ভ্যাট আইনের সুফল মিলছে না

দেশে ২০১৯ সালের জুলাই মাসে নতুন ভ্যাট আইন চালু হয়। কিন্তু দুই বছরেও রাজস্ব আদায় ও অনলাইন ব্যবস্থায় তেমন অগ্রগতি নেই।

  • মাত্র ৩ হাজার প্রতিষ্ঠানে ইএফডি।

  • দেড় লাখ প্রতিষ্ঠান অনলাইন ভ্যাট ব্যবস্থার বাইরে।

  • ভ্যাট আদায়ে করোনার প্রভাবও আছে।

ভ্যাট

দুই বছর হলো দেশে নতুন ভ্যাট আইন চালু হয়েছে। কিন্তু নতুন আইনটির সুফল এখনো পেতে শুরু করেনি জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। ভ্যাট আইনের মূল উদ্দেশ্য হলো, রাজস্ব আদায়ে শক্তিশালী স্বয়ংক্রিয় অনলাইন ব্যবস্থা চালু করা। আবার স্বয়ংক্রিয়ভাবে ভ্যাট আদায়ের জন্য ইলেকট্রনিক ফিসক্যাল ডিভাইস (ইএফডি) বসানোর উদ্যোগ নেওয়া হলেও গত দুই বছরে মাত্র দেড় হাজার দোকানে এই যন্ত্র বসেছে। এনবিআর সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

২০১২ সালে দেশে নতুন ভ্যাট আইন করা হয়। ২০১৭ সালে আইনটি চালুর কথা থাকলেও ব্যবসায়ীদের আপত্তিতে তা দুই বছর পেছানো হয়। অভিন্ন ১৫ শতাংশ ভ্যাটহারের পরিবর্তে একাধিক ভ্যাটহার করে ২০১৯ সালের জুলাই মাসে নতুন আইন চালু হয়। তবে আইনটি ঘষামাজা করে অনেকটা পুরোনো আইনের মতোই বাস্তবায়ন করা হয়। নতুন আইনে নানামুখী ছাড়ের কারণে বছরে প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকার কাঙ্ক্ষিত রাজস্ব আদায় করা যাচ্ছে না বলে এনবিআর সূত্রে জানা গেছে।

মাত্র ৩ হাজার ইএফডি

২০১৯ সালে ভ্যাট আইন চালুর আগেই প্রথম দফায় এক লাখ ইএফডি আমদানির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। উদ্দেশ্য, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে মেশিনটি ব্যবহারের ফলে ভ্যাটের টাকার হিসাব স্বয়ংক্রিয়ভাবে এনবিআরের মূল সার্ভারে চলে যাবে। তখন সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান শুধু রিটার্ন জমা দিয়ে ভ্যাট পরিশোধ করবে।

আইনটি চালুর প্রথম এক বছরে কোনো ইএফডি আমদানি করতে পারেনি এনবিআর। গত বছরের আগস্ট মাস থেকে পরীক্ষামূলকভাবে ঢাকা ও চট্টগ্রামে ১০০টি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে ইএফডি বসিয়ে এই কার্যক্রম শুরু করা হয়। সর্বশেষ হিসাবমতে, গত মে মাস পর্যন্ত মাত্র তিন হাজার প্রতিষ্ঠানে ইএফডি বসেছে। অথচ এনবিআর প্রথম বছরে, অর্থাৎ ২০১৯-২০ অর্থবছরেই ১০ হাজার ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে ইএফডি বসানোর লক্ষ্য ঠিক ছিল। প্রথম বছরে ইএফডি আমদানি করা সম্ভব না হওয়ায় দ্বিতীয় বছরেও একই লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু এই বছরেও লক্ষ্যের মাত্র ৩০ শতাংশ বাস্তবায়িত হয়েছে।

ইএফডি আনার কার্যাদেশ পাওয়ার এক বছর পর চীনা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ২০২০ সালের মার্চ মাসে প্রথম চালানে ১০০টি ইএফডি সরবরাহ করে। পরে বাকিগুলো আনা হয়। এনবিআরের একজন শীর্ষ কর্মকর্তা জানান, করোনার কারণে ইএফডি বসানোর কাজ শ্লথগতিতে চলছে।

আবার ইএফডি বসানোর ক্ষেত্রেও সমস্যা আছে। এ বিষয়ে বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি মো. হেলাল উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, প্রথমে বলা হয়েছিল, ভ্যাট নিবন্ধন নিলেই ইএফডি দেওয়া হবে। কিন্তু নিবন্ধিত প্রতিষ্ঠানের ১ শতাংশের মতো প্রতিষ্ঠানে ইএফডি বসানো হয়েছে। এতে সমস্যা হলো একটি বিপণিবিতানের ১০০ দোকানের মধ্যে হয়তো ১০টি দোকানে ইএফডি বসানো হয়েছে। ভ্যাটের কারণে দাম বেশি পড়ায় ক্রেতারা ইএফডি আছে, এমন দোকানে যেতে চান না। এনবিআর ভ্যাটের হিসাব বুঝে নেওয়ার ব্যবস্থা করতে না পারলে ব্যবসায়ীদের দোষ দিয়ে লাভ নেই।

অনলাইনের বাইরে দেড় লাখ প্রতিষ্ঠান

নতুন ভ্যাট আইনের সুফল পেতে ভ্যাটের একটি স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা (১৬টি অনলাইন সেবা) চালু করার জন্য ২০১৩ সালে বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় ভ্যাট অনলাইন প্রকল্প নেওয়া হয়। ২০১৮ সালে এই প্রকল্প শেষ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু যথাসময়ে কাজ শেষ না হওয়ায় দুই দফা সময় বাড়ানো হয়। ৬৯০ কোটি টাকার এই প্রকল্প চলতি জুন মাসে শেষ হচ্ছে।

এবার দেখা যাক আট বছরে এই প্রকল্পে কী কাজ হলো। ভ্যাট আইনটি পুরোপুরি বাস্তবায়নে সব ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের অনলাইনে রিটার্ন জমা, ভ্যাট পরিশোধ, রিফান্ডসহ যাবতীয় কার্যক্রম পরিচালনার সুযোগ সৃষ্টি হওয়ার কথা, যা এই করোনার সময়ে বেশি কাজে লাগত। ভ্যাট অনলাইন প্রকল্পের আওতায় অনলাইন রিটার্ন জমার সফটওয়্যার তৈরি করা হলেও মাত্র ১ লাখ ১২ হাজার প্রতিষ্ঠান প্রতি মাসে অনলাইনে রিটার্ন দেয়। তারা ভ্যাটের টাকাও পরিশোধ করে অনলাইনে। বাকি ১ লাখ ৪০ হাজারের মতো প্রতিষ্ঠান এখনো সনাতনী পদ্ধতিতে কাগুজে রিটার্ন দেয়। নতুন ভ্যাট আইন অনুযায়ী, শুধু অনলাইনে রিটার্ন জমা দেয়, এমন প্রতিষ্ঠানই ভ্যাট রিফান্ড নিতে পারবে। ফলে প্রায় দেড় লাখ প্রতিষ্ঠান ভ্যাট রিফান্ড পাওয়ার যোগ্য হলেও আবেদন করতে পারছে না

ভ্যাট অনলাইন প্রকল্পের পরিচালক কাজী মোস্তাফিজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা শুধু সফটওয়্যার উন্নয়ন করেছি। মাঠপর্যায়ের অফিসগুলো অনলাইনে রিটার্ন জমাসহ অন্যান্য কাজ করতে ব্যবসায়ীদের উৎসাহিত করবে। তাহলে ব্যবসায়ীরা ঘরে বসে অনলাইনে ভ্যাটের সব সুবিধা নিতে পারবেন।’

ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, ছোট ছোট শহরে অনেক প্রতিষ্ঠানের বার্ষিক লেনদেন ৫০ লাখ টাকা না হওয়া সত্ত্বেও জোর করে ভ্যাট নিবন্ধন দেওয়া হচ্ছে। এতে নিবন্ধিত ব্যবসায়ীর সংখ্যা বেড়েছে, কিন্তু ভ্যাটদাতার সংখ্যা বাড়েনি।