বাংলায় বাজেট শব্দটি প্রথম ব্যবহার করেন রবীন্দ্রনাথ

সুলেখক আকবর আলি খানের বই মানেই জটিল সব বিষয়ের সরস, সুখপাঠ্য ও তির্যক রচনা। অর্থনীতিই তাঁর লেখার মূল বিষয়। তবে অর্থনীতির বাইরের বিষয়েও যে তিনি অগাধ পাণ্ডিত্য ও মুনশিয়ানা দেখিয়েছেন, সেই নজির আমাদের সামনে আছে।

বৈচিত্র্যে ভরা তাঁর জীবন। ছিলেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা। তার আগে ছিলেন মন্ত্রিপরিষদ সচিব ও অর্থসচিব। মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়ার কারণে তাঁর অনুপস্থিতিতে তাঁকে ১৪ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেয় তখনকার সামরিক আদালত। বাংলা-ইংরেজি মিলিয়ে তাঁর প্রকাশিত বই ১৭টি। সর্বশেষ বই ‘বাংলাদেশে বাজেট: অর্থনীতি ও রাজনীতি’ প্রথমা প্রকাশন থেকে বেরিয়েছে দুই মাস আগে। ঈদের ছুটিতে এটি পড়ছিলাম আর ভাবছিলাম, তিন সপ্তাহ পরই ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেট ঘোষণা। সময়টাও মিলে গেল। আগামী ৩ জুন নতুন বাজেট ঘোষণা করবেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল।    

আকবর আলি খান
ছবি। প্রথম আলো

আকবর আলি খান লিখেছেন, ‘আলোচনার “বাজেট” ইংরেজি শব্দ। মধ্যযুগের ইংরেজি বুজেট (Bougette) থেকে এর উৎপত্তি। বুজেট অর্থ মানিব্যাগ বা টাকার থলি। বাংলায় এর পরিভাষা এখনো রচিত হয়নি। ফলে সরকারি ক্রিয়াকাণ্ডে বাজেট শব্দটিই ব্যবহৃত হয়ে আসছে। বাংলা একাডেমির বিবর্তনমূলক বাংলা অভিধানে বলা হয়েছে, ১৯০২ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলায় বাজেট শব্দটি প্রথম ব্যবহার করেন।’

বাজেট শব্দটি এল কীভাবে, তার একটি ব্যাখ্যা নিয়ে আসেন আকবর আলি খান। তিনি বলছেন, ‘১৭২৫ থেকে ১৭৪২ সাল পর্যন্ত রবার্ট ওয়ালপুল ছিলেন যুক্তরাজ্যের অর্থমন্ত্রী এবং কার্যত প্রথম প্রধানমন্ত্রী। অর্থমন্ত্রী হিসেবে তিনি সারা বছরই কর কমানো বা কর বাতিলের দাবি পেতেন। সরকারি ও বেসরকারি—উভয় খাত থেকেই নতুন কর আরোপ বা পরিবর্তনের সলাপরামর্শ আসত। আসত নতুন ব্যয়ের দাবিও। এসব তিনি একটি বুজেটে বা মানিব্যাগে ভরে রাখতেন। অর্থবছরের শেষ দিকে যখন বাজেট তৈরির কাজ শুরু হতো, তখন তিনি কাগজগুলোর ভিত্তিতেই বাজেট প্রণয়ন করতেন।’

মানিব্যাগ থেকে ব্রিফকেস

বইটিতে উল্লেখ করা হয়, শিল্পবিপ্লবের পর ইংল্যান্ডের অর্থনীতি অনেক বড় হয়ে যায়। বাজেটবিষয়ক প্রস্তাবগুলো শুধু একটা মানিব্যাগে সংকুলান করা সম্ভব ছিল না। মানিব্যাগের জায়গায় তাই আসে ব্রিফকেস। ব্রিফকেস ব্যবহারের অন্য কারণও ছিল। সেটি হচ্ছে, বাজেটে কোন কর বাড়বে বা কোন কর কমবে, তার গোপনীয়তা বজায় রাখা অপরিহার্য। ব্রিফকেসের ভেতরে থাকা বাজেটের কোনো তথ্য জেনে ব্যবসায়ীরা রাতারাতি বড়লোক বনে যেতে পারেন। ফলে সংগত কারণেই সংসদে বাজেট পেশের আগে প্রস্তাবগুলো গোপন রাখা চাই। যে অর্থমন্ত্রী বাজেটের গোপনীয়তা বজায় রাখতে পারেন না, তার পক্ষে অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করা সম্ভব নয়।

বাজেট ফাঁসে অর্থমন্ত্রীর পদত্যাগ

অধ্যাপক হিউ ডালটন

গল্প করার ঢঙে বই লেখেন আকবর আলি খান। পরার্থপরতার অর্থনীতি, অবাক বাংলাদেশ: বিচিত্র ছলনাজালে রাজনীতি, আজব ও জবর-আজব অর্থনীতিতেও তা দেখা গেছে। আকবর আলি খান বলছেন, ১৯৪৭ সালের ঘটনা। যুক্তরাজ্যের অর্থমন্ত্রী ছিলেন লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকসের অধ্যাপক হিউ ডালটন। ব্রিফকেসে বাজেট নিয়ে যখন সংসদে ঢুকছিলেন, নতুন কর নিয়ে সাংবাদিকেরা কিছু প্রশ্ন করেন তাঁকে। তিনিও ঠিক জবাব দেন। আর এই খবর টেলিফোনের মাধ্যমে পত্রিকা অফিসে পৌঁছে যায় তাৎক্ষণিকভাবে। কোনো কোনো খবরের কাগজ শুধু এই সংবাদকে গুরুত্ব দিয়ে বিশেষ সংখ্যাও প্রকাশ করে।

হিউ ডালটন যখন সংসদে মুদ্রিত বাজেট পড়ছিলেন, তখন সংসদ সদস্যদের কাছে পৌঁছে যায় পত্রিকার কপি। বাজেট ফাঁস হয়ে গেছে, এই দাবিতে সংসদে হইচই শুরু করে বিরোধী দল। হিউ ডালটন ভুল স্বীকার করেন এবং অর্থমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করেন।

বাজেটের ভিত্তি জনপ্রতিনিধিদের সম্মতি

সাংবিধানিক দিক থেকে বাজেটের ভিত্তি হচ্ছে ‘নো ট্যাক্সেশন উইদাউট রিপ্রেজেনটেশন’ অর্থাৎ জনপ্রতিনিধিদের সম্মতি ছাড়া কোনো কর আদায় করা যাবে না। রাষ্ট্র পরিচালনায় জনগণের সম্মতির প্রয়োজনীয়তা ইংল্যান্ডে স্বীকৃত হয় দ্বাদশ শতকে ম্যাগনা কার্টা বিদ্রোহের সময়।

১২১৫ সালে রাজা জন চুক্তিতে সই করেন

ম্যাগনা কার্টা বিদ্রোহ নিয়ে বিশদ ব্যাখ্যায় যাননি আকবর আলি খান। উইকিপিডিয়ার তথ্য অনুযায়ী, ম্যাগনা কার্টা ইংল্যান্ডের একটি চুক্তি, যা ১২১৫ সালে স্বাক্ষরিত হয়। ঐতিহাসিকভাবে ম্যাগনা কার্টা এতটাই গুরুত্বপূর্ণ যে একে বর্তমান সাংবিধানিক শাসনের সূচনা বলা যেতে পারে। ১১৮৮ সালে রাজা দ্বিতীয় হেনরি সব অস্থাবর সম্পত্তির ওপর কর ধার্য করেন। যুদ্ধের বিপুল ব্যয়ভার রাজার ওপর এমন চাপ সৃষ্টি করেছিল যে, অতিরিক্ত কর ধার্য করা ছাড়া কোনো উপায় ছিল না তাঁর।

অন্যদিকে রাজা দ্বিতীয় হেনরির দুই পুত্র রিচার্ড ও জন ছিলেন স্বৈরাচারী। তাঁরাও পরে রাজা হন। বিশেষ করে রাজা জনের স্বেচ্ছাচারমূলক কাজের জন্য ভূস্বামীরা অতিষ্ঠ হয়ে রাজার ক্ষমতা সংকোচনের জন্য সচেষ্ট হয়ে ওঠেন। ১২১৫ সালে রাজা জন সামন্তদের চাপে পড়ে রাজার অধিকারসংক্রান্ত চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন। এরপর রাজাকেও হতে হয়েছিল নিয়মের অধীন।

তবে ক্ষমতালিপ্সু রাজা সহজেই এই চুক্তিতে স্বাক্ষর করতে চাননি। সব সামন্ত মিলে রাজা জনকে লন্ডনের কাছে এক দ্বীপে বন্দী করে এই চুক্তিতে স্বাক্ষর করতে বাধ্য করেন। এই ম্যাগনা কার্টার ওপর ভিত্তি করেই ভারতীয় সংবিধান রচিত হয়েছে।

বাজেটের গোপনীয়তা

এ বিষয়ে আরেকটি গল্প উল্লেখ করেন আকবর আলি খান। সেটি হচ্ছে, ম্যাগনা কার্টা মতবাদ একটা সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসী ইংরেজদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে ব্যাপকভাবে। ১৭৬০-এর দশকে বোস্টন নগরীতে বিদ্রোহী মার্কিন নাগরিকেরা ম্যাগনা কার্টা মতবাদের ভিত্তিতে নতুন করারোপের বিরোধিতা করেন। কারণ, ম্যাসাচুসেটসের গভর্নর ফরাসিদের সঙ্গে যুদ্ধের খরচ বহন করার জন্য বাড়তি অর্থের প্রয়োজন বোধ করলে এশিয়া থেকে আমদানি করা চায়ের ওপর অতিরিক্ত কর বসান তিনি।

জনপ্রতিনিধিদের সম্মতি না নেওয়ায় বোস্টনের ব্যবসায়ীরা এই কর দিতে অস্বীকৃতি জানান এবং আমদানি করা চায়ের বাক্স নদীতে নিক্ষেপ করেন।

আকবর আলি খান বলেন, বাজেটের গোপনীয়তা বজায় রাখতে হবে। এই গোপনীয়তা শুধু অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব নয়, অর্থসচিবসহ এ বিষয়ে কাজ করা অন্যদেরও দায়িত্ব। অনেক দেশে বাজেটের আগের সপ্তাহে অর্থ মন্ত্রণালয়ের মুখ্য কর্মকর্তাদের একটি হোটেলে প্রায় বন্দী অবস্থায় রাখা হতো, যাতে কেউ তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে না পারেন। তবে অনেক দেশের সংসদেই কর প্রস্তাব আর গোপন থাকে না। কর-প্রস্তাব নিয়ে প্রকাশ্যে আলাপ-আলোচনা হয়, দর-কষাকষি হয় এবং আপস করা হয়।