প্রতারণার ফাঁদে সাধারণ মানুষ: কারণ ও প্রতিকার

নূর আলম, বিজনেস অ্যানালিস্ট, ব্র্যাক মাইক্রোফাইন্যান্স

ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ইভ্যালির সিইও ও চেয়ারম্যান ১৬ সেপ্টেম্বর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার হন। এর পর থেকে এটিই এখন ‘টক অব দ্য টাউন’। ই-কমার্স খাতে অনিয়ম ও বিশৃঙ্খলার একটি অধ্যায়ের পরিণতি দেখল সবাই। তবে এটি চূড়ান্ত কোনো দৃশ্য নয়। বিগত দুই দশকে দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতির পাশাপাশি একটি দুষ্টচক্র সমানভাবে কাজ করছে। এ কারণে প্রায়ই আমরা সাধারণ মানুষকে প্রতারিত হতে দেখি। আমরা যদি সমস্যার মূল চিহ্নিত করে এখনই প্রয়োজনীয় উদ্যোগ ও সুরক্ষাব্যবস্থা নিতে না পারি, তাহলে প্রতারণার এই আগ্রাসী ঢেউ উপকূল পাড়ি দিয়ে মূল ভূখণ্ডেও আছড়ে পড়বে। অর্থাৎ, বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়বে মূলধারার অর্থনীতি।

প্রথমে খোঁজার চেষ্টা করব অবাধ তথ্যপ্রবাহের এ যুগে মানুষ জেনে–বুঝে কেন এসব প্রতারণার ফাঁদে পা দেয়? প্রকৃতপক্ষে ই-কমার্স প্ল্যাটফর্ম কোনো বিনিয়োগের ক্ষেত্র নয়, অনলাইনে পণ্য বেচাকেনার প্ল্যাটফর্ম। তবু আকর্ষণীয় কিন্তু অস্বাভাবিক অফারের লোভ বা ফাঁদে পা দেয় সাধারণ মানুষ। বিগত দশকগুলোয় আমরা দেখেছি, সাধারণ মানুষ কখনো এমএলএম, কখনো মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ বা অন্য কোনো ভুঁইফোড় প্রতিষ্ঠানে টাকা বিনিয়োগ করে প্রতারিত হয়েছেন। বর্তমান প্রেক্ষাপটে বিনিয়োগের প্ল্যাটফর্ম না হওয়া সত্ত্বেও অতি লাভের আশায় কিছু মানুষ ই-কমার্স প্ল্যাটফর্মে অগ্রিম টাকা রেখে এখন প্রতারণার শিকার হচ্ছেন। এর পেছনেও কিছু কারণ রয়েছে। প্রথমত, দেশে ই-কমার্স পরিচালনার জন্য কার্যকর কোনো নীতিমালা নেই। যার কারণে, প্রতিষ্ঠানগুলো নিজের সুবিধামতো ব্যবসায়িক মডেল বানিয়ে গ্রাহকদের ফাঁদে ফেলতে পারছে। আজকের আলোচনায় ই-কমার্সের নীতিমালার বা নিয়ন্ত্রক সংস্থার ভূমিকা নিয়ে খুব বেশি আলোকপাত করব না। শুধু একটি বিষয় গুরুত্ব দিয়ে বলতে চাই, কার্যকর নীতিমালা না থাকলে কোনো খাতই সঠিক উপায়ে বিকশিত হয় না।

ইভ্যালি ডটকম লিমিটেডের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মো. রাসেল (বাঁয়ে) ও তাঁর স্ত্রী শামীমা নাসরিনকে (ডান থেকে দ্বিতীয়) গ্রেপ্তার করে র‍্যাব।
ছবি: দীপু মালাকার

অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সীমিত আয়ের মানুষের জন্য আয় বর্ধনের সুযোগ বাড়ছে না সেভাবে। এর পেছনে প্রথম ও প্রধান কারণ অনুকূল ব্যবসাবান্ধব পরিবেশের অভাব। বিশ্বব্যাংকের ‘ডুয়িং বিজনেস’ র‌্যাঙ্কিংয়ে বাংলাদেশের সর্বশেষ অবস্থান ১৯০টি দেশের মধ্যে ১৬৮! এশিয়া মহাদেশে বাংলাদেশের পেছনে মাত্র ৩টি দেশ। যুদ্ধবিধ্বস্ত সিরিয়া, আফগানিস্থান ও ইরাক। যেসব মানদণ্ডের ভিত্তিতে বিশ্বব্যাংক ব্যবসার অনুকূল পরিবেশের এ র‌্যাঙ্কিং করে, তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ব্যবসা শুরুর আনুষ্ঠানিকতা, অনুমতি বা লাইসেন্স, অবকাঠামো নির্মাণের শর্তাবলি, বিদ্যুৎ ও জ্বালানির প্রাপ্যতা, সম্পদের মালিকানার নিবন্ধন, ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ, ঋণের প্রাপ্যতা, করকাঠামো, আইনি সহায়তা ইত্যাদি। এসব কারণে দেশে বেসরকারি খাতে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা সহজে ও সুবিধাজনক উপায়ে নিজের অর্থ বিনিয়োগ করতে পারেন না। এর ফলাফলস্বরূপ, বিগত বছরগুলোয় জিডিপি ও মাথাপিছু আয় বাড়লেও বাড়েনি বেসরকারি বিনিয়োগ।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাব বলছে, ২০১৫ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত দেশের গড় প্রবৃদ্ধি ৬ শতাংশের আশপাশে থাকলেও বেসরকারি বিনিয়োগের গড় প্রবৃদ্ধি অনেকটাই স্থবির। এ ছাড়া একই সময়ে কর্মসংস্থানের গড় প্রবৃদ্ধি ১ শতাংশের কম। এটি অপ্রত্যাশিত এবং অর্থনীতির জন্য ইতিবাচক কিছু নয়। নাজুক ব্যবসায় পরিবেশের কারণে সাধারণ মানুষ, যাঁদের ক্ষুদ্র পুঁজি বা স্বল্প সঞ্চিত অর্থ রয়েছে, তাঁরা ক্ষুদ্র ব্যবসায় নামতে ভয় পান। বেসরকারি পর্যায়ে ক্ষুদ্র পরিসরে ব্যবসায়ের এমন তিক্ত অভিজ্ঞতার কারণেই

মানুষ ক্ষুদ্র পুঁজি বিনিয়োগের বিকল্প উপায় খুঁজছেন। তখনই দৃশ্যপটে আসে পঞ্জি স্কিম বা ফ্রড পুঁজির ব্যবসা। যেটির পরিণতি হিসেবে সাধারণ মানুষ ফ্রড ব্যবসার অংশীদার হন। এ দেশে এমএলএমের নামে সাধারণ মানুষের শত শত কোটি টাকা লুটপাটের ইতিহাস এখনো তাজা। আর বর্তমান প্রেক্ষাপটে হাজার হাজার মানুষ জিম্মি হয়ে আছেন ই-কমার্সের নামে ফ্রড ব্যবসার ফাঁদে। গণমাধ্যমে দেওয়া বক্তব্যে প্রতারিত একজনের বক্তব্য দেখছিলাম। তিনি আকুতি করছিলেন, ইভ্যালিতে তাঁর বিনিয়োগের ১১ লাখ টাকা ফেরত চান। একটু অবাকই হলাম। ইভ্যালি বা অন্য ই-কমার্স প্ল্যাটফর্মগুলো কোনোভাবেই বিনিয়োগের কোনো ক্ষেত্র না। মানুষ তারপরও এগুলোকেই বিনিয়োগের ক্ষেত্র হিসেবেই চিন্তা করছে। বিষয়টি যথেষ্ট উদ্বেগের। অভ্যন্তরীণ ব্যবসায় বিনিয়োগের ক্ষেত্র সংকুচিত হওয়াতেই অনেকে ই-কমার্স সাইটকে বিনিয়োগের ক্ষেত্র হিসেবে চিন্তা করার মতো ভয়াবহ ভুল করছেন।

সাধারণ মানুষের একাংশ ফ্রড পুঁজির ফাঁদে পা দেওয়ার পেছনে দ্বিতীয় যে বিষয় গুরুত্বপূর্ণ, সেটি হলো আমাদের ‘বেহাল পুঁজিবাজার’। বাংলাদেশের পুঁজিবাজারকে অনেকে পুঁজি নিঃশেষ হয়ে যাওয়ার ‘ব্ল্যাকহোল’ বলে থাকেন। সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের হিসাবমতে, ২০২০ সালের মার্চ থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ১০ মাসে প্রায় ১ লাখ ৭ হাজার কোটি টাকা শেয়ারবাজার থেকে উধাও হয়ে গেছে! এটি বিস্ময়কর! আরও ভয়াবহ খবর হচ্ছে ৫০ টাকার শেয়ারের দাম কমতে কমতে ১ টাকায় এসে ঠেকেছিল। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আমাদের শেয়ারবাজার কিছু অসাধু সিন্ডিকেটের দখলে। যার কারণে বিগত এক দশকে শেয়ারবাজার সম্পর্কে ইতিবাচক কোনো খবর আসেনি। সাধারণত, যেকোনো দেশের ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের জন্য শেয়ারবাজার একটি বড় ভরসার জায়গা। কিন্তু আমাদের ক্ষেত্রে বিপরীত চিত্র দেখা গেছে। উল্টো বছরের পর বছর অনেক ক্ষুদ্র পুঁজির মানুষকে নিঃস্ব করেছে এই শেয়ারবাজার। এসব কারণে পুঁজিবাজারে সাধারণ মানুষের আস্থা নেই। এই আস্থাহীনতা মানুষকে যেখানে–সেখানে বিনিয়োগ করতে প্ররোচিত করে। আর ফ্রড পুঁজির ব্যবসায়ীরা এ সুযোগটি নিয়ে থাকেন। গত কয়েক বছর আমাদের পুঁজিবাজারে তারল্য প্রবাহ কম। কিন্তু বিস্ময়করভাবে সামগ্রিক অর্থনীতিতে তারল্য প্রবাহ এখন অতীতের যেকোনো সময়ের তুলনায় বেশি! মুদ্রাবাজার ও পুঁজিবাজারের এ রকম পরস্পরবিরোধী চিত্র খুবই অস্বাভাবিক। এর জন্য দায়ী পুঁজিবাজারের ওপর মানুষের আস্থাহীনতা। অর্থনৈতিক সুশাসনও একটি বড় কারণ। কোনো দেশে যদি বৃহৎ বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে সেটি পরিশোধ না করারও সুযোগ নিতে পারে, তাহলে তারা কখনোই পুঁজিবাজারমুখী হবে না।

তৃতীয় বিষয়টি সম্পূর্ণ অর্থনৈতিক। সাধারণ মানুষ যে কারণে যেকোনো উপায়ে তাদের উপার্জিত বা সঞ্চিত অর্থ বিনিয়োগ করতে চায়, তা হলো প্রবহমান মুদ্রাস্ফীতি। গত এক দশকে দেশের বাজারে প্রতিবছর গড় মুদ্রাস্ফীতি ৫ শতাংশের ওপরে। এটি সরকারি হিসাব। বাস্তবে মুদ্রাস্ফীতির হার আরও বেশি হওয়ার আশঙ্কা আছে। পূর্ববর্তী বছরের সঙ্গে বর্তমান বছরগুলোয় নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের বাজারদরের বিষয়টি তুলনা করলে এ সম্ভাবনাকে সত্যি মনে হবে। যদি সরকারি হিসাবই ধরি, তাহলেও মুদ্রাস্ফীতির কারণে প্রতিবছরই মানুষের সঞ্চিত অর্থের প্রকৃত মান ৫ শতাংশ হারে কমে যাচ্ছে। তাই মানুষ চায় যেকোনো খাতে বিনিয়োগের মাধ্যমে তাঁর পুঁজির পরিমাণ বৃদ্ধি করতে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, দেশে যে হারে জিডিপি ও মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি পাচ্ছে, সে হারে বিনিয়োগের যথাযথ ক্ষেত্র তৈরি হচ্ছে না। এর ফলে মানুষ যেখানে–সেখানে বিনিয়োগ করতে উৎসাহিত হচ্ছেন। বিদেশে টাকা পাচার বৃদ্ধির পেছনের কারণও এটি। মোটকথা, অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রার সঙ্গে সঙ্গে মানুষের আয় বাড়ছে। কিন্তু সে আয়ের প্রকৃত মূল্য ধরে রাখার জন্য বেসরকারি খাতে বিনিয়োগের যে সুযোগ থাকার কথা তা নেই। যার কারণে মানুষ ঝুঁকি নিয়ে যেখানে–সেখানে অর্থ লগ্নি করতে বাধ্য হচ্ছে। আর এর ফলেই কয়েক বছর পর পর আমরা নতুন নতুন ফ্রড ব্যবসার বিস্তার দেখতে পাই। যার শেষ পরিণতি হয় সাধারণ মানুষকে নিঃস্ব করে।

উপরিউক্ত তিনটি মূল সমস্যার মধ্যেই এর সমাধান নিহিত রয়েছে। অভ্যন্তরীণ বিনিয়োগ পরিবেশ উন্নত করতে হবে। আর্থিক খাতে সুশাসন ও নীতিমালার যথাযথ প্রয়োগ থাকলে এমএলএম বা ই-কমার্সের নামে মানুষের টাকা কুক্ষিগত করার সুযোগ কেউ পেত না। ব্যবসায়িক পরিবেশের সূচকগুলো নিয়ে কেন্দ্রীয় পরিকল্পনা এবং বিকেন্দ্রীভূত বাস্তবায়নের কৌশল থাকতে হবে। একটি ব্যবসার অনুমোদন নেওয়া থেকে শুরু করে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি–সংযোগ সহজেই নিশ্চিত করতে হবে। পুঁজিবাদী অর্থনীতির যেকোনো দেশের জন্য পুঁজিবাজার একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ।

পুঁজিবাজারের শৃঙ্খলা ও সিন্ডিকেটমুক্ত করার দাবি অনেক পুরোনো। উদীয়মান ও জায়ান্ট অর্থনীতির প্রতিটি দেশের পুঁজিবাজারে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের স্বার্থটি গুরুত্ব দিয়ে দেখা হয়। সাধারণ মানুষের ক্ষুদ্র পুঁজিকে ফ্রড ব্যবসার হাত থেকে রক্ষা করার জন্য পুঁজিবাজারে মানুষের আস্থা ফিরিয়ে আনা আবশ্যক।