণ্যের দামের ঊর্ধ্বগতির বিষয়ে বাণিজ্যসচিব মো. জাফর উদ্দীন গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘আন্তর্জাতিক বাজারের তুলনায় দেশে নিত্যপণ্যের দাম কমই বেড়েছে। তারপরও আমরা নিয়মিত টাস্কফোর্সের বৈঠক করছি। প্রত্যেক আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তাকে সংযুক্ত করা হয়েছে। কর্মকর্তারা প্রতিষ্ঠানগুলোর আমদানি পর্যায়ের দাম ও দেশের বাজারে বিক্রয়মূল্যের মধ্যে বড় ধরনের কোনো তফাত হচ্ছে কি না, তা তদারক করেন। আশা করি, রমজান সামনে রেখে পণ্যমূল্যের দাম আর বাড়বে না।’

আয় কমেছে, চাপ বেড়েছে

করোনার ধাক্কায় অনেক মানুষের আয় কমেছে। চাকরি হারানোর তালিকাও বেশ লম্বা। শুধু পোশাকশিল্পের ১০৬ কারখানার ৭০ হাজার শ্রমিক ছাঁটাই হয়েছেন। অন্য খাতের হিসাব ধরলে সেটি কয়েক লাখে গিয়ে দাঁড়াবে।

সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) গত ১৩ থেকে ১৯ সেপ্টেম্বর কোভিড-১৯ বাংলাদেশ: জীবিকার ওপর অভিঘাত ধারণা জরিপ’ করে। এতে উঠে আসে, করোনায় মানুষের আয় কমেছে ২০ শতাংশ। করোনার আগে গত মার্চ মাসে প্রতি পরিবারের মাসিক গড় আয় ছিল ১৯ হাজার ৪২৫ টাকা। আগস্টে তা কমে দাঁড়ায় ১৫ হাজার ৪৯২ টাকায়। অর্থাৎ পাঁচ মাসের ব্যবধানে পরিবারপ্রতি আয় কমেছে প্রায় চার হাজার টাকা।

করোনার সময়ে মানুষের আয় কমেছে, আবার ব্যয়ও কমেছে। তবে যেভাবে আয় কমেছে, সেভাবে খরচ কমেনি। ফলে ভোগান্তি বেড়েছে। জরিপের তথ্যানুযায়ী, গত মার্চে দেশে পরিবারপ্রতি মাসিক খরচ ছিল ১৫ হাজার ৪০৩ টাকা। গত আগস্টে তা কমে দাঁড়ায় ১৪ হাজার ১১৯ টাকায়। তার মানে, আয় কমে যাওয়ায় ভোগের চাহিদাও কমেছে।

এদিকে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সানেম ১০ মার্চ এক জরিপের তথ্য প্রকাশ করে বলেছে, বেতন বা মজুরির বিনিময়ে যাঁরা কাজ করেন, তাঁদের মধ্যে ৬২ শতাংশ কর্মী বা শ্রমিকের মজুরি ২০১৯ সালের চেয়ে গত বছরের মার্চ-ডিসেম্বর সময়ে কমে গেছে।

দ্রব্যমূল্যবৃদ্ধি ও বৈশ্বিক বাজার

তিন মাসের ব্যবধানে চাল, সয়াবিন তেল, চিনি, রসুন, ব্রয়লার মুরগি, আটা, গরুর মাংস, গুঁড়া দুধ ও তরল দুধের দাম বেড়েছে। প্রতিটি পণ্যের সঙ্গেই আছে বৈশ্বিক যোগাযোগ। রপ্তানিকারক দেশগুলোতে বাড়ছে চাল, চিনি, গম, ডাল ও গুঁড়া দুধের মতো বিভিন্ন নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম। এ ছাড়া বিশ্ববাজারে রডের কাঁচামাল পুরোনো লোহার দামও বেড়েছে। সিমেন্ট তৈরির কাঁচামাল ক্লিংকার থেকে শুরু করে তুলা, সার, পশু ও মুরগির খাবার, কাঠ, অ্যালুমিনিয়াম ও টিন—কোথাও স্বস্তি নেই।

মূল্যবৃদ্ধির কারণ কী? তা গত মাসে এক প্রতিবেদনে তুলে ধরে মার্কিন বিনিয়োগ ব্যাংক জেপি মরগ্যান চেজ। তারা বলছে, করোনাভাইরাস বৈশ্বিক অর্থনীতিতে যে মন্দা তৈরি করেছিল, টিকা এসে যাওয়ায় তা থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর বড় সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। এর ফলে পণ্যবাজারও ঘুরে দাঁড়িয়েছে।

পণ্যের বাড়তি মূল্যের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে জাহাজভাড়া। বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা জাহাজে সবচেয়ে বেশি পণ্য চীন থেকে আমদানি করেন। আমদানিকারকেরা বলছেন, এখন চীনের সাংহাই থেকে চট্টগ্রাম বন্দর পর্যন্ত ২০ ফুটের একটি কনটেইনারের ভাড়া লাগছে ১ হাজার ৭৮০ মার্কিন ডলার পর্যন্ত, যা করোনার আগে ৮০০ ডলারের আশপাশে ছিল।

দেশের শীর্ষ পর্যায়ের খাদ্যপণ্য আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান চট্টগ্রামের বিএসএম গ্রুপের চেয়ারম্যান আবুল বশর চৌধুরী বলেন, আন্তর্জাতিক বাজার পরিস্থিতি আমলে নিলে দেশে নিত্যপণ্যের দাম যৌক্তিক পর্যায়ে রয়েছে। পবিত্র রমজান মাসের বাড়তি চাহিদা মোকাবিলায় পর্যাপ্ত আমদানি হয়েছে। ফলে নতুন করে মূল্যবৃদ্ধির শঙ্কা কম। তিনি আরও বলেন, নিত্যপণ্যের দাম আগামী জুন-জুলাইয়ের আগে স্বাভাবিক হওয়ার সম্ভাবনা খুব কম।

বাজারে গেলেই পকেট ফাঁকা

রাজধানীর কারওয়ান বাজারে গত শনিবার দুপুরে বাজার করতে এসেছিলেন বেসরকারি চাকরিজীবী মোস্তফা কামাল। মুরগি কেনার জন্য বিক্রেতার সঙ্গে দামদর করছিলেন। তিনি বলেন, সোনালিকা মুরগির কেজি সাড়ে তিন শ টাকা ছাড়িয়ে গেছে। সয়াবিন তেলের প্রতি লিটারের দাম ১৩৯ টাকা। এক কেজি আটা কিনতে লাগছে ৩৫-৩৯ টাকা। লেবু ৪০ টাকা হালি। অধিকাংশ শাকসবজির দাম ৪০-৫০ টাকা কেজি। বাজারে এলেই তো পকেট ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে।

ব্যবসায়ীরা বলছেন, বর্তমানে বাজারে যেসব পণ্যের দাম বাড়তি, সেগুলোর সঙ্গে আন্তর্জাতিক বাজারের সম্পর্ক রয়েছে। তবে শুল্ক ও কর কমানো গেলে কয়েকটি পণ্যের দাম কিছুটা হ্রাস পাবে, যেমন সয়াবিন তেল ও চিনি।

সয়াবিন তেল আমদানিতে বর্তমানে আমদানি পর্যায়ে ১৫ শতাংশ ভ্যাট ও ৪ শতাংশ অগ্রিম কর, উৎপাদন পর্যায়ে ১৫ শতাংশ ভ্যাট এবং বিক্রয় পর্যায়ে ৫ শতাংশ ট্রেড ভ্যাট আরোপ করা আছে। আগে কেবল আমদানি পর্যায়ে ভ্যাট থাকলেও ২০১৯-২০ অর্থবছর উৎপাদন ও বিক্রয় পর্যায়ে ভ্যাট আরোপ করা হয়। অন্যদিকে চিনি আমদানিতে প্রতি টনে ৩ হাজার টাকা আমদানি শুল্ক, ১৫ শতাংশ ভ্যাট, নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক ৩০ শতাংশ ও অগ্রিম আয়কর ২ শতাংশ দিতে হয়। বিক্রয় পর্যায়ে ৫ শতাংশ ট্রেড ভ্যাট আরোপ করা আছে।

সিটি গ্রুপের পরিচালক বিশ্বজিৎ সাহা বলেন, আমদানি, উৎপাদন ও বিক্রয় পর্যায়ে প্রতি লিটার সয়াবিন তেলে বর্তমানে ২৫-২৬ টাকা শুল্ক ও কর দিতে হয়। সরকার যদি কর কমায়, তাহলে সাধারণ মানুষ কিছুটা কম দামে পণ্য দুটি কিনতে পারবে।