বেগুনে তবু দরাদরি চলে, দেশি শসা ‘এক দাম ১২০’

শশা দামাদামি করেও শেষ পর্যন্ত কিনলেন না ক্রেতা
ছবি: মাকসুদা আজীজ

কারওয়ান বাজারের সবজি বাজারে পেছনের রাস্তার এক প্রান্তে বসে সবজি বিক্রি করেন মাঝবয়সী শওকত খান। তাঁর দাবি, তিনি তাজা সবজি বিক্রি করেন। রোজার দ্বিতীয় দিনে তাঁর কাছে জানতে চাইলাম, শসার দাম কত? তিন শব্দের জবাব, ১২০ টাকা কেজি।

শুধু একা শওকত খান নন, কারওয়ান বাজারের ওই রাস্তাজুড়ে বসে থাকা বিক্রেতাদের প্রায় সবাই মোটামুটি এই দামই হাঁকছেন। দেশি শসা ১২০ টাকা কেজি। আর বেগুন ১২০ টাকা। দরাদরি করলে বেগুনের দাম ১০ থেকে ২০ টাকা কমছে। কিন্তু দেশি শসার এক দাম। কাঁচাবাজারে সাধারণত এক দামে কিছু বিক্রি হয় না। কিন্তু রোজায় চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় রাজধানীর সবচেয়ে বড় পাইকারি বাজারের বিক্রেতারা দেশি শসাকে ‘এক দামের পণ্য’ বানিয়ে ফেলেছেন।  

সাধারণত পণ্যের খুচরা দাম ঠিক হয় পাইকারি দামের ওপর ভিত্তি করে। কারওয়ান বাজারের যে রাস্তাটির কথা বলছি, তার থেকে বড়জোর ১০০ হাতের ব্যবধানে পাইকারি সবজির বাজার। ধরে নেওয়া যাক, দোকান ভাড়া, পরিবহনসহ অন্যান্য খরচ বাদে পাইকারি দামের চেয়ে ১০ টাকা বেশি দামে খুচরায় ওই শসা বিক্রি করা হচ্ছে। সেই হিসাবে এক কেজি শসার পাইকারি দাম হওয়ার কথা ১০০ থেকে ১০৫ টাকা।

খুচরা বিক্রেতা শওকত খানের কাছে তাই জানতে চেয়েছিলাম পাইকারি বাজার থেকে প্রতি কেজি শসা কত টাকায় কিনেছেন তিনি। প্রথমে বললেন, ৮০ থেকে ৯০ টাকা। পরক্ষণেই বললেন ৬০ থেকে ৭০ টাকা। শওকত খানের স্বীকারোক্তি যদি সত্য হয়, তাহলে ১০০ হাতের ব্যবধানে পাইকারি ও খুচরা বাজারের মধ্যে প্রতি কেজি শসার দামের পার্থক্য দাঁড়ায় সর্বনিম্ন ৩০ থেকে সর্বোচ্চ ৬০ টাকা। অথচ গত মঙ্গলবারও কারওয়ান বাজারে প্রতি কেজি শসা বিক্রি হয়েছে ৪০ টাকায়।

কারওয়ান বাজারের মুদিদোকানের গলির মুখে সবজি নিয়ে বসেন রত্না। মূলত নিম্ন আয়ের মানুষেরাই রত্নাদের মতো বিক্রেতার কাছ থেকে পণ্য কেনেন। বাজারের একটু পুরোনো বা কিছুটা নষ্ট হওয়া সবজি কুড়িয়ে এনে বা কম দামে কিনে সেগুলো ভাগা দিয়ে বিক্রি করেন রত্নার মতো আরও অনেকে। রত্নার পণ্যের ঝুড়িতেও ছিল শসা। যতটুকু দেখা গেল, সেসব শসার কোনোটির অর্ধেকটা, আর কোনোটির কিঞ্চিৎ অংশ পচা। সেগুলোরও কেজি নাকি ৮০ টাকা। রত্নার কাছে জানতে চাইলাম, এ শসা কারা কেনে? কেন কিনবে? রত্নার সাফ জবাব, ‘কিনবে না মানে, বাজারে এর চেয়ে কম দামে আছে নাকি?’

রত্না, শওকতেরা শসার দামে ছাড় দিতে নারাজ। কারণ, তাঁরা জানেন, ইফতারে পাতে শসার কদর বেশি। তাই দামের কারণে চাহিদায় ঘাটতি পড়বে না। কিছু সময় দাঁড়িয়ে থেকে চাহিদার সেই দৃশ্যটির দেখাও মিলল। দাম নিয়ে ক্রেতাদের অভিযোগ থাকলেও বাজারভর্তি ব্যাগে শসার জায়গা উপরিভাগেই।

শুধু কি শসা? রোজার বাজারে দামের দৌড়ে পিছিয়ে নেই অন্যান্য সবজিও। মঙ্গলবারের ৫০ টাকা কেজির কাঁচামরিচ আজ বিক্রি হচ্ছে ৭০ থেকে ৮০ টাকায়। নতুন ঢ্যাঁড়স, পটোল, ঝিঙে, ধুন্দুলের মতো সবজিও ৬০ থেকে ৮০ টাকার কমে মিলছে না। অথচ গত সপ্তাহেও এসব সবজির কেজি ছিল ৪০ থেকে ৫০ টাকা। দ্রুত পচনশীল টমেটোর দামও দ্বিগুণ বেড়ে এখন ৪০ টাকা কেজি। বৈশাখের এই দাবদাহে তাই সালাদে শসা-টমেটোকে এক করতে হলে তার জন্য গুনতে হবে চড়া দাম। দামের যা অবস্থা, শসা ও টমেটো একটি বা দুটি হিসেবে বিক্রি হওয়াটা এখন সময়ের দাবি। যদিও দেশে সবজি এখনো কেজি হিসেবে বিক্রি হয়।

সাধারণত ঢাকার অন্যান্য বাজারের চেয়ে কারওয়ান বাজারে পণ্যের দাম কিছুটা কম থাকে। এ কারণে দূরদূরান্ত থেকেও অনেকে এ বাজারে আসেন। তবে চলমান বিধিনিষেধের কারণে গতকাল বাজারে ক্রেতা খুব বেশি ছিল না। এদিন গুলশান-১ ও বনানীর মতো অভিজাত এলাকার কাঁচাবাজারে খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, সেখানকার বাজারে শসার দাম কারওয়ান বাজারকে ছাড়াতে পারেনি। এমনকি বিভিন্ন অনলাইন কাঁচাবাজার ও সুপারশপে প্রতি কেজি শসার সর্বোচ্চ মূল্য ৬০ টাকা।

তাই ইফতারের ঘণ্টাখানেক আগে কারওয়ান বাজার এলাকার অফিসফেরত লোকজন বাজারে ঢুকে বের হন মুখ গোমড়া করে। তাঁদের কেউ কেউ মুঠোফোনে অপর প্রান্তের মানুষের কাছে করুণ স্বরে তাই জানতে চান, শসা বা বেগুন আজ না হলে কি হয় না?

ক্রেতার মুখ যতই মলিন আর কণ্ঠ যতই করুণ হোক, এ মূল্যবৃদ্ধিতে খুশি কারওয়ান বাজারের আম্বরশাহ জামে মসজিদের সামনে দাঁড়ানো ফেরিওয়ালা মো. মিলন। তিনি একেকটি শসা চাক চাক করে কেটে ১৫০ গ্রামের প্যাকেটে বিক্রি করছেন। প্রতি প্যাকেটের দাম ১০ টাকা। এটাই এখন বাজারের সবচেয়ে কম দামি শসা। রীতিমতো ভিড় করে মিলনের এ শসা কিনছেন ছিন্নমূল ক্রেতারা। মিলন জানালেন, ভোরে ফজর নামাজ পড়ে শসা কিনেছেন ২৫০ টাকা পাল্লা (৫ কেজি)। সেই শসাই কেটেকুটে গ্রাম হিসেবে বিক্রি করছেন।

বৈশাখের এই দাবদাহে তাই সালাদে শসা-টমেটোকে এক করতে হলে তার জন্য গুনতে হবে চড়া দাম। দামের যা অবস্থা, শসা ও টমেটো একটি বা দুটি হিসেবে বিক্রি হওয়াটা এখন সময়ের দাবি।

রোজা ও ঈদ সামনে রেখে বাজারে পণ্যের দাম বৃদ্ধির ঘটনা নতুন কোনো প্রবণতা নয়। প্রতিবছরই পণ্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে সরকারের পক্ষ থেকে নানা উদ্যোগ গ্রহণের কথা বলা হলেও তার সুফল ক্রেতারা পান না। এ বছর এরই মধ্যে রোজার পণ্য ছোলা, পেঁয়াজ, ভোজ্যতেল, মসুর ডাল, চিনি ও খেজুরের দাম বেঁধে দিয়েছে কৃষি বিপণন অধিদপ্তর

কিন্তু সেই বেঁধে দেওয়া দামও বাঁধন ছিঁড়েছে। আর দাম বেঁধে দিয়ে কাজ সারা অধিদপ্তরের। বাজারে বোতলজাত সয়াবিন তেল প্রতি লিটার ১৩৯ টাকা আর পাঁচ লিটারের বোতল ৬৬০ টাকা। মসুর ডালের দাম মানভেদে প্রতি কেজি ৭৫ থেকে ১১০ টাকা। অথচ মসুরের বেঁধে দেওয়া দাম ১০৩ টাকা। প্রতি কেজি চিনি এদিন কারওয়ান বাজারে বিক্রি হয় ৭০ টাকায়, যা বেঁধে দেওয়া দামের চেয়ে ২ টাকা বেশি।