ভোজ্যতেলে ভ্যাট প্রত্যাহারে দাম কমবে সামান্যই

ভোজ্য তেল
ফাইল ছবি

নিত্যপ্রয়োজনীয় সব পণ্যের ঊর্ধ্বগতি ঠেকাতে সরকারের একেকজন মন্ত্রী একেক কথা বলে আসছিলেন পাঁচ দিন ধরেই। বৈঠক হয়েছে দুই দফা। এক সপ্তাহ আগে আদালতে রিটও হয় একটি। শেষ পর্যন্ত শুধু ভোজ্যতেলের ওপর মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) প্রত্যাহার করেছে সরকার। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) গতকাল সোমবার এ ব্যাপারে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, ভোজ্যতেলের দাম এতে এক থেকে দেড় টাকা কমতে পারে, এর বেশি নয়।

প্রজ্ঞাপনে দেখা যায়, পরিশোধিত সয়াবিন তেল ও পরিশোধিত পাম তেলের স্থানীয় উৎপাদন ও ব্যবসায় পর্যায়ে সব ভ্যাট প্রত্যাহার করা হয়েছে এবং আগামী ৩০ জুন পর্যন্ত এ সুযোগ বহাল থাকবে। বর্তমানে সয়াবিন ও পাম তেলের উৎপাদন পর্যায়ে ১৫ শতাংশ এবং ব্যবসা পর্যায়ে ৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপ আছে। তবে আমদানি পর্যায়ে ভোজ্যতেল আমদানিতে ১৫ শতাংশ ভ্যাট আছে। এ ভ্যাট প্রত্যাহার করা হয়নি।

এনবিআরের প্রজ্ঞাপন নিয়ে জানতে চাইলে গতকাল ফোনে থাইল্যান্ড থেকে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘দ্রব্যমূল্য সহনীয় পর্যায়ে রাখতে প্রয়োজনীয় সব উদ্যোগ নেওয়া হবে। আমি যেটা বলেছি, সেটাই হবে। ভোজ্যতেলে প্রয়োজনে আমদানি পর্যায়েও ভ্যাট কমানো হবে।’

প্রজ্ঞাপন জারির পর ভোজ্যতেল ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এ শুল্ক প্রত্যাহারে এক থেকে দুই টাকা কমতে পারে ভোজ্যতেলের দাম। দরকার ছিল আমদানি পর্যায়ে ভ্যাট কমানো। সেটি না হওয়া পর্যন্ত বাজারে প্রভাব পড়বে না।

সিটি গ্রুপের পরিচালক বিশ্বজিৎ সাহা গতকাল উদাহরণ দিয়েই প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমদানির পর উৎপাদন পর্যায়ে যদি ১৫ থেকে ২০ টাকা মূল্য সংযোজন হয়, তাহলে এর ওপর এক থেকে দেড় টাকা কমতে পারে।’

এদিকে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ও গতকালের এনবিআরের প্রজ্ঞাপনটিকে ইতিবাচকভাবে দেখেনি। প্রজ্ঞাপন জারির পর পরই গতকাল বিকেলে এনবিআর চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিমকে চিঠি পাঠিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। আসন্ন পবিত্র রমজান ও মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বিবেচনা করে শুধু উৎপাদন ও ব্যবসায়িক পর্যায়ে নয়, আমদানিসহ ভোজ্যতেলের ক্ষেত্রে সব পর্যায়েই ভ্যাট প্রত্যাহারের অনুরোধ করা হয় চিঠিতে। ভোজ্যতেল বলতে অপরিশোধিত সয়াবিন, পরিশোধিত ও অপরিশোধিত পাম তেল এবং পাম ওলিনকে বোঝানো হয়।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের চিঠিতে বলা হয়, ‘আন্তর্জাতিক বাজারে ভোজ্যতেলের দাম অস্বাভাবিক হারে বাড়ায় দেশীয় বাজারেও উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। আসন্ন পবিত্র রমজানে ভোজ্যতেল মানুষের ক্রয়সীমার মধ্যে রাখতে হলে সরবরাহব্যবস্থা স্থিতিশীল রাখতে হবে। বর্তমানে আন্তর্জাতিক বাজারে অপরিশোধিত সয়াবিন ও পাম তেলের যে দাম, স্থানীয় কারখানায় পরিশোধিত হয়ে এগুলো বাজারে ঢুকলে দাম আরও বৃদ্ধির আশঙ্কা রয়েছে।

চিঠিতে ১৩ মার্চ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত বৈঠকে সব পর্যায়ে ভ্যাট প্রত্যাহারের যে সিদ্ধান্ত হয়, তা–ও এনবিআর চেয়ারম্যানকে মনে করিয়ে দেওয়া হয়।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী দেশে বছরে ২০ লাখ টন ভোজ্যতেলের চাহিদা রয়েছে। এর মধ্যে পবিত্র রমজান মাসের চাহিদা তিন লাখ টনের কাছাকাছি। স্থানীয় উৎপাদন হয় দুই লাখ টন, বাকি ১৮ লাখ টনই আমদানি করতে হয়।

এনবিআর চেয়ারম্যানকে মুঠোফোনে না পেয়ে প্রথম আলোর পক্ষ থেকে কথা বলার অনুরোধ জানিয়ে খুদে বার্তা পাঠানো হয়। তিনি কোনো জবাব দেননি।

ভোজ্যতেল বিপণনকারী শীর্ষস্থানীয় কোম্পানি টি কে গ্রুপের পরিচালক (ফাইন্যান্স অ্যান্ড অপারেশনস) মো. শফিউল আথহার তাসলিম প্রথম আলোকে বলেন, ‘যে প্রজ্ঞাপন জারি হয়েছে, তাতে দামের ওপর কোনো প্রভাব পড়বে না। বড়জোর এক টাকা কমতে পারে। তবে প্রজ্ঞাপন জারির পর থেকে মানুষের প্রশ্নের জবাব দিতে দিতে আমাদের জান শেষ। দরকার ছিল আমদানি পর্যায়ে ভ্যাট প্রত্যাহারের।’

আমদানি পর্যায়ে ভ্যাট প্রত্যাহার হলে প্রতি লিটারে দাম কত কমবে, এমন প্রশ্নের জবাবে শফিউল আথহার তাসলিম বলেন, ‘তখন ২০ টাকার মতো কমতে পারে।’

মন্ত্রীরা কী বলে আসছিলেন

নিত্যপণ্য নিয়ে ১০ মার্চ সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠকের পর অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল সাংবাদিকদের একবার জানান, ‘জিনিসপত্রের দাম সহনীয় পর্যায়ে রাখতে ভ্যাট তুলে নিয়েছি। ভোজ্যতেল, চিনি ও ছোলায় ভ্যাট প্রত্যাহার করা হচ্ছে।’ একই দিন তিনি এ–ও বলেন, ভ্যাট প্রত্যাহার করা হচ্ছে সয়াবিনের ওপর উৎপাদন পর্যায়ে ১৫ শতাংশ এবং ভোক্তাপর্যায়ে ৫ শতাংশ।

বাস্তবে ছোলা আমদানিতে শুল্ক-কর দিতে হয় না, মসুর ডালও করমুক্ত। আর চিনির ওপর নতুন করে শুল্কছাড় দেওয়ার কোনো পরিকল্পনা নেই সরকারের। অপরিশোধিত চিনির ওপর নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক ৩০ শতাংশ থেকে কমিয়ে গত অক্টোবরে ২০ শতাংশ করা হয়। এ শুল্কছাড়ের মেয়াদ ২৮ ফেব্রুয়ারি শেষ হয়ে গেলে চলতি মাসের শুরুতে এনবিআর নতুন করে আড়াই মাসের জন্য সুযোগটি বাড়িয়ে দেয়।

অর্থমন্ত্রীর বক্তব্যের পর সব মহলে বিভ্রান্তি তৈরি হয়। মাঝখানে শুক্র-শনিবার বন্ধ থাকার পর গত রোববার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান সচিবালয়ে দ্রব্যমূল্য পরিস্থিতি ও বাজার পর্যালোচনা বিষয়ে বৈঠক করেন আরও চার মন্ত্রীকে নিয়ে।

বৈঠক শেষে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাংবাদিকের জানিয়েছিলেন, ন্যায্যমূল্যে জনগণের কাছে পণ্য পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা হবে। সরবরাহ, মজুত এবং যেকোনো উপায়ে দাম যেন অস্বাভাবিক বৃদ্ধি না হয়, সেদিকে নজর রাখার সিদ্ধান্ত হয়েছে। আর প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে শুল্ক-কর কমানো বা তুলে দেওয়ার ঘোষণা আসবে।

সচিবালয়ে গতকাল সোমবার দুপুরে ছিল বিশ্ব ভোক্তা অধিকার দিবস উপলক্ষে সংবাদ সম্মেলন। এ সময় বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি জানান, ভোজ্যতেলের উৎপাদন, আমদানি ও ভোক্তা—এ তিন পর্যায়েই ভ্যাট কমানো হবে। আর ভোজ্যতেলসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের সরবরাহ ঠিক রাখা হবে।

একই দিন গতকাল ছিল মন্ত্রিসভার বৈঠকও। এ বৈঠকের অনির্ধারিত আলোচনায় বাজার পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গণভবনে ভার্চ্যুয়ালি এ বৈঠকে অংশ নেন।

বৈঠক শেষে মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম সাংবাদিকদের জানান, ভোজ্যতেল, চিনিসহ অতিপ্রয়োজনীয় নিত্যপণ্যের ওপর আমদানি পর্যায়ে যে ১৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপ করা আছে, সেটি একেবারে কমিয়ে সহনীয় পর্যায়ে আনতে এনবিআরকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। অবিলম্বে এ ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে। তিনি বলেন, ‘আমাদের ধারণা, বাজারে এর সরাসরি প্রভাব পড়বে।’ মন্ত্রিপরিষদ সচিব কথা বলার পর গতকাল বিকেলেই একটি প্রজ্ঞাপন জারি করে এনবিআর।

এদিকে ভোজ্যতেলের দাম নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের চার আইনজীবী ৬ মার্চ জনস্বার্থে যে রিট করেছিলেন, তার পরিপ্রেক্ষিতে বিচারপতি ফারাহ মাহবুব ও বিচারপতি এস এম মনিরুজ্জামানের হাইকোর্ট বেঞ্চে গতকাল একটি শুনানি হয়। আজ মঙ্গলবার আবার শুনানি হওয়ার কথা রয়েছে।