বিনা ভোটে প্রভাবশালীদের কবজায়

নেতৃত্ব নির্বাচনে ভোট না করার এফবিসিসিআইয়ের উদাহরণ অনুসরণ করছে অনেক পণ্যভিত্তিক ব্যবসায়ী সংগঠন। সমঝোতায় কমিটি হচ্ছে।

সাধারণ সদস্যদের ভোটে একসময় নেতৃত্ব নির্বাচন হলেও সেই পথে আর নেই দেশের ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই। সমঝোতার ভিত্তিতে সংগঠনটির পরিচালনা পর্ষদ হচ্ছে। সেখানে প্রভাবশালী ব্যবসায়ীরাই জায়গা করে নিচ্ছেন। সরকারদলীয় রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত এমন ব্যবসায়ীরা হচ্ছেন এফবিসিসিআইয়ের শীর্ষ পর্যায়ের নেতা।

নেতৃত্ব নির্বাচনে ভোট না করার এফবিসিসিআইয়ের উদাহরণ অনুসরণ করছে অনেক পণ্যভিত্তিক ব্যবসায়ী সংগঠন। সেগুলোতেও সমঝোতায় কমিটি হচ্ছে। জেলা চেম্বার থেকেও ভোট উধাও হয়ে গেছে। ফলে ব্যবসায়ীদের নেতা এখন আর ব্যবসায়ীরা নির্বাচিত করেন না। কাজটি করেন সরকারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। যদিও দীর্ঘ আট বছর পর নেতৃত্ব নির্বাচনে ভোটের ধারায় ফিরেছে তৈরি পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ। তবে পোশাক খাতের আরেক সংগঠন বিকেএমইএতে দীর্ঘদিন নির্বাচন হয় না।

এফবিসিসিআইয়ের ২০২১-২৩ মেয়াদের পরিচালনা পর্ষদ গত রোববার চূড়ান্ত হয়েছে। পরিচালক থেকে শুরু করে সভাপতি ও সাত সহসভাপতি পদের নির্বাচনের কোনো পর্যায়েই ভোট হয়নি। সমঝোতার ভিত্তিতে পদগুলোতে বসেছেন প্রভাবশালী ব্যবসায়ীরা। শীর্ষ পদ বাগাতে এক জেলার ব্যবসায়ী আরেক জেলা চেম্বার থেকে ভোটার হয়ে প্রথমে পরিচালক, পরে সহসভাপতি হওয়ার ঘটনাও ঘটেছে।

এফবিসিসিআইয়ের সাবেক এক সভাপতি ও বর্তমান এক সহসভাপতি জানান, সভাপতি পদের জন্য সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে কয়েক মাস আগেই সবুজ সংকেত পান জসিম উদ্দিন। তবে সহসভাপতি পদ নিয়ে বেশ দর–কষাকষি হয়েছে। এম এ রাজ্জাক খান ও সালাউদ্দিন আলমগীরের জন্য সংগঠনের বর্তমান সভাপতি, হাবিব উল্লাহর জন্য সাবেক সভাপতি শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন, এম এ মোমেনের জন্য আরেক সাবেক সভাপতি এ কে আজাদ সুপারিশ করেন। আমিনুল হক ও সালাউদ্দিন আলমগীরকে জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি করার জন্য রাজনৈতিক চাপ ছিল। তবে নতুন সভাপতি সংগঠন পরিচালনার স্বার্থে মোস্তফা আজাদ চৌধুরীকে পছন্দ করেন।

এফবিসিসিআইয়ে সর্বশেষ ভোট হয় ২০১৭ সালে, তা–ও আংশিক। ওই সময় সভাপতি হন শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন। পরিচালক পদেও চেম্বার অংশে ভোট ছাড়া বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় প্রার্থীরা নির্বাচিত হন। তবে পণ্যভিত্তিক সংগঠন বা অ্যাসোসিয়েশন অংশে তখন ভোট হয়েছিল।

সমঝোতায় ৭৮ পরিচালক

২০২১-২৩ মেয়াদের জন্য সংগঠনটিতে মোট পরিচালক পদ ৮০টি। এসব পদ আবার দুই ভাগে বিভক্ত। এক ভাগে জেলাভিত্তিক বাণিজ্য সংগঠন বা চেম্বার থেকে ৪০ জন পরিচালক হন। বাকি পদ পণ্যভিত্তিক ব্যবসায়ী সংগঠনের জন্য সংরক্ষিত।

চেম্বার ও অ্যাসোসিয়েশন গ্রুপ থেকে ৩৪ জন মনোনীত পরিচালক পদের বিপরীতে আবেদন করেন ৩২ জন ব্যবসায়ী। অন্যদিকে সরাসরি ভোটের জন্য চেম্বার গ্রুপের ২৩ পরিচালক পদের বিপরীতে ২৫ জন প্রার্থী হয়েছিলেন। আর অ্যাসোসিয়েশন গ্রুপ থেকে ২৩ পদের বিপরীতে প্রার্থী হন ২৬ জন। তবে খেলাপি হওয়ায় অ্যাসোসিয়েশন গ্রুপের একজন প্রার্থিতা হারান। এরপরও চেম্বার ও অ্যাসোসিয়েশন গ্রুপে ২ জন করে ৪ জন বেশি প্রার্থী ছিলেন। পরে সমঝোতার মাধ্যমে ৪ জন মনোনয়ন প্রত্যাহার করে নেন। এতে ৫ মে আর ভোট হয়নি।

নেতৃত্বে প্রভাবশালীরা

এফবিসিসিআইয়ের নতুন সভাপতি জসিম উদ্দিন প্রভাবশালী ব্যবসায়ী। ২০১০-১২ সালে সংগঠনের জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি ছিলেন। তাঁর মালিকানাধীন বেঙ্গল গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের প্লাস্টিক পণ্য, আবাসন, গণমাধ্যম, তৈরি পোশাক, খাদ্যসহ বিভিন্ন ধরনের ব্যবসা রয়েছে। বেঙ্গল কমার্শিয়াল নামে একটি নতুন ব্যাংকেরও অনুমোদন পেয়েছেন জসিম উদ্দিন। তিনিই ব্যাংকটির চেয়ারম্যান পদে রয়েছেন। তাঁর ভাই বেঙ্গল গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের চেয়ারম্যান মোরশেদ আলম একজন সংসদ সদস্য, যিনি এখন মার্কেন্টাইল ব্যাংকের চেয়ারম্যান।

সংগঠনের নতুন জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি হয়েছেন মোস্তফা আজাদ চৌধুরী। তিনি রংপুর চেম্বারের সাবেক সভাপতি। পরিবহন ও হিমাগার খাতের এই ব্যবসায়ীর ছোট ভাই মোস্তফা সোহরাব চৌধুরী বর্তমানে রংপুর চেম্বারের সভাপতি।

এদিকে চেম্বার গ্রুপ থেকে এফবিসিসিআইয়ের সহসভাপতি হয়েছেন ময়মনসিংহ চেম্বারের সভাপতি মো. আমিনুল হক। তিনি জেলা আওয়ামী লীগ ও সড়ক পরিবহন সমিতির সহসভাপতি। ঠিকাদারি ও আবাসন ব্যবসার সঙ্গে জড়িত আমিনুল হক কক্সবাজারের রয়েল টিউলিপ হোটেলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদেও আছেন।

পদ পেতে ‘কৌশল’

লাবিব গ্রুপের চেয়ারম্যান সালাউদ্দিন আলমগীর এফবিসিসিআইয়ের সহসভাপতি হয়েছেন। সংগঠনের পদ পেতে তিনি পিরোজপুর চেম্বার থেকে প্রার্থী হন। যদিও তাঁর বাড়ি টাঙ্গাইলের সখীপুরে। পোশাক খাতের বড় এই ব্যবসায়ী আগের মেয়াদে বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রিজ (বিসিআই) থেকে মনোনয়ন নিয়ে এফবিসিসিআইয়ের পরিচালক হয়েছিলেন। তিনি মধুমতি ব্যাংকেরও পরিচালক।

জানতে চাইলে পিরোজপুর চেম্বারের সাবেক একজন সহসভাপতি প্রথম আলোকে জানান, চেম্বার থেকে চারজন ভোটারের নাম পাঠানো হয়েছে। তাঁদের মধ্যে সালাউদ্দিন আলমগীরও আছেন। তিনি প্রথমবারের মতো এ চেম্বারের সদস্য হয়েছেন। তবে টেলিকম ব্যবসার যে ট্রেড লাইসেন্স দিয়ে সালাউদ্দিন আলমগীর চেম্বারের সদস্য হয়েছেন, সেটির সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।

মিনিস্টার গ্রুপের চেয়ারম্যান এম এ রাজ্জাক খান এফবিসিসিআইয়ের নতুন কমিটির সহসভাপতি হয়েছেন। তাঁর পৈতৃক বাড়ি চুয়াডাঙ্গায় হলেও তিনি মেহেরপুর চেম্বারের প্রতিনিধি হিসেবে প্রথমে পরিচালক ও পরে সহসভাপতি হয়েছেন।

জানতে চাইলে মেহেরপুর চেম্বারের একজন নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে জানান, এফবিসিসিআইয়ের বর্তমান সভাপতির সুপারিশে তিন বছর আগে এম এ রাজ্জাক খানকে মেহেরপুর চেম্বারের সদস্য করা হয়।

আমদানি করা পুরোনো গাড়ি ব্যবসায়ীদের সংগঠন বারভিডার সাবেক সভাপতি হাবিব উল্লাহ বাংলাদেশ চামড়া পণ্য উৎপাদক সমিতির হয়ে এফবিসিসিআইয়ের পদ নিয়েছেন। তার আগে তিনি বারভিডা থেকেই সংগঠনটির পরিচালক হয়েছিলেন। এবার বারভিডায় জায়গা না পেয়ে পুরান ঢাকার ওই সংগঠনে নাম লেখান। যদিও চামড়া খাতের ব্যবসায়ী নেতারা জানান, চামড়া পণ্য উৎপাদক সমিতি মূল ধারার কোনো সংগঠন নয়। হাবিব উল্লাহ প্রথম আলোর কাছে দাবি করেন, ৩০ বছর আগে সংগঠনটি গঠিত হয়েছে।

পুরো বিষয়টি নিয়ে এফবিসিসিআইয়ের নবনির্বাচিত সভাপতি জসিম উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি আগে দুইবার ভোটে পাস করেই পর্ষদে ছিলাম। এবারও আমি ভোট করতে চেয়েছিলাম, কিন্তু অনেকেই ভোট করতে চাননি। অবশ্যই ভোটের মাধ্যমে নেতৃত্ব নির্বাচিত হলে ভাবমূর্তি ভালো হতো। অন্য রকম শক্তি থাকত।’ তিনি বলেন, ‘এফবিসিসিআইয়ের কাঠামোতে পরিবর্তন দরকার। আমি দায়িত্ব নেওয়ার পর কাঠামোতে পরিবর্তন আনার চেষ্টা করব।’